৪৮ ঘণ্টার মধ্যে ঢাকার যানবাহনে হাইড্রলিক হর্ন বন্ধের নির্দেশ

জেসমিন পাপড়ি
2017.08.23
ঢাকা
যানবাহন থেকে হাইড্রলিক হর্ন জব্দ করছে পুলিশ। যানবাহন থেকে হাইড্রলিক হর্ন জব্দ করছে পুলিশ। আগস্ট ২৩, ২০১৭।
নিউজরুম ফটো

শব্দদূষণ রোধে আগামী ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে রাজধানী ঢাকায় চলাচলকারী যানবাহনের হাইড্রলিক হর্ন বন্ধের নির্দেশ দিয়েছেন উচ্চ আদালত। এই সময়ের পর ঢাকার রাস্তায় আর কোনো যানবাহনে বিকট শব্দ তৈরিকারী এই হর্ন বাজানো হলে গাড়িসহ তা জব্দ করতে বলা হয়েছে।

একটি রিট আবেদনের প্রাথমিক শুনানি শেষে গতকাল বুধবার এ আদেশ দেন বিচারপতি কাজী রেজা উল হক ও বিচারপতি মোহাম্মদ উল্লাহর সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ।

এ ছাড়া আমদানি বন্ধের পাশাপাশি আগামী সাত দিনের মধ্যে বাজারে থাকা সব হাইড্রলিক হর্ন জব্দ করারও নির্দেশ দিয়েছে আদালত। এসব নির্দেশনা বাস্তবায়নের অগ্রগতি জানিয়ে দুই সপ্তাহের মধ্যে বিবাদীদের প্রতিবেদন দিতে হবে।

রিটের পক্ষে শুনানিকারী আইনজীবী মনজিল মোরসেদ বেনারকে বলেন, সাধারণ হর্নের তুলনায় হাইড্রলিক হর্নে কয়েক গুণ বেশি শব্দ হয়। রাজধানীর যানবাহনগুলোতে এই হর্নের ব্যবহার বেশি হওয়ায় মারাত্মক শব্দ দূষণ তৈরি হয়; যা নগরবাসীকে মারাত্মক স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে ফেলছে।”

এই রায়কে সময়োপযোগী বলে মনে করছেন পরিবেশবাদীরা। রাজধানী ঢাকার শব্দদূষণ অসহনীয় পর্যায়ে পৌঁছেছে। এখনই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা না নিলে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করতে পারে।

বাংলাদেশ পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের (পবা) সাধারণ সম্পাদক প্রকৌশলী মোহাম্মদ আবদুস সোবহান বেনারকে বলেন, “উচ্চ শব্দ তৈরির জন্য হাইড্রোলিক হর্ন বিশেষভাবে দায়ী। এই হর্নের ব্যবহার বন্ধ হলে রাজধানীর শব্দ দূষণের মাত্রা কয়েক গুন কমে আসবে।”

“শব্দ দূষণ মানুষের নানা ধরনের শারীরিক ও মানসিক সমস্যার জন্য দায়ী। অতিমাত্রার শব্দ অনিদ্রা, শ্রবণশক্তি হ্রাস, উচ্চ রক্তচাপ, অমনোযোগী হয়ে পড়া, মাথাব্যথাসহ বিভিন্ন সমস্যা তৈরি করে। বিশেষ করে শিশু, গর্ভবতী নারী এবং হৃদরোগীরা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়,” বেনারকে জানান নাক-কান ও গলা বিশেষজ্ঞ ড. ফারুক-উজ-জামান।

হাইড্রলিক হর্নের ব্যবহার বন্ধে নিষ্ক্রিয়তা চ্যালেঞ্জ করে মঙ্গলবার রিটটি করে মানবাধিকার ও পরিবেশবাদী সংগঠন হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশ। এতে বলা হয়, মোটরযান অধ্যাদেশ অনুযায়ী যানবাহনে শব্দ দূষণকারী হাইড্রলিক হর্ন ব্যবহার নিষিদ্ধ হলেও তা মানা হচ্ছে না। রিট আবেদনে ব্যবহারকারী যানবাহনও জব্দের নির্দেশনা চাওয়া হয়।

