আওয়ামী লীগের বিজয় ঘোষণার নির্বাচন রোববার

কামরান রেজা চৌধুরী
2024.01.06
ঢাকা
আওয়ামী লীগের বিজয় ঘোষণার নির্বাচন রোববার আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের উপস্থিতিতে ব্যালট বাক্স এবং অন্যান্য নির্বাচনী সামগ্রী হাতে নির্বাচনী কর্মকর্তারা। ঢাকা, জানুয়ারি ৬, ২০২৪।
এপি

বড় ধরনের সহিংসতার আশঙ্কা ও দেশের মূল বিরোধী রাজনৈতিক দল বিএনপির বর্জনের মধ্য দিয়ে রোববার অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন।

এই নির্বাচনের মাধ্যমে দেশের ইতিহাসে টানা চতুর্থবার ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হতে যাচ্ছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ।  একইসঙ্গে ২০০৯ সাল থেকে টানা চারবার প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হতে যাচ্ছেন দলীয় প্রধান শেখ হাসিনা।

শনিবার জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে প্রধান নির্বাচন কমিশনার ২৯৯টি সংসদীয় আসনে সংসদ সদস্য নির্বাচিত করতে প্রায় ১২ কোটি ভোটারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।

রোববার সকাল ৮টা থেকে বিকালে ৪টা পর্যন্ত ভোটগ্রহণ চলবে।  সোমবার নাগাদ জানা যাবে, কতটি আসনে জয়ী হয়ে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করতে যাচ্ছে।

নির্বাচন বর্জনের আহ্বান জানিয়ে এবং ভোট না দিয়ে ঘরে অবস্থান করে বিএনপি দেশবাসীকে হরতাল কর্মসূচি পালনের আহ্বান জানিয়েছে।

অন্যদিকে বিএনপি ও তার সমমনা দলগুলোকে সন্ত্রাসী আখ্যা দিয়ে তাদের প্রতিহত করতে এবং দেশের গণতান্ত্রিক ও উন্নয়নের ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখতে কেন্দ্রে গিয়ে ভোট দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ।

ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপ জানিয়েছে, রোববারের একতরফা নির্বাচন দেশকে আরও সহিংসতার দিকে ঠেলে দেবে, যা নির্বাচনের পরেও অব্যাহত থাকতে পারে।

নির্বাচনের আগে সহিংস ঘটনা

নির্বাচনের প্রাক্কালে শুক্রবার ও শনিবার সারা দেশে সহিংসতায় প্রাণ হারিয়েছেন ৫ জন।  এর মধ্যে শুক্রবার রাত ৯টার দিকে ঢাকা-বেনাপোল রুটে চলা বেনাপোল এক্সপ্রেস ট্রেনে অগ্নিকাণ্ডে এখন পর্যন্ত চারজন প্রাণ হারান।

66eeaa36-9962-4493-bccf-b80dc1602eb9.jpg
পুড়ে যাওয়া বেনাপোল এক্সপ্রেস ট্রেনের ক্ষতিগ্রস্থ কামরা পরিদর্শন করছেন পুলিশ সদস্যরা। জানুয়ারি ৬, ২০২৪।  ছবি: সনি রামানি, বেনারনিউজ।

এ ছাড়া শনিবার সকালে রাজবাড়ীর বালিয়াকান্দিতে ভোটকেন্দ্রে পাহারায় থাকা রনজিৎ কুমার দে (৪৫) নামের একজন গ্রাম পুলিশ সদস্যকে শ্বাসরুদ্ধ করে হত্যা করেছে দুর্বৃত্তরা।

ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স জানিয়েছে, শুক্রবার সন্ধ্যা ৬টা থেকে শনিবার সকাল ১০টা পর্যন্ত মোট ১৪টি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে।

