১০০ দিনে উচ্ছেদ করা হবে ৫০০ ইটভাটা
2024.01.24
ঢাকা

আগামী তিন থেকে চার মাসের মধ্যে ঢাকার চারপাশের জেলাগুলো থেকে অন্তত ৫০০ ইটভাটা উচ্ছেদের ঘোষণা দিলেন আওয়ামী লীগ সরকারের নয়া পরিবেশমন্ত্রী সাবের হোসেন চৌধুরী। গত মেয়াদে পরিবেশ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি ছিলেন জনাব চৌধুরী। রাজধানী ঢাকার বায়ুমানের উন্নয়ন ঘটাতে তিনি এই উচ্ছেদের উদ্যোগ নিয়েছেন।
বুধবার সচিবালয়ে ফরাসি রাষ্ট্রদূত ম্যারি মাসদুপুইয়ের সঙ্গে বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের এ কথা জানান সাবের হোসেন ।
পরিবেশ অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের ভাষ্য, শীতকালে ঢাকা মহানগরীর বায়ুমান উন্নয়নে ১২০ ফুট উচ্চতার চিমনিযুক্ত ইটভাটা বন্ধ করা দরকার। ইটভাটার ধোঁয়া রাজধানীর বায়ু দূষণের অন্যতম কারণ।
পরিবেশমন্ত্রীর এই ঘোষণাকে ‘ইতিবাচক রাজনৈতিক সদিচ্ছা’ আখ্যা দিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক আব্দুস সালাম বুধবার বেনারকে বলেন, “পরিবেশমন্ত্রী শিক্ষিত মানুষ। অনেক দিন থেকে তিনি ঢাকার বায়ু দূষণ বন্ধে কঠোর হওয়ার পরামর্শ দিয়ে আসছেন।”
অধ্যাপক আব্দুস সালাম বলেন, “মনে রাখতে হবে যে, ইটভাটাই বায়ু দুষণের প্রধান কারণ নয়। ইটভাটা সর্বোচ্চ ১৫ ভাগ দায়ী। ঢাকায় বায়ু দুষণের অন্যতম কারণ হলো বায়োমাস পোড়ানো ও যানবাহনের কালো ধোঁয়া। সেগুলোর ব্যাপারে ব্যবস্থা না নিলে শুধু ইটভাটার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়ে কোন লাভ হবে না।”
উল্লেখ্য, বায়োমাস প্রধানত কার্বন ও হাইড্রোজেন দ্বারা গঠিত। বায়োমাস বলতে সেইসব জৈব পদার্থকে বোঝায় যাদের শক্তিতে রূপান্তর করা যায়। জৈব পদার্থসমূহ যেগুলো বায়োমাস শক্তির উৎস হিসেবে ব্যবহার করা হয় সেগুলো হলো; গাছ-গাছালি, জ্বালানি কাঠ, কাঠের বর্জ্য, শস্য, ধানের তুষ ও কুড়া, লতা-পাতা, পশুপাখির মল ইত্যাদি । তিনি বলেন, “আমার মনে হয়, সরকার বায়ু দূষণের উৎস সম্পর্কে অবহিত এবং ভবিষ্যতে সুনির্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনা নিয়ে সরকার ঢাকার বায়ুমান উন্নয়নে ব্যবস্থা নেবে,” যোগ করেন তিনি।
সালাম আরও বলেন, “ইটভাটার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার পাশাপাশি দেশে ক্রমবর্ধমান ইটের চাহিদা কীভাবে পূরণ হবে সে বিষয়ে সরকারকে বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ নিতে হবে।”

পরিবেশ অধিদপ্তরের বায়ুমান শাখার পরিচালক জিয়াউল হক বুধবার বেনারকে বলেন, ঢাকা ও এর পাশের চারটি জেলা—নারায়ণগঞ্জ, মানিকগঞ্জ, মুন্সিগঞ্জ ও নরসিংদীতে বর্তমানে এক হাজার ২০০ ইটভাটা রয়েছে, যেগুলোর মধ্যে কমপক্ষে শতকরা ৪০ শতাংশ অবৈধ। এগুলো ১২০ ফুট উচ্চতার চিমনিযুক্ত ইটভাটা, যা বায়ুমান খারাপ করে। এছাড়া, জিকজ্যাক চিমনি সম্বলিত ইটভাটাও বায়ু দূষণ করে। এগুলো বন্ধ করা দরকার।
জিয়াউল হক বলেন, “২০১২ সালে বিশ্বব্যাংকের এক গবেষণায় দেখা গেছে, ঢাকার বায়ু দূষণের জন্য ইটভাটা শতকরা ৫৮ শতাংশ দায়ী। ২০২২ সালের আরেক গবেষণায় দেখা যায়, ঢাকার বায়ু দূষণে ইটভাটার ভূমিকা কমে ১৩ শতাংশ হয়েছে।”
“তবে পরিবেশ অধিদপ্তর মনে করে ইটভাটা ১৩ শতাংশের বেশি দূষণ করে থাকে। সে কারণে আমরা পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে একটি আলাদা সমীক্ষা করব,” জানান তিনি।
