ভার্চুয়াল আদালতের প্রথম আদেশে ডলফিন হত্যা বন্ধের নির্দেশ

জেসমিন পাপড়ি
2020.05.12
ঢাকা
200512_HC_Dolphin_1000.jpg চট্টগ্রামের রাউজান উপজেলার জিয়া বাজার এলাকায় হালদা নদীর তীরে ধারালো অস্ত্রের আঘাতে হত্যা করা একটি ডলফিন। ১৭ মে ২০২০।
[বেনারনিউজ]

দেশের বিচার বিভাগের ইতিহাসে ভার্চুয়াল উপস্থিতিতে শুনানি করে দেওয়া প্রথম আদেশে হালদা নদীতে ডলফিন শিকার এবং হত্যা বন্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দিয়েছে হাইকোর্ট।

এক রিটের শুনানি নিয়ে মঙ্গলবার বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের হাইকোর্ট বেঞ্চ এ আদেশ দেয়। পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য রক্ষায় চট্টগ্রামের হালদা নদীতে ডলফিন হত্যা রোধে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে নির্দেশনা চেয়ে গত সোমবার হাইকোর্টের ওই বেঞ্চে​র কাছে ই-মেইলে রিটটি করেন আইনজীবী এম আব্দুল কাইয়ূম।

“এটা ভার্চুয়াল মাধ্যম ব্যবহার করে দায়ের করা প্রথম রিট। সোমবার ই-মেইলের মাধ্যমে আমি রিটটি করেছিলাম,” বেনারকে বলেন আব্দুল কাইয়ুম।

ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল অমিত তালুকদার বেনারকে বলেন, “আর একটি ডলফিনও যেন কেউ হত্যা না করতে পারে সেজন্য সরকারকে অবিলম্বে ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দিয়েছেন উচ্চ আদালত।”

একই সঙ্গে ডলফিন শিকার বা হত্যা রোধে কী পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে তা ৭২ ঘন্টার মধ্যে ই-মেইলে আদালতকে জানাতে পরিবেশ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক, পরিবেশ অধিদপ্তরের চট্টগ্রাম বিভাগীয় পরিচালক, চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক ও রাউজান উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে বলে জানান অমিত তালুকদার।

অমিত জানান, এই রিটের বিষয়ে পরবর্তী শুনানি হবে আগামী ১৯ মে।

আদালতের এই আদেশকে ইতিবাচক হিসেবে দেখলেও এর বাস্তবায়ন নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন পরিবেশবিদেরা।

বাংলাদেশ পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের নির্বাহী সহ–সভাপতি মো. আব্দুল মতিন বেনারকে বলেন, “পরিবেশ রক্ষায় আদালতের এ ধরনের আদেশ নিঃসন্দেহে আনন্দের। তবে আমরা এখন আর আনন্দিত হই না। কারণ এ ধরনের বহু আদেশই বিভিন্ন সময় আদালত দিয়েছে। কিন্তু সরকার সেসব বাস্তবায়ন করতে পারেনি বা করেনি।”

তিনি বলেন, “আশা করি ডলফিন রক্ষায় আদালতের এই আদেশ সরকার কঠোরভাবে বাস্তবায়ন করে উদাহরণ সৃষ্টি করবে।”

গত ৮ মে চট্টগ্রামের হাটহাজারীর হালদা নদীতে ভাসমান অবস্থায় একটি মৃত ডলফিন পাওয়া যায়, যেটিকে ধারালো অস্ত্রের আঘাতে হত্যা করা হয়। ওই ঘটনার পর ৮ ও ১০ মে ইংরেজি দৈনিক ডেইলি স্টারের অনলাইন সংস্করণে দুটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়, যা যুক্ত করে রিট আবেদনটি করেন কাইয়ুম।

রিটটি শুনানির জন্য নির্ধারণের পর আদালত থেকে ই-মেইলে রাষ্ট্রপক্ষকে রিটের কপি পাঠানো হয় বলে জানান অমিত তালুকদার।

সেই সঙ্গে শুনানির সময় জানিয়ে একটি লিঙ্ক পাঠানো হয়। এই লিঙ্কে ক্লিক করে জুম অ্যাপের মাধ্যমে ভিডিও কনফারেন্স যুক্ত হন সংশ্লিষ্টরা।

অমিত জানান, রিট আবেদনকারী আইনজীবী, রাষ্ট্রপক্ষ এবং বিচারপতি ভিডিও কনফারেন্সে যুক্ত হয়ে শুনানি গ্রহণ করেন।

