নির্বাচন কমিশন গঠন নিয়ে চলছে রাজনৈতিক বিতর্ক ও সংশয়
2017.01.16

আগামী নির্বাচনে সব দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার জন্য বড় রকমের ছাড় দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ। গত বুধবার রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ প্রতিনিধি দলের বৈঠকের পর থেকেই এ রকম আলোচনা ঘুরপাক খাচ্ছে।
বৈঠকে নির্বাচনকালীন সরকারের কেবলমাত্র নিয়মতান্ত্রিক দায়িত্ব (রুটিন ওয়ার্ক ) রেখে কাঠামো প্রবর্তন এবং নির্বাচন কমিশন গঠনে স্থায়ী আইন প্রণয়নের জন্য সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। তবে এই প্রস্তাবের কতটুকু আন্তরিক এবং কতটুকু আলংকারিক তা নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে একদিকে চলছে বিতর্ক, অপরদিকে তৈরি হয়েছে সন্দেহ–সংশয়।
নির্বাচনকালীন সরকার কাঠামো প্রবর্তনের জন্য সংবিধান সংশোধন দূরে থাক নির্বাচন কমিশনে নিয়োগ সংক্রান্ত প্রস্তাবিত আইনটিও এই মুহূর্তে হচ্ছে না। এ রকম আইন প্রণয়নের কোনো উদ্যোগ বা প্রস্তুতি এখন পর্যন্ত আইন মন্ত্রণালয় নেয়নি বলে মন্ত্রণালয়টির সচিব শেখ মো. জহিরুল হক বেনার নিউজকে জানিয়েছেন।
মন্ত্রী আনিসুল হক নিজেও গত বৃহস্পতিবার এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, তড়িঘড়ি করে আইনটি করা ঠিক হবে না। পরবর্তী নির্বাচন কমিশন গঠনের জন্য আইনটি তৈরি করা যেতে পারে।
নির্বাচনকালীন সরকার
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি থেকে সরে গিয়ে একটি নির্বাচনকালীন সরকারের কথা বেশ কিছু দিন থেকেই বলে আসছিল বিএনপি। তবে তারা ওই সরকারের কোনো রূপরেখা দেয়নি। বুধবার রাষ্ট্রপতির সঙ্গে আলোচনায় শেখ হাসিনা নিজেই আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থার প্রস্তাব দেন।
তিনি নির্বাচনকালীন সরকারের কর্মপরিধি কেবলমাত্র আবশ্যকীয় দৈনন্দিন (রুটিন) কার্যাবলির মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখার কথা বলেন। সংবিধানের একাদশ সংশোধনীতে তত্ত্বাবধায়ক সরকার রুটিন ওয়ার্কের বাইরে কিছুই করবে না—এ রকম বিধান সুস্পষ্ট করা ছিল।
তবে সংবিধান সংশোধন করে এ রকম বিধান যুক্ত করার ভাবনা আওয়ামী লীগের প্রস্তাবনায় নেই বলে বৃহস্পতিবার বেনার নিউজকে জানিয়েছেন দলটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক পররাষ্ট্র মন্ত্রী দীপু মনি।
তিনি বলেছেন, “নির্বাচনকালীন সময়ে সরকারের কার্যক্রম শুধুমাত্র রুটিন ওয়ার্কের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকা উচিত এবং সেটাই হয়ে থাকে। আগের নির্বাচনের সময়ও আমরা তাই করেছি। অন্যান্য দেশেও তাই হয়ে থাকে। এ কারণেই মাননীয় প্রধানমন্ত্রী রুটিন ওয়ার্কের কথা বলেছেন। এই প্রস্তাবনায় সংবিধান সংশোধন করে নির্বাচনকালীন সরকার প্রবর্তনের কথা বলা হয়নি।”
বিএনপি’র দিক থেকেও সন্দেহ এখনো ঘোচেনি। বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ইনাম আহমেদ চৌধুরী বৃহস্পতিবার বেনার নিউজকে বলেছেন, বিএনপির সঙ্গে সমঝোতার মাধ্যমে নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থা প্রণয়ন করা না হলে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠান করা সম্ভব হবে না। তাই রাজনৈতিক সমঝোতা হওয়া অত্যন্ত জরুরি। তিনি বলেছেন, “নির্বাচন কমিশন নিরপেক্ষ হলেও পক্ষপাতদুষ্ট সরকারের অধীনে তারা সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারবে না।”
আইন কী বলে?
