যশোর রোডের গাছ না কাটার দাবি পরিবেশবাদীদের
2018.01.16
ঢাকা

সম্প্রসারণ ও উন্নয়নের জন্য যশোর-বেনাপোল জাতীয় মহাসড়কের (যশোর রোড) মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি বহনকারী হাজার হাজার শতবর্ষী গাছ কেটে ফেলার সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে একাত্ম হয়ে প্রতিবাদ জানিয়েছে বাংলাদেশের ১৯টি পরিবেশেবাদী ও সামাজিক সংগঠন।
এই সিদ্ধান্তকে একটি চক্রের ‘লুটপাটের মওকা’ অভিহিত করে গাছগুলো রক্ষা করেই মহাসড়কটির উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনা (ডিপিপি) সংশোধনের দাবি জানিয়েছেন তাঁরা। মঙ্গলবার পৃথক দুটি কর্মসূচির মাধ্যমে এমন দাবি জানায় সংগঠনগুলো।
তবে অব্যাহত প্রতিবাদ সত্ত্বেও ঐতিহ্যবাহী এসব গাছ কেটেই মহাসড়কটি সম্প্রসারণ হবে বলে জানিয়েছেন পরিকল্পনা মন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল।
মঙ্গলবার রাজধানীর শেরে বাংলা নগরে এনইসি সম্মেলন কক্ষে অনুষ্ঠিত এক সভা শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “গাছ কেটেই যশোর রোড সম্প্রসারণ করা হবে, তা না হলে রাস্তার জন্য যে পরিমাণ জমি প্রয়োজন তা কোথায় পাব?”
তবে সড়ক সম্প্রসারণের পর আবারও গাছ লাগানো হবে বলে আশ্বাস দেন মুস্তফা কামাল।
“যশোর রোডটি এশিয়ান হাইওয়ের অংশ হওয়ায় সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এর গুরুত্বও বাড়ছে৷ তারই প্রেক্ষিতে সড়কটিকে চার লেনে পরিণত করার কাজ হাতে নেওয়া হয়েছে৷ ভবিষ্যতে ছয় লেনও হতে পারে৷ গাছ রেখে যা কোনোভাবেই করা সম্ভব নয়,” বেনারকে বলেন সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের অতিরিক্ত সচিব মোহাম্মদ বেলায়েত হোসেন।
“তাই এখনই আমরা দু'পাশের গাছগুলো কেটে ফেলার সিদ্ধান্ত নিয়েছি৷ তা ছাড়া পুরোনো গাছ থাকলে দুর্ঘটনার ঝুঁকিও বাড়ে,” বলেন তিনি।
যশোর থেকে বেনাপোল পর্যন্ত এই মহাসড়কের দৈর্ঘ্য প্রায় ৩৮ কিলোমিটার। ঐতিহাসিকভাবে যশোর রোড হিসেবে পরিচিত এই সড়ক দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের সময় লাখ লাখ শরণার্থী ভারতে গিয়ে আশ্রয় নেন। আর তা দেখেই মার্কিন কবি অ্যালেন গিন্সবার্গ লিখেছিলেন তাঁর বিখ্যাত ‘সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড’ কবিতাটি।
এই মহাসড়কটি মূলত যশোর থেকে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কলকাতা পর্যন্ত বিস্তৃত। ব্রিটিশ শাসনামলে যশোর বিমানঘাঁটির সঙ্গে কলকাতার যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নতি করার জন্য আধুনিকভাবে যশোর রোড নির্মাণ করা হয়। সে সময়ই রাস্তার দু’পাশে অনেক গাছ লাগানো হয়।
সড়ক ও জনপথ বিভাগের হিসেব অনুযায়ী এই রাস্তার দু’ধারে দুই হাজার তিন শ ১২টি গাছ রয়েছে। যার দু’শর বেশি গাছের বয়স এক শ ৭০ বছরেরও বেশি।
গত ৬ জানুয়ারি যশোর জেলা প্রশাসকের সম্মেলন কক্ষে জেলা প্রশাসক আশরাফ উদ্দিনের সভাপতিত্বে ‘যশোর-বেনাপোল মহাসড়ক যথাযথ মানের ও প্রশস্ততায় উন্নীতকরণ প্রকল্পের আওতায় রাস্তার দুই পার্শ্বে গাছসমূহ অপসারণের বিষয়ে’ এক মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হয়।
এই মহাসড়কটি চার লেনে উন্নীতকরণের জন্য ইতিমধ্যে দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে বলে সভায় জানানো হয়। এর দুই পাশে নতুন-পুরোনো গাছগুলোকে রেখে মহাসড়ক চার লেন করা সম্ভব না উল্লেখ করে জনস্বার্থে গাছগুলো কাটতে হবে বলেও উল্লেখ করা হয়।