রিটের ওপর রাষ্ট্রপক্ষে শুনানিতে ছিলেন অ্যার্টনি জেনারেল মাহবুবে আলম, ডেপুটি অ্যার্টনি জেনারেল সমরেন্দ্র নাথ বিশ্বাস ও অমিত তালুকদার।

দুই বছরে মারা গেছে ২৪ ডলফিন

আইনজীবী কাইয়ুম বেনারকে বলেন, গত দুই বছরে হালদা নদীতে ২৪টি ডলফিন মারা গেছে বলে গবেষকেরা জানিয়েছেন। এর মধ্যে বেশিরভাগই হত্যা করা হয়।

পরিবেশবাদীদের বরাত দিয়ে তিনি জানান, ডলফিন খাবারের জন্য মাছের ঝাঁকের পেছনে থাকে। জেলেরা তাই মাছ ধরার জন্য ডলফিনের চারপাশে জাল দিয়ে ঘিরে ফেলে। এ সময় জালে আটকা পড়ে ডলফিনগুলো মারা যায়।

হালদা ছাড়াও দেশের বিভিন্নি স্থানে ডলফিন হত্যার ঘটনা ঘটছে। কক্সবাজারের টেকনাফ সমুদ্র সৈকতের শামলপুর এলাকায় গত ৪ এপ্রিল বিশাল আকৃতির একটি মৃত ডলফিন ভেসে আসে। মাছ ধরা জালে আটকা পড়ার পর জেলেরা ডলফিনটিকে মেরে ফেলে বলে গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে বলা হয়।

গত ২৭ এপ্রিল শরীয়তপুরের সখিপুর এলাকার এক জেলে মিঠাপানির ডলফিন বা শুশুক হাতে নিয়ে ছবি তোলেন। সেই ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকের একটি গ্রুপে প্রকাশ করেন আবির মাহমুদ বেলাল নামে একজন। এর পরই শুরু হয় আলোচনা-সমালোচনা।

বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, কয়েকদিন আগেও পর্যটকশূন্য কক্সবাজার-টেকনাফ সমুদ্র সৈকতে বিরল ডলফিনগুলো দলবেধে খেলা করেছে। কিন্তু জেলেদের উৎপাতে সাম্প্রতিক সময়ে সৈকতে ডলফিনের আনাগোনা কমে গেছে।

“বিশেষ করে এই লকডাউনের সুযোগ নিয়ে যেখানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বা প্রশাসন খুব একটা নজরদারি করতে পারছে না সেই সুযোগে জেলেরা নির্মমভাবে ডলফিন হত্যা করছে,” বলেন আব্দুল কাইয়ুম।

তিনি বলেন, “ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব নেচার ও দ্য ওয়ার্ল্ড লাইফ সাইন্সেস ফোরাম হালদার এসব ডলফিনকে বিপন্ন প্রায় বলছে।”

“আমাদের বণ্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইনেও এ জাতীয় প্রাণীকে সংরক্ষণ করতে বলা হয়েছে। কিন্তু আমাদের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রশাসন এসব ডলফিনকে সুরক্ষা করতে পারছে না। এ জন্যই আমি আদালতে রিট আবেদন করেছিলাম,” বলেন আব্দুল কাইয়ুম।

বিচার ব্যবস্থার নতুন যুগে প্রবেশ

ভার্চুয়াল শুনানির অভিজ্ঞতা বলতে গিয়ে আইনজীবী কাইয়ুম বলেন, এটা অত্যন্ত যুগান্তকারী পদক্ষেপ। এর মাধ্যমে দেশের বিচার ব্যবস্থা কয়েকশ বছরের অন্যালগ ঐতিহ্যকে পেছনে ফেলে যুগের প্রয়োজনে ভার্চুয়াল বিচার কার্যক্রমের যুগে প্রবেশ করল।

শুনানির শুরুতে বিচারপতি ওবায়দুল হাসান তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করে মামলা শুনানি ও নিষ্পত্তির জন্য ভার্চ্যুয়াল কোর্টব্যবস্থা চালু করায় রাষ্ট্রপতি মো. আব্দুল হামিদ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন ও আইনমন্ত্রী আনিসুল হককে ধন্যবাদ জানান।

এই ভার্চ্যুয়াল আদালত দেশে ই-জুডিশিয়ারি প্রতিষ্ঠার প্রথম পদক্ষেপ বলেও ‍উল্লেখ করেন বিচারপতি।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।