যশোর রোডের গাছ কাটা যাবে না: হাইকোর্ট
2018.01.18
ঢাকা

যশোর-বেনাপোল জাতীয় মহাসড়কে (যশোর রোড) মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি বহনকারী হাজার হাজার গাছ কাটার সিদ্ধান্তের ওপর ছয় মাসের স্থিতাবস্থা জারি করেছে উচ্চ আদালত। ফলে পরিবেশবাদীদের দাবিতে না হলেও আদালতের নির্দেশে এসব গাছ কাটার সিদ্ধান্ত আপাতত বাদ দিতে হচ্ছে কর্তৃপক্ষকে।
বৃহস্পতিবার এ বিষয়ে স্থগিতাদেশ দেওয়ার পাশাপাশি গাছ কাটার সিদ্ধান্তকে কেন বেআইনি ঘোষণা করা হবে না তা জানতে আদালত রুল জারি করে সরকারের ব্যাখ্যা চেয়েছে। একই সঙ্গে চার লেনে উন্নীত করার ক্ষেত্রে গাছগুলো সংরক্ষণ করে বিকল্প হিসেবে সংশোধিত প্রকল্প প্রস্তুত করতে কেন নির্দেশ দেওয়া হবে না, তাও জানতে চেয়েছে আদালত।
হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের পক্ষে রিট আবেদনটি করেন আইনজীবী মনজিল মোরসেদ।
রায়ের পর তিনি বেনারকে বলেন, “আদালত যশোর রোডের হাজার হাজার গাছ কাটার ক্ষেত্রে ছয়মাসের স্থিতাবস্থা দিয়েছেন। যার ফলে গাছগুলো যে অবস্থায় আছে সে অস্থায় থাকবে। কাটা যাবে না।”
মনজিল মোরসেদ বলেন, “দেখুন, সংবিধানের পরিবেশ সংরক্ষণ আইন অনুসারে পরিবেশের সংরক্ষণ করা সরকারের দায়িত্ব। কিন্তু যশোর-বেনাপোল মহাসড়কে চার লেন তৈরির ঘোষিত প্রকল্পে পরিবেশ সংরক্ষণে সরকারকে নিষ্ক্রিয় দেখা যাচ্ছে।”
“সরকারের সেই নিষ্ক্রিয়তাকে চ্যালেঞ্জ করে ও এ মহাসড়কের গাছগুলোর ঐতিহ্যগত দিক তুলে ধরে আমরা রিট আবেদনটি করেছিলাম,” বলেন এই আইনজীবী।
তবে আদালত গাছ কাটার ওপর স্থিতাবস্থা বজায় রাখার নির্দেশনা দিলেও উন্নয়ন প্রকল্প চলবে বলে সাংবাদিকদের জানান ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল এস এম মনিরুজ্জামান।
এদিকে আদালতের এ রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন পরিবেশবাদীরা।
“অত্যন্ত সময়োপযোগী নির্দেশনা দিয়েছেন। এখন আমরা আশা করব সড়ক ও জনপথ বিভাগ মহাসড়কটির উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনা সংশোধন করে অর্থাৎ গাছগুলো রেখে রাস্তা সম্প্রসারণের কাজ এগিয়ে নেবে,” বেনারকে বলছিলেন পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের (পবা) সাধারণ সম্পাদক মো. আবদুস সোবহান।
পবা সাধারণ সম্পাদক বলেন, “আইন অনুযায়ী এ ধরনের প্রকল্প নেওয়ার আগে অবস্থানগত ছাড়পত্র, পরিবেশগত প্রভাব সমীক্ষা (ইআইএ) এবং গাছ কাটার জন্য আলাদা অনুমোদন নিতে হয়। অথচ সড়ক সম্প্রসারণের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এর কিছুই নেয়নি। সুতরাং বলা যেতে পারে গাছ কাটার অনুমোদনই তাদের ছিল না, আর এখন তো নেই-ই।”
যশোর থেকে বেনাপোল পর্যন্ত এই মহাসড়কের দৈর্ঘ্য প্রায় ৩৮ কিলোমিটার। ঐতিহাসিকভাবে যশোর রোড হিসেবে পরিচিত এই সড়ক দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের সময় লাখ লাখ শরণার্থী ভারতে গিয়ে আশ্রয় নেন। আর তা দেখেই মার্কিন কবি অ্যালেন গিন্সবার্গ লিখেছিলেন তাঁর বিখ্যাত ‘সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড’ কবিতাটি। তার ভিত্তিতে রচিত গান মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবান স্মারক হিসেবেও বিবেচিত।
এই মহাসড়কটি মূলত যশোর থেকে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কলকাতা পর্যন্ত বিস্তৃত। ব্রিটিশ শাসনামলে যশোর বিমানঘাঁটির সঙ্গে কলকাতার যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নতি করার জন্য আধুনিকভাবে যশোর রোড নির্মাণ করা হয়। সে সময়ই রাস্তার দু’পাশে অনেক গাছ লাগানো হয়।
সড়ক ও জনপথ বিভাগের হিসেব অনুযায়ী এই রাস্তার দু’ধারে দুই হাজার তিন শ ১২টি গাছ রয়েছে। যার দু’শর বেশি গাছের বয়স এক শ ৭০ বছরেরও বেশি।
সম্প্রসারণ ও উন্নয়নের জন্য বেনাপোল স্থলবন্দর থেকে যশোর পর্যন্ত এ সড়কের দু’পাশে থাকা এসব গাছ কেটে ফেলার সিদ্ধান্ত নেয় স্থানীয় প্রশাসন। যা নিয়ে গত কিছুদিন ধরেই বিতর্ক চলছিল।
অব্যাহত প্রতিবাদের মধ্যেই পরিকল্পনা মন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেছিলেন এসব গাছ কেটেই মহাসড়কটি সম্প্রসারণ হবে।
তবে বৃহস্পতিবার আলাপকালে মনজিল মোরসেদ বলেন, “পরিবেশের প্রধান উপাদান গাছ। এই গাছ আমাদের জীবন ধারণের সঙ্গে গাছ ওতপ্রোতভাবে জড়িত। অথচ যশোর-বেনাপোল মহাসড়ক সম্প্রসারণ করতে গিয়ে যদি সেই গাছই কেটে ফেলা হয়, তাহলে পরিবেশের মারাত্মক বিপর্যয় ঘটবে।”
“যশোর রোডের দুপাশে শতবর্ষী গাছগুলো আমাদের ঐতিহ্যে পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশের অন্য কোথাও এমনটি দেখা যায় না। তাই এগুলো সংরক্ষণ করা প্রয়োজন,” বলেন তিনি।
যশোর রোডের পশ্চিমবঙ্গ অংশে পেট্রাপোল থেকে কলকাতা পর্যন্ত সড়কটিও চার লেন হচ্ছে। সেখানেও গাছ কাটার ওপর কলকাতা হাইকোর্টের স্থগিতাদেশ রয়েছে। সীমান্ত এলাকায় দুই কিলোমিটার রাস্তায় গাছগুলো অক্ষত রেখেই চার লেনের কাজ সম্পন্ন হয়েছে।