বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঝুঁকিতে দুই কোটি শিশু: ইউনিসেফ

শরীফ খিয়াম
2019.04.05
ঢাকা
190405_Climate_change_1000.jpg উপকূলীয় জেলা পটুয়াখালীর কুয়াকাটা এলাকায় দুই শিশু। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে পটুয়াখালীসহ বাংলাদেশের বিশ জেলার প্রায় দুই কোটি শিশু ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে বলে জানিয়েছে ইউনিসেফ। ২৩ নভেম্বর ২০১৩।
[শরীফ খিয়াম/বেনারনিউজ]

জলবায়ু পরিবর্তনজনিত বন্যা, ঘূর্ণিঝড়সহ বিভিন্ন পরিবেশগত বিপর্যয়ের কারণে বাংলাদেশের ২০ জেলার প্রায় দুই কোটি শিশুর জীবন ও ভবিষ্যত হুমকির মুখে রয়েছে বলে শুক্রবার এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে জাতিসংঘ শিশু তহবিল (ইউনিসেফ)।

“পরিবর্তিত জলবায়ু ইতিমধ্যে তাদের জীবনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে এবং সুন্দর ভবিষ্যতের সম্ভাবনা নষ্ট করেছে,” বলছে সংস্থাটি।

ইউনিসেফের দাবি, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদী বিপজ্জনক পরিণতির মুখোমুখি দাঁড়ানো শিশুদের মধ্যে ৫০ লক্ষাধিকের বয়স পাঁচ বছরের কম।

চরম ঝুঁকিতে থাকা সত্ত্বেও জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় বাংলাদেশ অত্যন্ত দুর্বল বলেও মন্তব্য করা করা হয় প্রতিবেদনে।

এদিকে প্রতিবেদনটি নজরে আসায় জরুরি বৈঠকে বসছে সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলো।

“প্রতিবেদনটি সরকারের নজরে এসেছে। এরই প্রেক্ষিতে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলায় আটটি মন্ত্রণালয় নিয়ে গঠিত কমিটির বৈঠক আহবান করা হয়েছে,” বেনারকে বলেন বাংলাদেশের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী ডা. মো. এনামুর রহমান।

নতুন সরকার গঠনের পর প্রথমবারের মতো মন্ত্রী পর্যায়ের কমিটির এই সভা হচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, “আগামী ৭ এপ্রিল অনুষ্ঠিতব্য ওই সভার পরে এ বিষয়ে সরকারের আনুষ্ঠানিক বক্তব্য জানানো হবে।”

সবচেয়ে ঝুঁকিতে রোহিঙ্গা শিশুরা

ইউনিসেফ বলছে, বাংলাদেশে প্রায় এক কোটি ২০ লাখ শিশু নদীর কাছাকাছি বসবাস করে, যেখানে প্রাণঘাতী বন্যার ঝুঁকি রয়েছে। আরো ৪৫ লাখ শিশু থাকে উপকূলীয় এলাকায়, যেখানে নিয়মিত শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড় আঘাত করে।

এর মধ্যে উপকূলীয় জেলা কক্সবাজারে বসবাসকারী প্রায় পাঁচ লাখ রোহিঙ্গা শিশুর অবস্থা সবচেয়ে নাজুক। ঝড় থেকে নিজেদের রক্ষার জন্য বাঁশ এবং ‘প্লাস্টিক’ (পলিথিন, ত্রিপল) ছাড়া কিছুই নেই তাদের।

দেশের খরা কবলিত এলাকায় ঝুঁকিতে রয়েছে আরো ৩০ লাখ শিশু।

‘অ্যা গ্যাদারিং স্ট্রোম: ক্লাইমেট চেঞ্জ ক্লাউড দ্য ফিউচার অব চিলড্রেন ইন বাংলাদেশ’ শিরোনামের এই প্রতিবেদনের লেখক সাইমন ইনগ্রামের মতে, নিচু স্থলভাগ, ঘন জনসংখ্যা এবং দুর্বল অবকাঠামো বাংলাদেশকে ভয়াবহভাবে দুর্বল করে রেখেছে।

“দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর সংলগ্ন ঝড়-প্রবণ উপকূল থেকে শুরু করে দেশের উত্তরের বন্যা ও খরা-প্রবণ নিম্নভূমি পর্যন্ত জলবায়ু পরিবর্তনের হুমকি রয়েছে,” যোগ করেন তিনি।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জলবায়ু পরিবর্তন সম্পর্কিত দীর্ঘমেয়াদী ঘটনা বাংলাদেশের অজস্র পরিবারকে দরিদ্র ও বাস্তুহারা করছে। যার প্রভাবে শিশুদের শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবার সুযোগও মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে।

এ প্রসঙ্গে প্রতিমন্ত্রী এনামুর বেনারকে বলেন, “জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনা অনুযায়ী আমরা কাজ করে যাচ্ছি। ইতিমধ্যে তিনি বাংলাদেশে কার্বন নিঃসরণ কমিয়ে আনার ঘোষণা দিয়েছেন।”