দেশে সাত হাজারের বেশি ইটভাটা রয়েছে জানিয়ে জিয়াউল হক বলেন, “নির্মাণ কাজে ইটের চাহিদা বাড়ছে। অল্প পরিবহন ব্যয়ে বাণিজ্যিক সম্ভাবনা তৈরি হওয়ায় ঢাকার পাশে আশুলিয়া, সাভার, টঙ্গী, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ, মানিকগঞ্জ ও নরসিংদীতে গড়ে উঠেছে শত শত ইটভাটা। ”
তিনি বলেন, চাষযোগ্য মাটির উর্বর উপরিভাগের মাটি ব্যবহার করে কম খরচে অক্টোবর থেকে এপ্রিল মাস পর্যন্ত প্রস্তুত করা হয় ইট। আইন অমান্য করে জ্বালানি হিসেবে পোড়ানো হয় গাছ। তবে অধিকাংশ ইটভাটায় কয়লা ব্যবহার করা হয়। ফলে বাতাসে সালফারসহ বিভিন্ন দূষণকারী পদার্থ নির্গত হয়। কয়লার ছাই কৃষি জমিতে পড়ে ফসলের ক্ষতি করে। অন্যদিকে জমির উপরিভাগ তুলে ফেলায় কৃষি উৎপাদন কমে যায়।
জিয়াউল হক বলেন, “বায়ু দূষণ ঠেকাতে ও কৃষি জমির উর্বরতা রক্ষায় মাটি পুড়িয়ে ইট তৈরি ধীরে ধীরে বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। বালু ও সিমেন্ট দিয়ে ব্লক ইট ব্যবহার জনপ্রিয় করা হচ্ছে। আমাদের দেশে প্রচুর বালু রয়েছে, সিমেন্ট উৎপাদনেও আমরা স্বয়ংসম্পূর্ণ।”
সরকারের গত মেয়াদে জাতীয় সংসদে পরিবেশ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি থাকার সময় সাবের হোসেন চৌধুরী ঢাকার বায়ুমান উন্নয়নে দূষণকারী ইটভাটা বন্ধে সরব ছিলেন। তবু ইটভাটা বন্ধ করা যায়নি। ব্লক ইট ব্যবহারের সুপারিশ করেও আশানুরূপ ফল মেলেনি।
বাংলাদেশ ইট প্রস্তুতকারী মালিক সমিতির সাবেক সভাপতি খলিলুর রহমান বেনারকে বলেন, অবৈধ ইটভাটা বন্ধ করলে সমিতির কোনো আপত্তি নেই। তবে বৈধভাবে এবং পরিবেশসম্মত উপায়ে যারা ইটভাটা পরিচালনা করছেন, তারা যেন হয়রানির শিকার না হন।
ঢাকার বায়ুমান খারাপে এগিয়ে
আন্তর্জাতিক বায়ুমান অনুযায়ী শীতকালে ঢাকার বায়ুমান কখনও কখনও বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে খারাপ থাকে। গত মঙ্গল ও বুধবার বিশ্বের একশটি শহরের মধ্যে ঢাকার বায়ুমান খারাপের দিক থেকে পঞ্চম অবস্থানে ছিল।
বায়ুদূষণের দিক থেকে প্রথম ও দ্বিতীয় স্থানে ছিল ভারতের রাজধানী দিল্লি ও বসনিয়া-হার্জেগোভিনার রাজধানী সারায়েভো।
বেসরকারি স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটির বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্রের (ক্যাপস) বিশ্লেষণ অনুযায়ী, ঢাকায় বায়ুদূষণ বাড়ছেই। ২০২৩ সাল ছিল আট বছরের মধ্যে সবচেয়ে দূষিত বায়ুর বছর। ২০২৩ সালে বায়ুমান সূচকে ঢাকার গড় নম্বর (স্কোর) ছিল ১৭১, যা আগের বছর (২০২২) ছিল ১৬৩।
সরেজমিনে ঢাকা শহরের উত্তরা থেকে মতিঝিল এলাকায় আসা যাওয়ার পথে দেখা যায়, পথচারী, যানবাহনে চলাচল করা মানুষ, হকার, আশপাশের দোকানপাট, মার্কেটের মানুষেরা ধুলা নিয়ে বিপাকে। গাছপালাগুলো ধুলার আবরণে ঢাকা পড়েছে।
ঢাকা সিটি করপোরেশন মাঝেমধ্যে পানি ছিটিয়ে ধুলা কমানোর চেষ্টা করলেও তা মোটেও যথেষ্ট
নয়। শুষ্ক মৌসুমে ঢাকার বাসিন্দাদের একটি বড় অংশ শ্বাসকষ্টসহ নানা রোগে কষ্ট পাচ্ছেন।
উল্লেখ্য, ২০০১ সালে সরকার গঠন করার পরে বিএনপি সরকারের পরিবেশমন্ত্রী শাহজাহান সিরাজ পরবর্তী ১০০ দিনের মধ্যে বাংলাদেশ থেকে পরিবেশ দূষণকারী পলিথিন ব্যাগ বন্ধের ঘোষণা দেন এবং বন্ধ করতে সফলও হন।
তবে কয়েক বছর পর সেই অর্জন ম্লান হয়ে যায়। সেই নিষেধাজ্ঞা এখনো বহাল আছে। তবে গত দুই দশকে পলিথিন ব্যাগের ব্যবহার বেড়েছে কয়েক গুণ।