স্থানান্তরকে কেন্দ্র করে চামড়া শিল্পে বিপর্যয়ের আশঙ্কা

জেসমিন পাপড়ি
2017.03.15
ঢাকা
হাজারীবাগ থেকে চামড়া সরিয়ে নিচ্ছে ট্যানারিগুলো। হাজারীবাগ থেকে চামড়া সরিয়ে নিচ্ছে ট্যানারিগুলো। মার্চ ১৪, ২০১৭।
বেনার নিউজ

প্রায় এক যুগ ধরে আইনের মারপ্যাঁচে টিকে থাকার পর রাজধানীর হাজারীবাগ এলাকায় অবস্থিত ট্যানারিগুলোকে সরতেই হচ্ছে। গত ৬ মার্চ উচ্চ আদালত এগুলো বন্ধ করতে চূড়ান্ত নির্দেশ দেওয়ার পর কিছু প্রতিষ্ঠান তড়িঘড়ি করে নতুন শিল্পনগর সাভারে স্থানান্তর করছে।

এদিকে নতুন শিল্পাঞ্চলে অবকাঠামোগত উন্নয়ন শেষ না হওয়ায় সেখানে উৎপাদনে যেতে পারছে না ট্যানারিগুলো। ফলে সাময়িকভাবে উৎপাদন বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছেন ট্যানারি মালিকদের কেউ কেউ।

এ অবস্থায় ট্যানারি শিল্পে বিপুল আর্থিক ক্ষতির আশঙ্কা করছেন মালিকেরা। এ ছাড়া কর্মহীন হয়ে পড়ার আশঙ্কায় রয়েছেন এই শিল্পের সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত শ্রমিকেরা।

বিলিয়ন ডলার ক্ষতির আশঙ্কা

আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী পরিবেশ অধিদপ্তর হাজারীবাগের চামড়া কারখানাগুলোর গ্যাস-বিদ্যুৎ সংযোগ এক সপ্তাহের মেধ্য কেটে দেবে।

এমন অবস্থায় মালিকেরা বলছেন, বর্তমানে হাজারীবাগের কারখানাগুলোতে প্রায় ৪০০ মিলিয়ন ডলারের সমপরিমাণ পণ্যের অর্ডার রয়েছে। এই মুহূর্তে ট্যানারিগুলো বন্ধ হলে অর্ডার অনুযায়ী উৎপাদন সম্ভব হবে না। এ ছাড়া দেশের রপ্তানিমুখী জুতা কারখানাগুলোর রপ্তানিও বন্ধ হয়ে যাবে। এতে মোট ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়াবে প্রায় এক বিলিয়ন ডলার।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি শাহীন আহমেদ বেনারকে বলেন, “আমরা বিদেশে রপ্তানির পাশাপাশি দেশের ফিনিশড লেদার গুডস প্রস্তুতকারীদেরও চামড়া সরবরাহ করি। হাজারীবাগে কারখানাগুলো বন্ধ হয়ে গেলে বর্তমানে যে চার শ মিলিয়ন ডলারের বিদেশি অর্ডার আছে, তা বাতিল হয়ে যাবে। চামড়া না পেয়ে দেশের প্রায় দেড়শ’র মত রপ্তানিমুখী জুতা কারখানাও বিপদে পড়বে। সব মিলিয়ে ক্ষতির পরিমাণ গিয়ে ঠেকবে এক বিলিয়ন ডলারের মতো।”

এদিকে সাভারের চামড়া শিল্পপল্লীতে এখনো গ্যাসের সংযোগ দেওয়া হয়নি জানিয়ে তিনি বলেন, “আমরা সেখানেও উৎপাদনে যেতে পারব না। তাই লে অফের বিকল্প দেখছি না ।”

সাভারে নতুন শিল্পাঞ্চলে এখনো কারখানা নির্মাণের কাজ চলছে। মার্চ ১৪, ২০১৭।
সাভারে নতুন শিল্পাঞ্চলে এখনো কারখানা নির্মাণের কাজ চলছে। মার্চ ১৪, ২০১৭।
[বেনার নিউজ]
প্রস্তুত নয় সাভার