গত শুক্রবার দিবাগত রাত থেকে শনিবার সকাল পর্যন্ত দেশের ৯ জেলায় ১৬ ভোটকেন্দ্রে আগুন দেয় দুর্বৃত্তরা। তবে বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতি না হওয়ায় কেন্দ্রগুলোতে স্বাভাবিকভাবে ভোটগ্রহণ চলবে বলে জানিয়েছে নির্বাচন কমিশন। গাজীপুর, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, বরগুনা, শরীয়তপুর, পটুয়াখালী, সুনামগঞ্জ, ময়মনসিংহ ও নেত্রকোণায় ভোটকেন্দ্রে আগুন দেওয়ার তথ্য পেয়েছে কমিশন।

ঢাকা থেকে ছেড়ে যাওয়া বেঙ্গল পরিবহনের কক্সবাজারগামী যাত্রীবাহী বাসের সিটের ওপর মালিকবিহীন অবস্থায় টাইম জেনারেটিং ইমপ্রোভাইজড এক্সপ্লোসিভ ডিভাইস (আইইডি) শনাক্ত করেছে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের বোমা ডিসপোজাল ইউনিট। শনিবার রাতে বাসের সুপারভাইজার মো. হাসান বোমা সদৃশ বস্তু দেখে কল দেন জাতীয় জরুরি সেবা '৯৯৯' নম্বরে।

এ ছাড়া ঢাকা ও চট্টগ্রামে শনিবার রাতে বিক্ষিপ্তভাবে বেশ কয়েকটি ককটেল বিস্ফোরণের খবর প্রকাশ করেছে ঢাকার গণমাধ্যমগুলো।

এই পরিস্থিতিতে উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা ও অস্বস্তি পরাভূত করে নির্ভয়ে ভোট দিয়ে নাগরিক দায়িত্ব পালনের জন্য ভোটারদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল।

নির্বাচনের আগের দিন আজ শনিবার সন্ধ্যায় জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে সিইসি এ অনুরোধ করেন। বিটিভিতে সিইসির এ ভাষণ প্রচার করা হয় ।

‘আওয়ামী লীগ বনাম আওয়ামী লীগ’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও জাতীয় নির্বাচন পর্যবেক্ষণ পরিষদ (জানিপপ) প্রধান নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহ বেনারকে বলেন, “এই নির্বাচন মূলত আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী বনাম আওয়ামী নেতা - যারা স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে ভোট করছেন তাদের মধ্যকার লড়াই। সুতরাং, আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী হোক অথবা স্বতন্ত্র হোক; যে-ই জয়লাভ করুক না কেন, সেটি আসলে আওয়ামী লীগের জয়।”

তিনি বলেন, “আওয়ামী লীগসহ মোট ২৮টি দল নির্বাচনে থাকলেও এটি মূলত একতরফা নির্বাচন। যেসব দল অংশ নিচ্ছে সেগুলোর কোনো জনপ্রিয়তা নেই। এদের পক্ষে আওয়ামী লীগকে পরাজিত করা সম্ভব নয়। এই নির্বাচনের মাধ্যমে দেশের প্রশাসন পরিবর্তন হবে মাত্র।”

শনিবার সন্ধ্যায় জাতির উদ্দেশ্যে দেওয়া ভাষণে প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেন, দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগসহ ২৮ টি রাজনৈতিক দল অংশগ্রহণ করছে 

যে কারণে বিরোধী দল ভোটে নেই

আওয়ামী লীগ, বিএনপি এবং সব রাজনৈতিক দলের দীর্ঘ আন্দোলনের মুখে ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর সামরিক শাসক জেনারেল এরশাদের পতনের পর একটি নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে জয়লাভ করে বিএনপি। তবে ১৯৯৪ সালে মাগুরার একটি আসনে উপনির্বাচনে ব্যাপক কারচুপির পর পরবর্তী জাতীয় সংসদ নির্বাচন সুষ্ঠু করতে সংবিধানে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তনের জন্য রাস্তায় হরতাল-অবরোধ শুরু করে আওয়ামী লীগ ও তার শরিকরা।