এর আগে গত ১৬ আগস্ট এক সংবাদ সম্মেলনে ঢাকার পুলিশ কমিশনার মো. আছাদুজ্জামান মিয়া জানান, ট্রাফিক পুলিশ গত এক বছরে ১০ হাজার হাইড্রলিক হর্ন জব্দ করেছে। এতে করে ঢাকা মহানগরীতে হাইড্রলিক হর্নের অননুমোদিত ব্যবহার কিছুটা কমেছে। তবে পরিস্থিতি এখনো পুরো নিয়ন্ত্রণে আনা যায়নি।

এই হর্নের বহুল ব্যবহারের কারণ হিসেবে অবাধ কেনাবেচা, আইন সম্পর্কে চালকদের অজ্ঞতা ও অসচেতনতা, তুলনামূলক কম শাস্তি এবং প্রশিক্ষণের ঘাটতিকে চিহ্নিত করেন আছাদুজ্জামান মিয়া।

ঢাকার শব্দ দূষণের মাত্রা দ্বিগুণ

বাংলাদেশ পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের একটি জরিপ বলছে, রাজধানী ঢাকায় শব্দ দূষণের মাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে দুই গুণ বেশি। দিন দিন তা বেড়েই চলেছে। শব্দ দূষণ নিয়ন্ত্রণে আইনের প্রয়োগের দুর্বলতা এবং জনসচেতনতার অভাবকেই এর জন্য দায়ী করা হয়েছে।

পবার যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ডা. লেলিন চৌধুরী বেনারকে জানান, “চলতি বছরে ঢাকার নীরব, আবাসিক, মিশ্র ও বাণিজ্যিক ৪৫টি এলাকায় শব্দের মাত্রা পরিমাপ করে শব্দ দূষণের এই চিত্র পাই আমরা।”

শব্দদূষণ (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা, ২০০৬ অনুযায়ী, যেকোনো শহরের নীরব এলাকার (হাসপাতাল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, অফিস-আদালত ইত্যাদি এবং এর চারপাশের ১০০ মিটার পর্যন্ত বিস্তৃত) শব্দের মাত্রা দিনে ৫০ এবং রাতে ৪০ ডেসিবল থাকার কথা। আবাসিক এলাকায় দিনে ৫০ এবং রাতে ৪৫ ডেসিবেল; মিশ্র এলাকায় দিনে ৬০ এবং রাতে ৫০ ডেসিবেল; বাণিজ্যিক এলাকায় দিনে ৭০, রাতে ৬০ এবং শিল্প এলাকায় দিনে ৭৫ ও রাতে ৭০ ডেসিবল প্রত্যাশিত মাত্রা।

প্রসঙ্গত শব্দের পরিমাণকে ডেসিবল দিয়ে মাপা হয়। সাধারণত মানুষের স্বাভাবিক কথাবার্তার মাত্রা ৬০ ডেসিবল এর কাছাকাছি হয়ে থাকে। ঘড়ির অ্যালার্ম ৮০ ও বজ্রপাতের শব্দের পরিমাণ ১৩০ ডেসিবল এর কাছাকাছি।

পবার জরিপ অনুযায়ী রাজধানী ঢাকার নীরব এলাকায় দিনে শব্দের মাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে দেড় থেকে ২ গুণ বেশি। আবাসিক ও মিশ্র এলাকায় দিনে দেড় গুণ এবং রাতে প্রায় দেড় থেকে ২ গুণ বেশি। বাণিজ্যিক এলাকায় দিনে শব্দের মাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ের দেড় গুণ বেশি।

আটটি বিভাগীয় শহরে পরিবেশ অধিদপ্তর পরিচালিত শব্দের মাত্রা বিষয়ক জরিপ ২০১৬-১৭-তে সর্বোচ্চ ১৩০ ডেসিবল শব্দের মাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে। যা স্বাভাবিকের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি। ঢাকা শহরের শব্দের মাত্রাও ১৩০ ডেসিবেল পাওয়া যায়।

জরিপে যানবাহনের হর্নকে শব্দদূষণের অন্যতম উৎস হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। যেসকল মানুষ হর্ন ব্যবহারের স্থানগুলোতে অবস্থান করে থাকেন, তাঁরা মারাত্মক স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে রয়েছেন বলেও জানানো হয়।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।