সাভারে হেমায়েতপুরের শিল্পাঞ্চল ঘুরে ও মালিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, স্থানান্তরিত হওয়া কারখানাগুলো এখনো গ্যাস সংযোগ পায়নি। এমনকি বরাদ্দকৃত জমিও রেজিস্ট্রি করে দেওয়া হয়নি। ফলে কারখানা তৈরিতে ব্যাংক ঋণ পেতেও বেগ পেতে হচ্ছে তাঁদের। এ ছাড়া কেন্দ্রীয় বর্জ্য শোধানাগার (সিইটিপি) নির্মাণকাজ শেষ না হওয়ায় সাভারের ধলেশ্বরী নদী ও এর আশপাশ বুড়িগঙ্গার মতোই দূষণের শিকার হচ্ছে।

এ প্রসঙ্গে হাজারীবাগের শাহজালাল লেদার কমপ্লেক্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক অতুল প্রসাদ গুপ্ত বেনারকে বলেন, “আমাদের নিয়ে যাওয়া হয়েছে ধলেশ্বরী নদীর পাড়ে। সেখানে বিল্ডিং করতে দেওয়া হয়েছে গর্তের মধ্যে। যেখানে কোটি টাকা খরচ করেও বিল্ডিং নির্মাণ করা যাচ্ছে না।”

এম বি লেদার কোম্পানির পরিচালক মো. রিন্টু বেনারকে বলেন, “সাভারের চামড়া শিল্পনগরে জমি এখনো চূড়ান্তভাবে রেজিস্ট্রি করে দেওয়া হয়নি। ফলে নতুন কারখানা নির্মাণের জন্য ব্যাংক ঋণ চাইতে গেলেও পাই না।”

এ বিষয়ে শিল্প মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া বেনারকে বলেন, “মালিকরা সব টাকা পরিশোধ করলে এখনই জমির নিবন্ধন দেওয়া হবে। তবে তাঁরা কিছু টাকা মওকুফের যে আবেদন করেছে সে বিষয়ে প্রস্তাব রাখা হয়েছে। শিগগিরই এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত আসবে।”

এ ছাড়া শিগগিরই কারখানাগুলোতে গ্যাসের সংযোগ দেওয়া হবে বলেও জানান মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া।

অন্যদিকে সাভারের স্থানীয় বাসিন্দা ওমর ফারুক বেনারকে বলেন, “ট্যানারির বর্জ্য শোধন করে নদীতে ফেলার কথা। কিন্তু সেটি হচ্ছে না। অল্প কিছুদিনেই নদীর পানি কালো হয়ে মাছ মরে যাচ্ছে। দুর্গন্ধে স্থানীয়দের শ্বাসকষ্ট দেখা দিয়েছে।”

এ প্রসঙ্গে কেন্দ্রীয় বর্জ্য শোধনাগার বা সিইটিপি’র নির্মাণ কাজের দায়িত্বে থাকা প্রকৗশলী একরামুল শেখ জানান, চারটি ক্যাটাগরিতে সিইটিপি নির্মাণ করা হচ্ছে। বেশির ভাগ কাজ হয়ে গেছে। অর্থ সংকটের কারণে আপাতত কাজ বন্ধ রয়েছে। অর্থ পেলে কয়েক মাসের মধ্যেই সিইটিপি নির্মাণ কাজ শেষ হবে।

ঢাকার ‘প্রাণ’ বুড়িগঙ্গা নদীকে বর্জ্যের বিষাক্ত প্রভাব থেকে মুক্ত করতে হাজারীবাগের ট্যানারি শিল্প স্থানান্তর করার সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। ২০০৩ সালে ১ হাজার ৭৯ কোটি টাকা ব্যয়ে সাভারের হেমায়েতপুরের হরিণধরা গ্রামে প্রায় ১৯৯ একর জমিতে চামড়া শিল্পনগর গড়ে তোলার কাজ শুরু হয়।