আন্দোলনের মুখে বাধ্য হয়ে ১৯৯৬ সালে সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সংযোজন করে বিএনপি সরকার।  এরপর থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত প্রতিটি সংসদ নির্বাচন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হয়।

২০০৯ সালে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে আদালতের এক রায়ের আলোকে ২০১১ সালের ৩০ জুন সংবিধান থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বিলুপ্ত করে আওয়ামী লীগ।

এর প্রতিবাদে রাস্তায় নামে বিএনপি। তাদের ভাষ্য ছিল, নির্বাচনে জালিয়াতি করে ক্ষমতায় আসতেই সংবিধান সংশোধন করা হয়েছে।

তারা আরও অভিযোগ করে, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলের আগে অধিকাংশ রাজনৈতিক দলের মত নেওয়া হয়নি।

২০১৪ সালের নির্বাচন বয়কট করে বিএনপি ও তার রাজনৈতিক মিত্র বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী প্রতিহত করার ঘোষণা দেয়। সে সময় সহিংসতা ও অগ্নিকাণ্ডে প্রাণ হারান শতাধিক মানুষ। 

ওই নির্বাচনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় টানা দ্বিতীয়বারের মতো ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ।

গত নির্বাচনে (২০১৮) বিএনপি অংশ নিলেও একক সংখ্যার আসনে জয়লাভ করে।  তারা অভিযোগ তোলে, ভোটের আগের রাতে ব্যালট পেপারে সিল মেরে বাক্স ভরে জয়লাভ করেছে আওয়ামী লীগ।

দলীয় সরকারের অধীনে সুষ্ঠু ভোট সম্ভব না দাবি করে দ্বাদশ সংসদীয় নির্বাচনের আগে বিএনপি মাঠে নামে।  সরকারের পদত্যাগের একদফা দাবিতে গত ২৮ অক্টোবর ঢাকায় মহাসমাবেশ করে দলটি।

সেই সমাবেশ প্রথম দিকে শান্তিপূর্ণ থাকলেও পরবর্তীতে সহিংসতায় রূপ নেয়।  দুর্বৃত্তদের হাতে একজন পুলিশ সদস্য প্রাণ হারান।  প্রধান বিচারপতির বাসভবনে হামলার ঘটনা ঘটে।

বিএনপির দাবি, ২৮ অক্টোবরের সহিংসতাকে কেন্দ্র করে প্রায় ১০ হাজার বিরোধী দলীয় নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। কারাবন্দি হয়েছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরীসহ দলটির শীর্ষস্থানীয় নেতারা।

গণমাধ্যমের প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুসারে, ২৮ অক্টোবর থেকে এ পর্যন্ত প্রাণ হারিয়েছেন ৩৯ জন।  এদের মধ্যে নির্বাচনী সহিংসতায় মারা গেছেন সাতজন, কারা হেফাজতে মারা গেছেন বিএনপির আরও নয়জন নেতাকর্মী।

2023-10-28T120803Z_584860468_RC2I14AYXGCI_RTRMADP_3_BANGLADESH-POLITICS.JPG
নয়া পল্টনে বিএনপির সমাবেশের একটি দৃশ্য। ঢাকা। অক্টোবর ২৮, ২০২৩। ছবি: রয়টার্স

নির্বাচনের পরে এই সহিংসতা বন্ধ হয়ে যাবে বলে মনে করেন অধ্যাপক কলিমউল্লাহ।  তিনি বেনারকে বলেন, “আমার মনে হয় না সহিংসতা করার মতো সামর্থ্য বিএনপির আছে।  তাদের নেতা-কর্মীরা কারাগারে অথবা পলাতক।  সুতরাং, ভোটের পর সবই স্বাভাবিক হয়ে যাবে।”

রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক নিজাম উদ্দিন আহমেদ বেনারকে বলেন, “এই নির্বাচনের মাধ্যমে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হলো দেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার।  আগামী সংসদটি জনগণের প্রত্যাশা পূরণ করতে পারবে বলে আমি মনে করি না।”

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।