চলছে প্রাক-নির্বাচনী বিতর্ক ও মেরুকরণ

পুলক ঘটক
2018.08.16
ঢাকা
180816_Political_Polarization_1000.jpg ঢাকায় সমর্থকেরা গাছে উঠে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার বক্তব্য শুনছেন। ২০ জানুয়ারি ২০১৪।
এপি

একাদশ জাতীয় সংসদ এগিয়ে আসার প্রেক্ষাপটে একদিকে রাজনৈতিক বিতর্ক বাড়ছে, আরেকদিকে রাজনৈতিক দলগুলোর নতুন মেরুকরণের প্রচেষ্টা বাড়ছে। যদিও এই নির্বাচনে সব দল, বিশেষ করে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রধান প্রতিপক্ষ বিএনপির অংশগ্রহণ এখন পর্যন্ত নিশ্চিত নয়।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান বলেন, “আমরা এই সরকারের অধীনে নির্বাচনের নামে প্রহসনে যেতে চাই না। সাম্প্রতিক সিটি নির্বাচনগুলো প্রহসনের বড় উদাহরণ।” বৃহস্পতিবার ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে অনুষ্ঠিত আলোচনা সভায় নজরুল ইসলাম এ কথা বলেন।

আসন্ন নির্বাচনে বিএনপির অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে কূটনৈতিক মহলসহ দেশের বুদ্ধিজীবী ও সুশীল সমাজ বারবার সংলাপ আয়োজনের কথা বলে আসছে। বিএনপির নেতারাও বহুবার সংলাপের প্রস্তাব দিয়েছেন। বরাবরই এই প্রস্তাবের বিরোধীতা করে আসছে আওয়ামী লীগ।

বৃহস্পতিবার ঢাকার আগারগাঁওয়ে নির্বাচন কমিশনের (ইসি) এক বৈঠকের পর কমিশনরে সচিব হেলাল উদ্দিন জানান, জাতীয় নির্বাচনের আগে তাঁরা কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সংলাপের আয়োজন করবেন না।

অক্টোবরের শেষ দিকে জাতীয় নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার সম্ভাবনা রয়েছে জানিয়ে ইসি সচিব আরও বলেন, “সংলাপ করার মতো যথেষ্ট সময় ইসির হাতে নেই।”

রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. আতাউর রহমান বেনারকে বলেন, “এখন সরকার যদি দয়া করে তাহলে সংলাপ হবে। অন্য কারো কথায় এখন আর কিছুই হবে বলে মনে হয় না।”

বৃহস্পতিবার ইডেন মহিলা কলেজে অনুষ্ঠিত পৃথক আলোচনা সভায় আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, “বিএনপির সঙ্গে আলোচনা হওয়ার অবস্থা নেই, তাদের রাজনীতি হচ্ছে মিথ্যাচার ও গুজব ছড়ানো।”

চলছে দল ভারী করার চেষ্টা

নতুন রাজনৈতিক মেরুকরণ প্রচেষ্টায় বড় দুই দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি ইতিমধ্যে ইসলামী এবং বাম রাজনৈতিক দলগুলোকে নিয়ে টানাটানি শুরু করেছে। উভয় পক্ষের লক্ষ্য নির্বাচনকে সামনে রেখে নিজেদের রাজনৈতিক বলয় বড় করা।

গত ২৪ জুলাই আকস্মিক বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) কার্যালয়ে যান আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। একদিন পর কৃষক-শ্রমিক জনতা লীগের সভাপতি আবদুল কাদের সিদ্দিকীর সঙ্গে বৈঠক করেন তিনি। পরদিন বৈঠক করেন বিএনপি থেকে বেরিয়ে আসা বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট অ্যালায়েন্সের নেতা ও সাবেক মন্ত্রী নাজমুল হুদার সঙ্গেও।

নাজমুল হুদা বেনারকে বলেন, “আমরা আওয়ামীলীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোটে যেতে আগ্রহী।” তবে সিপিবি সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেন, “আমরা আওয়ামীলীগ বা বিএনপি কারও সঙ্গেই যাব না।”

সম্প্রতি আটটি বাম সংগঠন নিয়ে একটি নতুন জোটে সম্পৃক্ত হয়েছে সিপিবি।

“আমরা জনগণকে সঙ্গে নিয়ে বিকল্প মোর্চা ও বিকল্প শক্তি গড়ে তোলার জন্য কাজ করছি,” বলেন সিপিবির সভাপতি সেলিম।

সব দলের সঙ্গে বৈঠক করলেও আওয়ামী লীগের বেশি আগ্রহ ইসলামপন্থী দলগুলোকে নিজেদের দিকে টানা। তবে ১৪-দলের শরিক বামপন্থী দলগুলোর আপত্তির মুখে তারা এখন পর্যন্ত সেটা করতে পারেনি।

১৪-দলের শরিক গণতন্ত্রী পার্টির সাধারণ সম্পাদক ডা. সাহাদত হোসেন বেনারকে বলেন, “১৪-দল একটি আদর্শিক জোট। আমরা সব সময় সাম্প্রদায়িক দলগুলোকে এখানে যুক্ত করার প্রশ্নে বাধা দিয়েছি।”

তবে নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে একটি কৌশলগত ‘মহা-মহাজোট’ গঠনের সম্ভাবনা আছে বলে তিনি স্বীকার করেন।

