খালেদার মামলার রায়: দেশজুড়ে বিএনপির নেতা-কর্মীদের ধরপাকড়
2018.02.06
ঢাকা

আগামী ৮ ফেব্রুয়ারি বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলার রায় ঘোষণাকে ঘিরে দলটির নেতা কর্মীদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তার অভিযান চালাচ্ছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। শুধু মঙ্গলবারই রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে আটকের সংখ্যা ৭০০ ছাড়িয়েছে বলে নিশ্চিত করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য এবং পুলিশের হিসেবে, গত এক সপ্তাহে এই সংখ্যা দাঁড়িয়েছে দেড় হাজারেরও বেশি। গ্রেপ্তার ছাড়াও ঢাকার সাতটি প্রবেশ পথসহ শহরের বিভিন্ন স্থানে বসানো হয়েছে তল্লাশিচৌকি।
বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী অভিযোগ করেছেন, বিএনপির ১২০০ নেতা-কর্মীকে পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে। তবে মঙ্গলবার গ্রেপ্তার হওয়া নেতা–কর্মীদের তথ্য ওই সংখ্যার বাইরে।
মঙ্গলবার নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে দুপুরে সংবাদ সম্মেলন করেন রিজভী। তিনি বলেন, অন্যায়ভাবে বিএনপির নেতা কর্মীদের গ্রেপ্তার করে বানোয়াট, ভিত্তিহীন, অসত্য ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মামলা দেওয়া হচ্ছে।
এই ধরপাকড় উত্তেজনার মাঝেই নতুন নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি)। রায়ের দিন বৃহস্পতিবার ভোর চারটা থেকে পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত রাজধানীতে মিছিল ও জমায়েতে নিষেধাজ্ঞা ঘোষণা করা হয়েছে।
সব মিলিয়ে চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে উদ্বেগজনক মনে করছেন বিশ্লেষকেরা।
“উদ্ভূত পরিস্থিতি নিয়ে আমরা সত্যিই উদ্বিগ্ন। এ ধরনের উত্তেজনা কোনো সমাধান আনবে না। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যকার এই চরম বিরোধ রাজনৈতিকভাবেই সমাধান হওয়া দরকার,” বেনারকে বলেন সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার।
বিএনপির দাবি সরকার তাদের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটাতেই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে দিয়ে বিরোধীদের ওপর দমন পীড়ন চালাচ্ছে।
এ প্রসঙ্গে রিজভী বলেন, “৮ ফেব্রুয়ারি সরকার প্রধানের ইচ্ছা পূরণ করতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বেপরোয়া উন্মত্ততায় বিএনপির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ছে। মনে হয় সরকার রায় নির্ধারণ করে রেখেছে। এ কারণেই এর প্রতিক্রিয়ার অজানা ‘আতঙ্কে’ বিএনপি নেতা-কর্মীদের ওপর বুলডোজার চালাচ্ছে।”
তবে খালেদা জিয়ার এই মামলার রায়কে কেন্দ্র করে বিএনপিই অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরির চেষ্টা করছে বলে দাবি করেছে ক্ষমতাসীনরা।
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সেতু ও পরিবহনমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, “আমরা ক্ষমতায় থেকে কেন অশান্তি ডেকে আনব? কিন্তু বিএনপি যদি উসকানি দেয় এবং হাইকোর্টের সামনে প্রিজন ভ্যানে হামলার মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়, তাহলে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা পরিস্থিতি মোকাবিলা করবে।”
মঙ্গলবার রাজধানীর ধানমন্ডিতে আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর রাজনৈতিক কার্যালয়ে দলের সম্পাদকমণ্ডলী এবং সহযোগী সংগঠনের এক যৌথ সভা শেষে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এ কথা বলেন তিনি।
গ্রেপ্তার অভিযান অব্যাহত
খালেদার মামলার রায় ঘোষণার আগে ও পরের পরিস্থিতি সামাল দিতে বৃহস্পতিবার পুলিশ সদর দপ্তর থেকে ১৮ দফা নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এরপরেই ঢাকার বাইরে থেকে অযাচিত মানুষের আগমন ঠেকাতে গত সোমবার থেকেই রাজধানীর আটটি প্রবেশপথে তল্লাশি চৌকি বসিয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
