পরিবেশ দূষণকারী আট শিল্পের ওপর বাড়তি কর চায় মন্ত্রণালয়

রিয়াদ হোসেন
2024.04.18
ঢাকা
পরিবেশ দূষণকারী আট শিল্পের  ওপর বাড়তি কর চায় মন্ত্রণালয় ঢাকার শ্যামপুর এলাকায় বিভিন্ন কারখানার অপরিশোধিত বর্জ্য বুড়িগঙ্গার পানিতে যাচ্ছে। ছবিটি ঢাকার শ্যামপুরের ধলেশ্বর ঘাট থেকে তোলা। ১৮ এপ্রিল ২০২৪
[মেহেদী রানা/বেনারনিউজ]

পরিবেশ দূষণের জন্য যেসব শিল্পপ্রতিষ্ঠান বেশি দায়ী, তাদের ওপর বাড়তি কর আরোপের প্রস্তাব করেছে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক মন্ত্রণালয়।

এ বিষয়ে, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কাছে চিঠি দিয়ে আগামী বাজেটে অন্তত আট ধরনের শিল্পের ওপর বিদ্যমান করের বাইরে বাড়তি পাঁচ শতাংশ আয়কর ও আমদানিতে বাড়তি ১০ শতাংশ শুল্ক আরোপের অনুরোধ জানানো হয়েছে।

এনবিআরের বাজেট সংশ্লিষ্ট বিভাগ গত ১৭ এপ্রিল ওই চিঠি পেয়েছে, যার অনুলিপি বেনারের হাতে এসেছে।

মন্ত্রণালয়ের উপসচিব শেখ মুরাদ হোসেন স্বাক্ষরিত চিঠিতে বলা হয়, “বিদ্যুৎকেন্দ্র, সিমেন্ট, স্টিল মিল, বস্ত্রকল, পাথর ভাঙ্গা প্রতিষ্ঠান, সার কারখানা, বালাইনাশক উৎপাদনকারী, ব্যাটারি শিল্প বায়ু দূষণের জন্য প্রত্যক্ষভাবে দায়ী।  এসব প্রতিষ্ঠানের ওপর স্বাভাবিক হারের চেয়ে অতিরিক্ত পাঁচ শতাংশ আয়কর ও ভ্যাট (যদি সুযোগ থাকে) আরোপ করা যেতে পারে।

“এছাড়া এ ধরনের প্রতিষ্ঠানের আমদানির ক্ষেত্রেও ১০ শতাংশ অতিরিক্ত আমদানি শুল্ক আরোপ করা যেতে পারে,” বলা হয় চিঠিতে।

বাংলাদেশে অধিকাংশ কোম্পানির ওপর ২৭ দশমিক পাঁচ শতাংশ কর আরোপ করা আছে।  আরও পাঁচ শতাংশ কর আরোপ করা হলে তা বেড়ে ৩২ দশমিক পাঁচ শতাংশ হবে।

মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (পরিবেশ অনুবিভাগ) ড. ফাহমিদা খানম বেনারকে বলেন, “দূষণের কারণে মানুষ অসুস্থ হচ্ছে, দেশের ক্ষতি হচ্ছে—এর একটা আর্থিক মূল্য আছে।  যারা দূষণে বেশি দায়ী, তাদের কাছ থেকেই এর বেশি অংশ আসতে হবে।  এ জন্যই আমরা এ প্রস্তাব দিয়েছি।”

গত অর্থবছরে যেসব ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের একাধিক যানবাহন রয়েছে, তাদের ওপর কার্বন করের আদলে বাড়তি প্রতিটি গাড়ির জন্য ৫০ শতাংশ হারে কর আরোপ করা হয়েছে।  এর আগে ২০১৪-১৫ অর্থবছরে পরিবেশ দূষণকারী শিল্প প্রতিষ্ঠানের ওপর বিক্রয় মূল্যের ওপর এক শতাংশ হারে মাশুল (সারচার্জ) আরোপ করা হয়।  তবে বাংলাদেশে দূষণের দায়ে শিল্প প্রতিষ্ঠানের ওপর বর্তমানে বাড়তি কোনো আয়কর নেই।

এনবিআরের সংশ্লিষ্ট বিভাগের একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বেনারকে বলেন, “পরিবেশ দূষণের জন্য শিল্পপ্রতিষ্ঠানের ওপর বাড়তি কর নেই।  তবে যারা দূষণ রোধে কাজ করছে, তাদের জন্য কিছুটা কম হারে কর নেওয়া হচ্ছে।”

মন্ত্রণালয়ের এমন প্রস্তাবকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন বিশেষজ্ঞরা। তাঁরা বলছেন, দূষণকারীদের ওপর বাড়তি কর আরোপ করে যদি তা সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করা যায়, সেটা পরিবেশ দূষণ কমাতে সহায়তা করবে।

পরিবেশ বিশেষজ্ঞ ও স্ট্যামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক কামরুজ্জামান মজুমদার বেনারকে বলেন, “মন্ত্রণালয়ের এ প্রস্তাব বাস্তবায়ন করা হলে পরিবেশ দূষণ কমাতে ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে।  কেননা সারা পৃথিবীতেই পরিবেশ দূষণকারীদের ওপর বাড়তি কর আরোপের এ অনুশীলন স্বীকৃত।”

বাংলাদেশ বিশ্বে বায়ু দূষণে ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর একটি।  গত কয়েক মাস ধরেই ঢাকার বায়ু দূষণ বেড়েছে।  বিশ্বব্যাপী বায়ু দূষণ নিয়ে কাজ করা সুইজারল্যান্ডভিত্তিক প্রতিষ্ঠান এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্সে (আইকিউএয়ার) গত কয়েক মাসে অধিকাংশ দিন ঢাকার অবস্থান শীর্ষে থেকেছে।  বৃহস্পতিবারও ঢাকার অবস্থান ছিল শীর্ষ আট নম্বরে।