প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থা বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন (বিসিক) এর তথ্য অনুযায়ী, সাভার শিল্পনগরীতে ১৫৫টি প্লটের মধ্যে ভবন নির্মাণ হয়েছে ৮৬টি তে। কাজ চলছে আরও ৩৫টির। স্থায়ী বিদ্যুৎ সংযোগ পেয়েছে ৩৫টি ট্যানারি, আর বিদ্যুৎ সংযোজনের জন্য টাকা জমা দিয়েছে ৬১টি প্রতিষ্ঠান। তা ছাড়া এরই মধ্যে চামড়া প্রক্রিয়াজাতকরণ শুরু করেছে ৩৭টি ট্যানারি।

অন্যদিকে ছোট-বড় মিলিয়ে ১৫৪টি ট্যানারি এখনো হাজারীবাগে রয়েছে।

তবুও সরব হাজারীবাগ

আদালতের নির্দেশের পরও হাজারীবাগে অনেক ট্যানারি চলতে দেখা গেছে। মালিকেরা জানান, হাজারীবাগের কারখানা বন্ধ করতে আদালতের নির্দেশের কথা জানার পরই ক্রেতারা তাঁদের অর্ডারগুলো দ্রুত পেতে চাইছেন। পুরোপুরি বন্ধ হওয়ার আগ পর্যন্ত যতটুকু সম্ভব সেসব অর্ডারের কাজ শেষ করার চেষ্টা করা হচ্ছে।

হাজারীবাগ এলাকা ঘুরে দেখা যায়, বেশির ভাগ ট্যানারির প্রধান দরজা বন্ধ রেখে ভেতরে কাজ করা হচ্ছে। কাঁচা চামড়া প্রক্রিয়াজাতকরণের সকল কার্যক্রম চলছে।

সালমা ট্যানারির কর্মরত একজন শ্রমিক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বেনারকে বলেন, “যত দিন না বিদ্যুৎ, পানি বা গ্যাসের সংযোগ কাটা হবে আমরা আমাদের কাজ চালিয়ে যাব।”

তবে অনেক কারখানাই ইতিমধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে। অনেকে আবার কারখানার মজুত চামড়াগুলো সাভারে নেওয়ার ব্যবস্থা করছেন।

এ বিষয়ে পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক (ঢাকা বিভাগ) ম. আলমগীর বেনারকে বলেন, “আপিল বিভাগের আদেশের কপি সংগ্রহের পরেই হাজারীবাগের কারখানাগুলোর পানি, গ্যাসের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হবে। তখন কার কতটুকু কাজ বাকি আছে এসব দেখা হবে না।”

পরিবেশবাদীরা বলছেন, এখনো হাজারীবাগের ট্যানারি থেকে দৈনিক প্রায় ২২ হাজার ঘনমিটার অপরিশোধিত বর্জ্য বুড়িগঙ্গায় ফেলা হচ্ছে। তাই আদালতের আদেশ মেনে যত দ্রুত সম্ভব কারখানাগুলো সাভারে সরিয়ে নেওয়া প্রয়োজন। তবে সাভারে স্থানান্তর হলে একইভাবে যাতে ধলেশ্বরী নদীও ক্ষতিগ্রস্ত না হয় সে বিষয়টির প্রতিও নজর দিতে বলা হয়েছে।

এ প্রসঙ্গে পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের (পবা) সাধারণ সম্পাদক প্রকৌশলী মো. আবদুস সোবহান বেনারকে বলেন, “প্রায় সাত দশক ধরে এই ট্যানারিগুলো বুড়িগঙ্গা ও এর আশপাশের এলাকাকে ‍দুষিত করে আসছে। এ জন্য তাঁদের আর সুযোগ না দিয়ে উপযুক্ত সিদ্ধান্ত নিয়েছে আদালত। এখন দেখতে হবে একইভাবে সাভারের পরিবেশও ক্ষতিগ্রস্ত না হয়।”

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।