জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার কমানোর আহ্বান জানানো বাংলাদেশ নিজেই তা বন্ধ করতে পারছে না
2021.08.03
ঢাকা

জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বিশ্বের যেসব দেশ চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে, বাংলাদেশ সেগুলোর অন্যতম। এই প্রেক্ষাপটে বিশ্বকে রক্ষা করতে জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার কমিয়ে কার্বন নিঃসরণ হ্রাসে উন্নত দেশগুলোর প্রতি আবেদন জানিয়ে আসছে ক্লাইমেট ভালনারেবল ফোরামের (সিভিএফ) চেয়ার বাংলাদেশ।
তবে বাস্তবতা হচ্ছে, বাংলাদেশ নিজেই জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহার বন্ধ করতে পারছে না। দেশের বিদ্যুৎ চাহিদা মেটাতে নির্ভর করতে হচ্ছে পরিবেশ দূষণকারী জ্বালানি তেল, গ্যাস ও কয়লার ওপর।
২০২০ সালের মধ্যে বিদ্যুৎ চাহিদার মোট ১০ ভাগ পরিবেশবান্ধব নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে মেটানোর যে লক্ষ্য ২০০৯ সালে গ্রহণ করা হয়েছিল, তা অর্জিত হয়নি বলে বেনারকে জানিয়েছেন সরকারের পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক মোহাম্মদ হোসাইন।
মঙ্গলবার সরকার ঘোষিত মুজিব ক্লাইমেট প্রসপারিটি প্লানের ওপর এক আলোচনায়ও বিশেষজ্ঞরা সরকারকে জীবাশ্ম জ্বালানি পুরোপুরি বাদ দেয়ার পরিকল্পনা থেকে সরে আসতে পরামর্শ দেন।
মহাপরিচালক হোসাইন সোমবার বেনারকে বলেন, “২০০৯ সালে আমরা পরিকল্পনা করেছিলাম যে ২০১৫ সালের মধ্যে আমাদের মোট জ্বালানি চাহিদার শতকরা পাঁচ ভাগ এবং ২০২০ সালের মধ্যে শতকরা ১০ ভাগ নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে মেটানো হবে। কিন্তু আমাদের সেই লক্ষ্য পুরোপুরি অর্জন হয়নি। বর্তমানে মোট জ্বালানি চাহিদার প্রায় চার ভাগ নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে আসছে।”
তিনি বলেন, “লক্ষ্য অর্জিত না হওয়ার পেছনে অনেক কারণ রয়েছে। আমাদের দেশে নবায়নযোগ্য জ্বালানির একমাত্র সম্ভাবনা রয়েছে সৌর বিদ্যুতে। বায়ু থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্য নিয়ে কাজ চললেও সেখান থেকে কতটুকু অর্জন করা যাবে তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।”
“আমাদের দেশে জমি অনেক কম। সে কারণে আমরা অন্যান্য দেশের মতো ব্যাপকভাবে সোলার প্যানেল বসাতে পারব না। ভবিষ্যতে আমাদের জীবাশ্ম জ্বালানি এবং নবায়নযোগ্য জ্বালানির সমন্বয়ে বিদ্যুৎ চাহিদা মেটাতে হবে,” বলেন মোহাম্মদ হোসাইন।
সরকারি হিসাবে, এক মেগাওয়াট সৌর বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে তিন একর জমি প্রয়োজন হয়। বাংলাদেশের মতো জনবহুল ও কৃষিপ্রধান দেশে বড়ো পরিসরে সোলার পার্ক স্থাপন করা কঠিন বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
মহাপরিচালক হোসাইন বলেন, “বর্তমানে আমাদের লক্ষ্য হলো, ২০৩০ সালের মধ্যে মোট জ্বালানির শতকরা ১৫ ভাগ এবং ২০৫০ সালের মধ্যে ৪০ ভাগ নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা।”
সরকারের পরিকল্পনা অবাস্তব