গ্রেপ্তার অভিযানও অব্যাহত রয়েছে, যা আগামী ১০ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত চলবে বলে জানিয়েছে পুলিশের একটি দায়িত্বশীল সূত্র।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, বিএনপিসহ স্থানীয় বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, ঢাকাসহ সারা দেশে গত ৩১ জানুয়ারি ১৬৮ জন, ১ ফেব্রুয়ারি ১১০ জন, ২ ফেব্রুয়ারি ১৫০ জন, ৩ ফেব্রুয়ারি ৫২ জন, ৪ ফেব্রুয়ারি ১৫৪ জন এবং ৫ ফেব্রুয়ারি ৪৩১ জনকে আটক করা হয়। তবে মঙ্গলবার এ সংখ্যা ৭শ’ ছাড়িয়েছে। সব মিলিয়ে সাত দিনে আটক হয়েছেন দেড় হাজারেরও বেশি নেতা–কর্মী।
এদিকে রাজধানীর বাস টার্মিনালগুলোতে পাহারা বসানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার সমর্থক পরিবহন মালিক ও শ্রমিকেরা। প্রয়োজনে তল্লাশি ও যানবাহন চলাচল নিয়ন্ত্রণ করা হবে বলে জানিয়েছে মালিক-শ্রমিক সংগঠন সূত্র।
পুলিশকে সতর্ক থাকার নির্দেশ
আগামী ৮ ফেব্রুয়ারি জিয়া এতিমখানা ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলার রায় ঘোষণা করবে ঢাকার পঞ্চম জজ আদালত। বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া, তাঁর ছেলে তারেক রহমানসহ ছয়জন দুই কোটি ১০ লাখ টাকা আত্মসাতের এ মামলার আসামি।
এ রায় নিয়ে যাতে কোনো ধরনের অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি না হয় সে ব্যাপারে সতর্ক অবস্থায় রয়েছে পুলিশ।
মঙ্গলবার ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন এলাকার জ্যেষ্ঠ পুলিশ কর্মকর্তাদের ৮ ফেব্রুয়ারির পরিস্থিতি নিয়ে সতর্ক থাকার নির্দেশনা দিয়েছেন পুলিশ মহাপরিদর্শক জাবেদ পাটোয়ারী। পাশাপাশি এদিন ভোর থেকেই রাজধানীতে সকল প্রকার মিছিল-জমায়েতে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে।
বৃহস্পতিবার ভোর ৪টা থেকে পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত ঢাকা মহানগরে সব ধরনের ছড়ি বা লাঠি, ছুরি, চাকু বা ধারালো অস্ত্র, বিস্ফোরক দ্রব্য ও দাহ্য পদার্থ বহন নিষিদ্ধ থাকবে বলে মঙ্গলবার ঢাকার পুলিশ কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া স্বাক্ষরিত এক বিশেষ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়।
এ সময় যানবাহন, জনসাধারণের চলাচলে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি ও রাস্তায় দাঁড়িয়ে বা বসে মিছিল করা যাবে না।
বিচারাধীন একটি মামলার রায়কে কেন্দ্র করে বৃহস্পতিবার ঢাকা মহানগরীতে কোনো কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠী কর্তৃক অরাজকতা ও নৈরাজ্য সৃষ্টির মাধ্যমে জননিরাপত্তা ও জনশৃঙ্খলা বিঘ্নের অপপ্রয়াস হতে পারে বলে বিভিন্ন গোয়েন্দা তথ্য, ইলেকট্রনিক, প্রিন্ট ও সোশ্যাল মিডিয়ার সূত্রে জানা যায় বলে এতে উল্লেখ করা হয়।
এদিকে সরকারি বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, বিএনপি যাতে মাঠে বেশি নেতা কর্মী নামাতে না পারে সে কারণে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত চলমান গ্রেপ্তার অভিযান অব্যাহত রাখা হবে। রায়ের দিন দলটির নেতা-কর্মীদের সংগঠিত হওয়া ঠেকাতে মোড়ে মোড়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অবস্থান নেবে।
জনগণের জানমালের নিরাপত্তা রক্ষার প্রয়োজনে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরাও পুলিশের সহযোগী হিসেবে পাশে থাকবে বলে সাংবাদিকদের জানান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের।
“অনেক দিন পর আবার আতঙ্ক মনে হচ্ছে। দুই দল যেভাবে পাল্টাপাল্টি হুমকি দিচ্ছে এবং পুলিশ গণগ্রেপ্তার করেছে; তাতে মনে হচ্ছে আবারও রাজনৈতিক কোন্দলের মুখে পড়তে যাচ্ছে দেশ,” বেনারকে বলছিলেন ঢাকার একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক আনিসুল ইসলাম।
“আমরা শঙ্কিত; তবে আমাদের চেয়ে বেশি শঙ্কায় আছে শিক্ষার্থীরা। তারা আমাদের জিজ্ঞেস করছে, বৃহস্পতিবার ক্লাস হবে কিনা; আসতে হবে কিনা। আমরা না পারছি ক্লাস বন্ধ রাখতে না পারছি তাদের আসতে বলতে। আমরা আসলেই উদ্বিগ্ন,” বলেন তিনি।
উল্লেখ্য, বৃহস্পতিবার এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষা রয়েছে, বিদ্যমান পরিস্থিতিতে সেটি হবে কিনা তা নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্ব সৃষ্টি হয়েছে। এই পরীক্ষায় সারা দেশে প্রায় ২০ লাখ ছাত্রছাত্রী অংশ নেবে।