অন্যদিকে সাবেক রাষ্ট্রপতি বদরুদ্দোজা চৌধুরী, আসম আব্দুর রব এবং মাহমুদুর রহমান মান্নার নেতৃত্বাধীন তিনটি দলের ‘যুক্ত ফ্রন্ট’ বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোটের সঙ্গেই যাচ্ছে বলে রাজনীতিতে আলোচনা আছে। তবে বিষয়টি এখন পর্যন্ত স্পষ্ট হয়নি।

আওয়ামীলীগ এবং বিএনপি’র পর তুলনামূলকভাবে বড় রাজনৈতিক দল জাতীয় পার্টি এবং জামায়াতে ইসলামী মূল দুই দলের সঙ্গে থাকবে, নাকি স্বতন্ত্র রাজনৈতিক জোটে নেতৃত্ব দেবে তা নিয়েও চলছে জল্পনা-কল্পনা।

কোন পথে ইসলামী দলগুলো

বাংলাদেশের রাজনীতিতে বড় ফ্যাক্টর হয়ে ওঠা কওমি মাদ্রাসার ছাত্র-শিক্ষকদের সংগঠন হেফাজতে ইসলামের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক আজিজুল হক ইসলামাবাদী বেনারকে বলেন, “রাজনীতি আমাদের কাজ নয়। ইমান আকিদা রক্ষায় আন্দোলন করাই আমাদের লক্ষ্য।”

তবে বড় দুই দলই তাদের সাথে সুসম্পর্ক রাখছে। আর নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত ১০টি ইসলামী দলের মধ্যে নজিবুল বশর মাইজভান্ডারীর নেতৃত্বাধীন তরীকত ফেডারেশন দুই সাংসদ নিয়ে সরকারের সঙ্গে আছে।

বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন, বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্ট ও জাকের পার্টিও সরকারের প্রতি সহানুভূতিশীল। খেলাফত মজলিস ও জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোটে আছে।

প্রয়াত শায়খুল হাদীস আল্লামা আজিজুল হকের প্রতিষ্ঠিত ‘বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস’ বিএনপি-জামায়াতের জোট থেকে বেরিয়ে গেছে। গত শনিবার তারা সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টির সঙ্গে নির্বাচনী সমঝোতার ঘোষণা দিয়েছে।

গত বছরের ৩০ মার্চ ৩৪টি ইসলামপন্থী সংগঠনকে নিয়ে ‘জাতীয় ইসলামী মহাজোট’ করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিশেষ দূত এরশাদ। এর কিছুদিন পর বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্ট (মান্নান) এই জোটে যুক্ত হয়।

কওমিপন্থীদের অন্যতম দল ইসলামী ঐক্যজোট (নেজামী-ফয়জুল্লাহ) বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোট ছেড়ে দিয়ে একা প্রতিদ্বন্দ্বিতার প্রস্তুতি নিচ্ছে। নারী নেতৃত্ব এড়িয়ে চলা চরমোনাই পীরের নেতৃত্বাধীন ইসলামী আন্দোলনও এবার এককভাবে তিনশ আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার কথা জানিয়েছে।

ইসলামী শাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে আগামীতে সবগুলো ইসলামপন্থী দলকে নিয়ে জাতীয় পার্টির নেতৃত্বে একটি বৃহত্তর জোট হতে পারে বলেও আলোচনা আছে।

পার্টি মহাসচিব এবিএম রুহুল আমিন হাওলাদার বেনারকে বলেন, “পল্লীবন্ধু এরশাদকে রাষ্ট্রক্ষমতায় বসাতে না পারলে এই দেশ নিরাপদ ও উন্নত হবে না। এ জন্য আমরা সব সম্ভাবনা মাথায় রেখেই এগোচ্ছি।”

জামায়াত-সরকারের আঁতাত

সরকার বিরোধী ২০-দলীয় জোটের প্রধান দুই দল বিএনপি এবং জামায়াতের মধ্যে মতপার্থক্য এখন স্পষ্ট। সিলেট সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে মেয়র পদে একক প্রার্থী দিতে পারেনি এই জোট।

আদালত অবমাননার দায়ে দণ্ডিত জামায়াতে ইসলামীর সাবেক সংসদ সদস্য হামিদুর রহমান আযাদ দীর্ঘদিন পলাতক থাকার পর জুলাইয়ের ২৫ তারিখ অকস্মাৎ আদালতে আত্মসমর্পণ করেন।

বিএনপির সন্দেহ, সরকারের সঙ্গে জামায়াতের একটা বোঝাপড়া হয়েছে। এর আগে ১০ জুলাই কারামুক্ত হন জামায়াতের আমির মকবুল আহমাদ।

সিলেট জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক আলী আহমদ বেনারকে বলেন, “জামায়াত নেতাদের মুক্তি এবং সিলেটে বিএনপির বিরুদ্ধে প্রার্থী দেওয়া একই সূত্রে গাঁথা।”

বিএনপির স্থায়ী কমিটির অন্যতম সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বেনারকে বলেন, “সরকার নানা প্রলোভন দিয়ে বিএনপির পাশাপাশি ২০ দলীয় জোটকেও ভাঙতে চাইছে।”

তবে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবুল আলম হানিফ বেনারকে বলেন, “এসব আন্দাজ নির্ভর প্রচারণা ছাড়া কিছুই নয়।”

জামায়াতের কেন্দ্রীয় প্রচার বিভাগের সেক্রেটারি অধ্যাপক মো: তাসনীম আলম এক বিবৃতিতে সরকারের সঙ্গে তাঁদের আঁতাতের বিষয়টি ‘ভিত্তিহীন’ বলে দাবি করেন।

ঢাকা থেকে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন শরীফ খিয়াম।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।