এর আগে গত বছরও এই মহাসড়কের উন্নয়নের জন্য দু’পাশের গাছগুলো কাটার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। বিভিন্ন মহলের জোর আপত্তির প্রেক্ষিতে ২০১৭ সালের ১৩ জুলাই কোনো গাছ না কেটেই যশোর-বেনাপোল মহাসড়কটি পুনর্নির্মাণের সিদ্ধান্ত জানায় সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়। তবে বছর না ঘুরতেই পূর্বের সিদ্ধান্তে ফিরে এসেছে কর্তৃপক্ষ।
‘আত্মধ্বংসী সিদ্ধান্ত’
মঙ্গলবার রাজধানীর ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির গোলটেবিল মিলনায়তনে ‘উন্নয়নের নামে যশোর রোডের মুক্তিযুদ্ধ, প্রকৃতি ও ঐতিহ্যবাহী শতবর্ষী বৃক্ষ নিধনের সিদ্ধান্ত বাতিলের দাবিতে’ সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে পরিবেশবাদী সংগঠন- বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা), তরুপল্লব, নাগরিক উদ্যোগ, ডব্লিউবিবি ট্রাস্ট, ব্লু প্লানেট ইনিশিয়েটিভ ও গ্রীন ভয়েস।
সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে তরুপল্লবের সাধারণ সম্পাদক মোকাররম হোসেন বলেন, “উন্নয়নের জন্য যশোর রোডের শতবর্ষী গাছ কেটে ফেলার সিদ্ধান্ত হবে নিতান্তই আত্মধ্বংসী। পরিবেশগত প্রভাব বিবেচনা করে উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণ জরুরি হলেও প্রতিটি ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বারবার উপেক্ষিত হচ্ছে।”
তাঁর অভিযোগ, দীর্ঘ দিন ধরে গাছ লুট করছে সড়ক ও বন বিভাগের কর্মকর্তা, প্রশাসক, পুলিশ, রাজনীতিক মিলে গড়ে ওঠা একটি চক্র। সম্প্রসারণের নামে যশোর-বেনাপোল মহাসড়কের এই বৃক্ষনিধন এমন অশুভ চক্রেরই লুটপাটের বিরাট এক মওকা।
যশোর রোডের গাছের ওপর একটি তথ্যচিত্র উপস্থাপন করে বাপার যুগ্ম সম্পাদক ইকবাল হাবিব জানান, যশোর থেকে কলকাতা পর্যন্ত ৭৮ কিলোমিটার এই সড়কের গাছগুলো ৯ লাখ ১২ হাজার বর্গফুট জায়গাজুড়ে ছায়া দিচ্ছে। বনভূমির আকারে থাকলে গাছগুলো ৩৬ হাজার হেক্টরের বনের সমপরিমাণ হতো।
আলাপকালে এই স্থপতি বেনারকে বলেন, “সরকার সড়কটির দু’পাশে ৫০ ফুট করে জায়গা অধিগ্রহণ করে রেখেছে। তাই গাছ না কেটেও সড়কটি সম্প্রসারণের সুযোগ নেই, সে তথ্য একেবারেই অগ্রহণযোগ্য।”
যশোর সড়ক ও জনপদ বিভাগ সূত্রের বরাতে ইকবাল হাবিব বলেন, “এখনই চার লেন না করে ৭ দশমিক ৩ মিটার প্রস্থে সড়কটি ১২ দশমিক ৩ মিটার করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। দুই পাশে এক মিটার করে ফাঁকা থাকায় মূলত সড়কটি ৩ মিটার বাড়বে। আর মাত্র তিন মিটার সম্প্রসারণের জন্য হাজার হাজার গাছ কাটা একেবারেই অযৌক্তিক।”
সংবাদ সম্মেলনে গাছ কেটে সড়ক উন্নয়ন পরিকল্পনার সঙ্গে জড়িত কর্মকর্তাদের শাস্তির দাবি জানানো হয়।
মঙ্গলবার জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে মানববন্ধন করে পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনসহ (পবা) ১৯টি পরিবেশবাদী ও সামাজিক সংগঠন। সেখানেও এক সপ্তাহের মধ্যে গাছ কাটার সিদ্ধান্ত বাতিলের পাশাপাশি প্রকল্পের দরপত্র কার্যক্রম বন্ধের এবং মহাসড়কটির উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনা সংশোধনের দাবিও জানানো হয়।
এ প্রসঙ্গে পবার সাধারণ সম্পাদক মো. আবদুস সোবহান বেনারকে বলেন, “মুক্তিযুদ্ধসহ নানা ঐতিহাসিক ঘটনার সাক্ষী গাছগুলো রক্ষা আমাদের কর্তব্য। তা ছাড়া এ গাছ কাটা পড়লে পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যেরও অপূরণীয় ক্ষতি হবে।”
“তাই গাছগুলোকে রেখেই যশোর রোডের সম্প্রসারণ করা হোক,” বলেন তিনি।
তবে পরিকল্পনা মন্ত্রী মুস্তফা কামাল সাংবাদিকদের বলেন, “আমরা সড়কটি সম্প্রসারণ করেই গাছ লাগাতে পারব। এত পরিবেশের ক্ষতি পূরণ হবে। আর আবেগ দিয়ে কিছু হয় না, গাছও চিরজীবন বেঁচে থাকে না। এটাও একদিন বিদায় নেবে।”