মঙ্গলবার পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় আয়োজিত মুজিব ক্লাইমেট প্রসপারিটি প্লানের ওপর এক আলোচনায় অংশগ্রহণকারী ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর ক্লাইমেট চেঞ্জ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট’র উপপরিচালক ড. মিজান আর. খান বেনারকে বলেন, “জ্বালানির ব্যাপারে সরকারের যে পরিকল্পনা, সেটি আমার কাছে অবাস্তব মনে হয়েছে।”
উদাহরণ হিসাবে তিনি বলেন, “বলা হয়েছে বঙ্গপোসাগরের বায়ু ব্যবহার করে চার গিগা ওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হবে। ২০৩০ সালের মধ্যে মোট জ্বালানি চাহিদার ৩০ ভাগ এবং ২০৪১ সালের মধ্যে ৪০ ভাগ বিদ্যুৎ নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে উৎপাদন করা হবে।”
“আমাদের দেশে বায়ুর চাপ কম। কীভাবে এই লক্ষ্য নির্ধারণ করা হলো, তা বোধগম্য নয়। তাই, আমিসহ অনেকেই বলেছি, আমরা জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে সরে যেতে পারব না। এটি সম্ভবও নয়,” বলেন ড. মিজান।
পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব আহমদ শামীম আল রাজী মঙ্গলবার বেনারকে বলেন, মন্ত্রণালয়ের বৈঠকে অংশগ্রহণকারী অনেকেই নবায়নযোগ্য জ্বালানি সম্পর্কে বাংলাদেশের পরিকল্পনাকে “কিছুটা আন্তর্জাতিক ধাঁচের,” আখ্যায়িত করে “বাংলাদেশের অবস্থার প্রেক্ষিতে এটি পরিবর্তন করা দরকার,” বলে মত দিয়েছেন।
বঙ্গোপসাগরে বায়ু থেকে চার গিগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রস্তাবের ব্যাপারে তিনি বলেন, “হয়তো লক্ষ্যটি বেশি হয়েছে। তবে আমাদের তো শুরু করতে হবে, উপায় খুঁজে বের করতে হবে।”
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শিল্পায়ন ও আধুনিকতার কারণে অধিক পরিমাণে কয়লা, পেট্রোল, ডিজেল, গ্যাসসহ অন্যান্য জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহারের ফলে বৈশ্বিক তাপমাত্রা আশঙ্কাজনকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এর ফলে বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে জমে থাকা বরফ গলে সমুদ্রে পড়ছে। ফলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
এখনই জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহার বন্ধ করা না গেলে বাংলাদেশসহ বিশ্বের উপকূলীয় অঞ্চলগুলো পানিতে তলিয়ে যাবে। বাস্তুচ্যুত হবে কোটি কোটি মানুষ।
বাংলাদেশে নবায়নযোগ্য জ্বালানির চিত্র
বাংলাদেশে নবায়নযোগ্য জ্বালানির সম্ভাব্য উৎসগুলোর মধ্যে রয়েছে সৌরবিদ্যুৎ, বায়ুবিদ্যুৎ, জলবিদ্যুৎ, বায়োগ্যাস ও বায়োমাস। বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের তথ্য অনুসারে দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা দৈনিক ২২ হাজার মেগাওয়াটের কিছু বেশি। এর মধ্যে নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে আসে ৬৫০ মেগাওয়াটের কিছু বেশি।
জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার বৃদ্ধির লক্ষ্যে ২০১৪ সালে সাসটেনেবল রিনিউএবল এনার্জি ডেভেলপমেন্ট অথরিটি (স্রেডা) প্রতিষ্ঠা করে বাংলাদেশ সরকার।
স্রেডার ২০২০ সালের জুন মাসের হিসাব অনুযায়ী বাংলাদেশে নবায়নযোগ্য উৎস থেকে ৬৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদিত হয়েছে। এর মধ্যে সৌর থেকে এসেছে ৪১৬ মেগাওয়াট, ষাটের দশকে স্থাপিত কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে এসেছে ২৩০ মেগাওয়াট, বায়ু থেকে এসেছে দুই দশমিক নয় মেগাওয়াট, বায়োগ্যাস ও বায়োমাস থেকে এসেছে শতকরা একভাগ বিদ্যুৎ।