বাংলাদেশে বায়ু দূষণে কোন ধরনের শিল্পের দায় কতটা, তার সঠিক তথ্য পাওয়া যায় না।  তবে পরিবেশ সংরক্ষণ বিধিমালায় ৭২ ধরনের শিল্প ও প্রতিষ্ঠানকে লাল শ্রেণিতে রাখা হয়েছে, যেগুলো পরিবেশ দূষণে বেশি দায়ী।  এর মধ্যে মন্ত্রণালয়ের চিহ্নিত আট ধরনের শিল্পও রয়েছে।

বাংলাদেশে কত সংখ্যক শিল্প উচ্চমাত্রার পরিবেশ দূষণে দায়ী, সে পরিসংখ্যান জানতে বেনারের পক্ষ থেকে পরিবেশ অধিদপ্তরের সংশ্লিষ্ট বিভাগে যোগাযোগ করা হয়।  তবে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা এ সংক্রান্ত তথ্য জানাতে পারেননি।

পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় প্রকাশিত সর্বশেষ বার্ষিক প্রতিবেদন অনুসারে, গত ২০২২-২৩ অর্থবছরে পরিবেশ দূষণে দায়ী দুই হাজার ৬৭১টি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ক্ষতিপূরণ ধার্য করা হয়েছে। প্রায় ৫৬ শতাংশই ছিল শিল্পপ্রতিষ্ঠানের বর্জ্য দূষণ সংক্রান্ত।

এর বাইরে ইটভাটা, পাহাড় কাটা, হাসপাতালের বর্জ্য, জাহাজ ভাঙ্গা শিল্পও রয়েছে।

প্লাস্টিক ও পলিথিন উৎপাদনকারী শিল্পেও একই হারে কর ও আমদানি শুল্ক আরোপের পক্ষে মত দিয়েছে পরিবেশ মন্ত্রণালয়।

চিঠিতে বলা হয়, “এসব প্রস্তাব আগামী বাজেটে কার্যকর করা হলে পরিবেশ দূষণ কমবে বলে প্রতীয়মান হয়।”

 

দূষণে যার ভূমিকা বেশি, তার কর তত বেশি হোক

পরিবেশ ও জলবায়ু বিশেষজ্ঞ ড. আইনুন নিশাত বেনারকে বলেন, “বাংলাদেশে কোন ধরনের প্রতিষ্ঠান কী হারে পরিবেশ দূষণ করে, তা এখনো ঠিক করা যায়নি।  কিন্তু যারা দূষণ বেশি করবে, তাদের ওপর বেশি হারে কর বা ক্ষতিপূরণ থাকা উচিত।”

একই মত দিয়েছেন অধ্যাপক কামরুজ্জামান মজুমদার।  তিনি মনে করেন, এই ধরনের কর আদায়ের জন্য সংশ্লিষ্টদের সমন্বয়ে একটি প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো দাঁড় করানো প্রয়োজন।

পরিবেশ দূষণের দায়ে আদায়কৃত কর পরিবেশ উন্নয়নেই ব্যয় করা উচিত মন্তব্য করে তিনি বলেন, “এ খাতের নামে আদায়কৃত অর্থ অন্য খাতে ব্যয় করা হলে উদ্দেশ্য সফল হবে না।”

ফাহমিদা বেনারকে বলেন, “আমরা মন্ত্রণালয় থেকে কেবল প্রস্তাব পাঠিয়েছি।  বাজেটে এটি কার্যকর হলে, কী উপায়ে বাস্তবায়ন করা হবে—তা নিয়ে পরবর্তীতে কাজ করা হবে।  এনবিআর, পরিবেশ অধিদপ্তর ও পরিবেশ মন্ত্রণালয় সমন্বিতভাবে বাস্তবায়নের উপায় ঠিক করতে কাজ করবে।”

 

‘বাড়তি কর আরোপ হলে শিল্প টিকবে না’

পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের প্রস্তাবের প্রতিবাদ জানিয়েছেন দেশের পরিবেশ দূষণের দায়ে অভিযুক্ত শিল্প উদ্যোক্তারা।

বাংলাদেশ স্টিল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের সহসভাপতি মো. শহীদুল্লাহ বেনারকে বলেন, “কোভিড, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, আর দেশের উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে আমাদের শিল্প এমনিতেই ধুঁকছে।  এর মধ্যে নতুন করে পরিবেশের কারণে কর আরোপ করা হলে এই শিল্প টিকবে না, ভেঙে পড়বে। ”

তিনি বলেন, “দেশে শিল্প না টিকলে বেশি দামে পণ্য আমদানি করতে হবে।  আমদানি করে কি চাহিদা পূরণ করা সম্ভব হবে? আমরা এমন প্রস্তাবের প্রতিবাদ জানাই।”

শহীদুল্লাহ সিমেন্ট খাতেরও একজন উদ্যোক্তা।  তিনি বলেন, “পরিবেশের জন্য বাড়তি কর উন্নত দেশের জন্য প্রযোজ্য, কারণ সেখানে উন্নয়ন চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছেছে।  বাংলাদেশ কি সেই পর্যায়ে এখনো পৌঁছেছে?”

সময় এলে আমরাও পরিবেশ সুরক্ষায় কাজ করব উল্লেখ করে তিনি বলেন, “আমাদের সিমেন্ট ও স্টিল খাতের শিল্পগুলো দূষণ কমাতে ইতোমধ্যে কোটি কোটি টাকা ব্যয় করে উন্নত প্রযুক্তি ও যন্ত্রপাতি ব্যবহার করছে।  এর ফলে ধুলা কম হচ্ছে।”

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।