“সরকার বৃক্ষরোপন অভিযান অব্যাহত রেখেছে। বনায়ন এবং নবায়নযোগ্য জ্বালানী ব্যবহারের মাধ্যমে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। দেশীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে তহবিল সংগ্রহ করা হচ্ছে,” বলেন তিনি।

বাংলাদেশের স্থিতিশীল উন্নতির প্রশংসা করে ইউনিসেফ বলেছে, আগামী প্রজন্মকে বিপদ থেকে বাঁচাতে আরো উদ্ভাবনী কর্মসূচি প্রয়োজন।

যেসব জেলা ঝুঁকিতে

ভোলা, বরগুনা, পটুয়াখালী, পিরোজপুর, কক্সবাজার, নোয়াখালী, টাঙ্গাইল, ফরিদপুর, বাগেরহাট, খুলনা, যশোর, সাতক্ষীরা, নেত্রকোনা, জামালপুর, সিরাজগঞ্জ, রাজশাহী, গাইবান্ধা, নিলফামারী, হবিগঞ্জ এবং সুনামগঞ্জ- এই ২০ জেলার শিশুরা ঝুঁকিতে রয়েছে বলে দাবি ইউনিসেফের।

এর মধ্যে নোয়াখালীতে সর্বোচ্চ ১৭ লাখ ১৮ হাজার ৮৯৩ জন শিশু ঝুঁকির মুখে রয়েছে, যার মধ্যে চার লাখ ৫১ হাজার ৫৪০ জনের বয়স পাঁচ বছরের কম।

গত মাসে বাংলাদেশ সফরকালে ইউনিসেফের নির্বাহী পরিচালক হেনরিয়েটা ফোর বলেন, “জলবায়ু পরিবর্তনে মূলত বাংলাদেশের দরিদ্রতম জনগোষ্ঠীগুলো আক্রান্ত হচ্ছে, যারা নিজেদের শিশুদের যথোপযুক্ত বাসস্থান, খাদ্য, চিকিৎসা ও শিক্ষা দিতে অক্ষম।”

এর আগে গত ফেব্রুয়ারিতে মিউনিখ নিরাপত্তা সম্মেলনের ফাঁকে ‘ক্লাইমেট চেঞ্জ এজ এ সিকিউরিটি থ্রেট’ শীর্ষক এক আলোচনায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব থেকে বিশ্বকে রক্ষায় ধনী দেশগুলোর ‘সদিচ্ছা’ প্রত্যাশা করেন।

বাড়ছে অভ্যন্তরীণ অভিবাসন

ইউনিসেফ বলছে, নদীভাঙন ও নদী প্রবাহে সৃষ্ট বন্যায় বাংলাদেশে প্রতি বছর ৫০ হাজার থেকে দুই লাখ মানুষ বাস্তুহারা হয়। এর জেরে দেশের উপকূলীয় ও মূল ভূখণ্ডের ২৪টি জেলায় ‘অভ্যন্তরীণ জলবায়ু অভিবাসী’ সৃষ্টি হচ্ছে।

এসোসিয়েশন ফর ক্লাইমেট রিফিউজি’র গবেষণার কথা উল্লেখ করে ইউনিসেফ বলছে, দেশে এখন এই ধরনের ৬০ লাখ অভিবাসী রয়েছে।

এছাড়া বিশ্বব্যাংকের বরাত দিয়ে তারা জানায়, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব তীব্র হওয়ার কারণে ২০৫০ সাল নাগাদ অভ্যন্তরীণ অভিবাসীর সংখ্যা এক কোটি ৩৩ লাখে পৌঁছুবে।

বিষয়টি স্বীকার করে প্রতিমন্ত্রী এনামুর বেনারকে বলেন, “আমরা এটাকে দুর্যোগজনিত ‘স্থানচ্যুতি’ বলি। প্রতি বছরই হয়। এবারও আশঙ্কা করছি কমপক্ষে ৪০ হাজার লোক ঘরবাড়ি হারাবে এবং বেশিরভাগই নদীভাঙনের কারণে।”

“তবে ভাঙন রোধে নদীর নাব্যতা ঠিক রাখার জন্য প্রধানমন্ত্রীর প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে কাজ করছে নৌ মন্ত্রণালয়। এছাড়া নদীর পাড় রক্ষায় পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ও সক্রিয়,” বলেন তিনি।

ইউনিসেফের মতে, দরিদ্র বাংলাদেশিরা যেসব কারণে ঘরবাড়ি ছেড়ে অন্যত্র গিয়ে জীবনযাপনের চেষ্টা করতে বাধ্য হয়, জলবায়ু পরিবর্তন তার মধ্যে অন্যতম। এ কারণে প্রচুর মানুষ শহরমুখী হয়। যেখানে শিশুরা ঝুঁকিপূর্ণ ও বিপদজনক শ্রমে জড়ায় বা বাল্যবিয়ের শিকার হয়।

সংস্থাটির বাংলাদেশ প্রতিনিধি এডয়ার্ড বেগবেডার বলেন, “জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে গ্রাম থেকে স্থানান্তরিত হলে শিশুরা কার্যকরভাবে তাদের শৈশব হারায়। তারা শহরে বিপদজ্জনক পরিস্থিতি ও নির্যাতনের মুখোমুখি হয়।”

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।