সৌর বিদ্যুতের এই ৪১৬ মেগাওয়াটের মধ্যে সোলার হোম সিস্টেম থেকে এসেছে প্রায় ২৫২ মেগাওয়াট, রুফটপ সোলার সিস্টেম থেকে ৫৮ মেগাওয়াট, সোলার ইরিগেশন থেকে ৪২ মেগাওয়াট, চারটি সোলার পার্ক থেকে প্রায় সাড়ে ৩৮ মেগাওয়াট।
এছাড়া সোলার স্ট্রিট লাইট থেকে সাড়ে ১০ মেগাওয়াট, সোলার টেলিকম টাওয়ার থেকে আট মেগাওয়াট, সোলার মিনি গ্রিড থেকে সাড়ে পাঁচ মেগাওয়াট এবং সোলার ড্রিংকিং সিস্টেম থেকে দেড় মেগাওয়াট বিদ্যুৎ পাওয়া গেছে।
বর্তমান নিয়ম অনুযায়ী, শহরাঞ্চলে বাড়ি নির্মাণ করতে গেলে বাসার ছাদে অবশ্যই সৌর প্যানেল থাকতে হবে। তবে, ঢাকাসহ অধিকাংশ বাসায় সোলার প্যানেল দেখা যায় না।
বাংলাদেশে নবায়নযোগ্য জ্বালানির একমাত্র ও প্রধান উৎস মূলত সৌর বিদ্যুৎ বলে বেনারকে জানান বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক জ্বালানি উপদেষ্টা ম. তামিম।
“নদীমাতৃক দেশ হলেও আমাদের নদীতে পানির অভাব আছে; সেকারণে জলবিদ্যুতের কোনো সম্ভাবনা নেই। আমাদের উপকূলে বাতাসের বেগ ততোটা বেশি নয় বলে গবেষণায় বেরিয়ে এসেছে। সুতরাং, বায়ু বিদ্যুতেরও কোনো সম্ভাবনা নেই,” বলেন অধ্যাপক ম. তামিম।
গত বছর ডিসেম্বরে চীনা কোম্পানির মাধ্যমে বাগেরহাটের মংলায় ৫৫ মেগাওয়াট বায়ুবিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এর আগে ফেনী জেলায় পরীক্ষামূলকভাবে একটি বায়ু বিদ্যুৎ প্রকল্প স্থাপন করে বিদ্যুৎ বিভাগ, তবে সেটি ব্যর্থ হয়েছে।
অধ্যাপক ম. তামিম বলেন, “সোলার প্যানেল স্থাপনের বড়ো সমস্যা হলো, অনেক জায়গা প্রয়োজন হয়। ফলে বিনিয়োগের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়, এ জন্য বিদ্যুতের দাম পড়ে বেশি।”
স্রেডা বলছে, বায়োমাস থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হলে প্রচলিত উৎসের চেয়ে দাম বেশি হবে।
দেশে সৌরশক্তি থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়াতে সরকার বিভিন্ন জলাশয়ে ভাসমান সৌরপ্যানেল স্থাপনের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার বলে জানায় স্রেডা। এই ধরনের প্যানেলের উৎপাদন ক্ষমতা বেশি। ইতোমধ্যে মংলা পৌরসভায় এমন একটি বৃহৎ প্যানেল স্থাপন করা হয়েছে।
সরকারের নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহারের লক্ষ্যমাত্রা ও পরিকল্পনা “ব্যর্থ হয়েছে” বলে মন্তব্য করেন অধ্যাপক তামিম।
বর্তমানে দেশে নবায়নযোগ্য জ্বালানির অবদান প্রায় শতকরা চার ভাগ বলে সরকার দাবি করলেও “সেটি আসলে প্রকৃত চিত্র নয়,” জানিয়ে তিনি বলেন, “এর মধ্যে রয়েছে রুফটপ সোলার প্যানেল থেকে উৎপাদিত বিদ্যুৎ, যেগুলো জাতীয় গ্রিডে যোগ হয় না। প্রকৃতপক্ষে বর্তমানে নবায়নযোগ্য জ্বালানির অবদান সর্বোচ্চ শতকরা এক ভাগ।”
জলবায়ু সম্মেলনে বাংলাদেশে প্রতিনিধিত্বকারী পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক জিয়াউল হক বেনারকে বলেন, “জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য বাংলাদেশ ক্ষতিগ্রস্ত দেশ। তাই, প্যারিস চুক্তির আওতায় বাংলাদেশ কার্বন নিঃসরণ কমাতে বাধ্য নয়।”
তবে নিজে থেকেই কার্বন নিঃসরণ কমানোর দেয়ায় বাংলাদেশ “আন্তর্জাতিক মহলে প্রশংসিত হয়েছে বলেও দাবি করেন তিনি।