আগামী ৯ ফেব্রুয়ারি কাজী রকিবউদ্দীন আহমদের নেতৃত্বাধীন বর্তমান নির্বাচন কমিশনের পাঁচ বছর মেয়াদ শেষ হচ্ছে। তার আগেই গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিদের নিয়ে নতুন নির্বাচন কমিশন গঠন করতে হবে।
সংবিধানের ১১৮ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠনের এখতিয়ার রাষ্ট্রপতির। তবে এই নিয়োগ হতে হবে উক্ত বিষয়ে প্রণীত আইনের বিধানাবলি-সাপেক্ষে। অথচ সংবিধান রচনার ৪৬ বছরেও আইন হয়নি। সংবিধানের ৪৮(৩) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী এই নিয়োগ দেওয়ার ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতিকে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ মানতে হবে।
উপযুক্ত ও সর্বজনগ্রাহ্য ব্যক্তি খোঁজার জন্য সার্চ কমিটি গঠনের কোনো বিধান না থাকলেও ২০১২ সালে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনা করে সার্চ কমিটির মাধ্যমে নির্বাচন কমিশন গঠন করেন সাবেক রাষ্ট্রপতি মো. জিল্লুর রহমান।
বর্তমান বাস্তবতা
বর্তমানে আইন প্রণয়ন করে সার্চ কমিটির দাবি জোরালো হয়েছে। ১৮ জানুয়ারি পর্যন্ত বিভিন্ন দলের সঙ্গে রাষ্ট্রপতির সংলাপের কার্যসূচী নির্ধারিত আছে। বর্তমান নির্বাচন কমিশনের মেয়াদ আছে মাত্র ২৪ দিন। এই সময়ের মধ্যে সকল দলের সঙ্গে রাষ্ট্রপতির সংলাপ সম্পন্ন করা এবং নতুন আইন প্রণয়ন করে তারপর নির্বাচন কমিশন গঠন করা কতটুকু সম্ভব সে নিয়ে প্রশ্ন আছে।
সংসদের পরবর্তী অধিবেশন বসবে আগামী ২২ জানুয়ারি। সংসদ চলাকালীন অধ্যাদেশের মাধ্যমে আইন প্রণয়নের কোনো সুযোগ নেই বলে কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।
আইন প্রণয়ন প্রক্রিয়ায় কোনো অগ্রগতি আছে কিনা জানতে চাইলে আইন বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব শেখ মো. জহিরুল হক বৃহস্পতিবার বেনার নিউজকে বলেন, “মহামান্য রাষ্ট্রপতি যেভাবে বলবেন, সেভাবে হবে। কী করবেন বা কীভাবে হবে সে রকম কোনো কাগজপত্র এখনো আমাদের কাছে আসেনি।”
তবে রাষ্ট্রপতির প্রেস সচিব জয়নাল আবেদিন বেনার নিউজকে বলেছেন, “মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আইন প্রণয়নের কথা বলেছেন। আইন প্রণয়নের প্রক্রিয়া মন্ত্রণালয় থেকেই শুরু হয়। এরপর সংসদে যায় এবং সর্বশেষ রাষ্ট্রপতির কাছে আসে।”
রাষ্ট্রপতি ইতিমধ্যে সংসদ অধিবেশন আহ্বান করেছেন। এই অবস্থায় অধ্যাদেশ জারি করার আর কোনো সুযোগ নেই বলেও তিনি জানান। উল্লেখ্য, সময় ঘনিয়ে আসায় কালক্ষেপণ পরিহার করার জন্য অধ্যাদেশ জারির প্রসঙ্গটি রাষ্ট্রপতির সঙ্গে আলোচনার সময় উল্লেখ করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী।
এই বাস্তবতায় কর্মকর্তারা বলছেন, আলোচনা শেষে সকল দলের প্রস্তাবনাগুলো আপাতত হিমাগারে রেখে প্রচলিত বিধান অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শেই নতুন প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং অন্যান্য নির্বাচন কমিশনারদের নিয়োগ দিতে হবে রাষ্ট্রপতিকে। কারণ আইন অনুযায়ী এ ছাড়া কিছুই করণীয় নেই রাষ্ট্রপতির। এমনকি সার্চ কমিটি গঠন ছাড়াই এবার কমিশন গঠন করা হতে পারে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানিয়েছে।
দল ও বিশ্লেষকদের ভাবনা
রাষ্ট্রপতি এ পর্যন্ত যেসব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনা করেছেন, তাদের মধ্যে সরকারি দল আওয়ামী লীগসহ ২১টি দলই নির্বাচন কমিশন গঠনের জন্য আইন প্রণয়নের প্রস্তাব দিয়েছে। শুধু বিএনপি এ বিষয়ে কোনো কথা বলেনি।
সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচন কমিশনারদের নিয়োগের ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ নেওয়ার বাধ্যবাধকতা থাকলেও রাষ্ট্রপতির সিদ্ধান্তই মেনে নেবেন বলে আলোচনায় বলেছেন শেখ হাসিনা।
আওয়ামী লীগের দিক থেকে নির্বাচনকালীন সরকারের ভাবনা এবং নির্বাচন কমিশন সংক্রান্ত আইন প্রণয়নে সম্মতির বিষয়টি অত্যন্ত ইতিবাচক বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা।
সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার এটিএম শামসুল হুদা বেনার নিউজকে বলেছেন, “আইনটি হওয়া দরকার। বিভিন্ন দলের মতামতের ভিত্তিতে আমরা আইনের একটি খসড়া প্রণয়ন করেছিলাম। সেই খসড়াটি এখনো রয়ে গেছে। সরকার চাইলে সেই খসড়াটি কাজে লাগাতে পারে।
কমিশনকে বিরোধের ঊর্ধ্বে রাখার জন্য আইনটি প্রণয়ন করা জরুরি হয়ে পড়েছে বলে জানিয়েছেন নাগরিক সংগঠন সুজন এর সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার।
নির্বাচনকালীন সরকার প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন, “আওয়ামী লীগের প্রস্তাবটি এখনো স্পষ্ট নয়। তবে এ রকম চিন্তা ভালো। বিএনপির এ ক্ষেত্রে ইতিবাচক মনোভাব নিয়ে এগিয়ে যাওয়া উচিত।”