কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে বাংলাদেশকে বাধ্য করছে চীন ও ভারত: টিআইবি
2019.09.27
ঢাকা

দুর্নীতিবিরোধী আন্তর্জাতিক সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল, বাংলাদেশ (টিআইবি) অভিযোগ করেছে যে, বাংলাদেশকে জিম্মি করে চীন ও ভারত কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনে বাধ্য করছে।
চলমান ‘গ্লোবাল ক্লাইমেট স্ট্রাইক’ কর্মসূচির প্রতি সমর্থন জানিয়ে শুক্রবার ঢাকায় টিআইবি আয়োজিত সংহতি র্যালিতে সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান এই অভিযোগ করেন। ২০৩০ সালের মধ্যে দেশের সব কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্প বন্ধের আহ্বানও জানান তিনি।
ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, “ভারত ও চীন নিজেদের দেশে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন থেকে সরে গেছে। কিন্তু বাংলাদেশে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বাস্তবায়নে সরকারকে জিম্মি করছে।”
ড. ইফতেখারের এই বক্তব্য সম্পর্কে মিশ্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন বাংলাদেশের জ্বালানী খাতের বিশেষজ্ঞরা। আর সরকারের পক্ষ থেকে জিম্মি করার বিষয়টি অস্বীকার করে বলা হচ্ছে, নিজেদের প্রয়োজনেই ভারত কিংবা চীনের সাথে যৌথভাবে কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের কাজ করা হচ্ছে।
তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির সদস্যসচিব ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষক আনু মুহাম্মদ বেনারকে বলেন, “আন্তর্জাতিকভাবে বদনাম হওয়ায় কয়লাভিত্তিক বিদুৎ কেন্দ্র থেকে সরে আসছে চীন ও ভারত। এরপর তারা কয়লার সাথে নিজেদের সম্পৃক্ত বিনিয়োগ, কয়লা, প্রযুক্তি ও জনশক্তি কোথাও না কোথাও ডাম্প করার জায়গা খুঁজছে।”
তিনি বলেন, “বাংলাদেশের ওপর চীনের অর্থনৈতিক এবং ভারতের রাজনৈতিক প্রভাব ব্যবহার করা হচ্ছে এগুলো ডাম্প করার কাজে। এটা বাংলাদেশের জন্য খুব বিপদজনক হয়ে দাঁড়াচ্ছে।”
তবে টিআইবি এবং আনু মুহাম্মদের বক্তব্যের সাথে ভিন্নমত পোষণ করেছেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী (জ্বালানী) ম তামিম।
তিনি বেনারকে বলেন, “বাংলাদেশ যখন কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে তাতে বিদেশি কোনো সরকারের কোনো ভূমিকা ছিল না। পরবর্তীতে কাকে দিয়ে বাস্তবায়ন করা হবে সেটি খুঁজতে গিয়ে ভারত বা চীনকে অংশীদার করা হয়। সুতরাং জিম্মি করার বিষয়টি কতটা যৌক্তিক তা নিয়ে প্রশ্ন থাকে।”
“দেশের এখন যা পরিস্থিতি, তাতে নবায়নযোগ্য জ্বালানি দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারব না আমরা। তবে ধীরে ধীরে নবায়নযোগ্য জ্বালানির দিকে যেতে হবে,” বলেন তিনি।
ম তামিম মনে করেন, “আমাদের দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদনে যে কয়লা পুড়বে তা বিশ্ব জলবায়ুতে খুব বেশি নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে না। চীন, ভারত, রাশিয়া, জার্মানিসহ বিভিন্ন দেশ কমপক্ষে ৭০ শতাংশ কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন করছে। তারা এখন চেষ্টা করছে নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে যেতে। আমরা চাইলেও এখন দ্রুত সেদিকে যেতে পারব না।”
তিনি বলেন, “বাংলাদেশেও যদি কিছু কয়লাভিত্তিক কেন্দ্র থাকে তা নিয়ে এতটা হইচই করার কারণ দেখি না। তবে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ বেশি না বাড়িয়ে ধীরে ধীরে মিশ্র জ্বালানির দিকে যেতে হবে।”
সরকারের পক্ষ থেকেও টিআইবির অভিযোগ অস্বীকার করা হয়েছে। সরকারি প্রতিষ্ঠান পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক মোহাম্মদ হোসেন বেনারকে বলেন, “সরকারকে জিম্মি করার প্রশ্নই আসে না। আমাদের বিদ্যুতের চাহিদা এবং অর্থায়নের প্রয়োজনে বিভিন্ন দেশের সাথে যৌথ বিনিয়োগে গিয়েছি আমরা। তবে শুধু ভারত-চীন নয়, রাশিয়া ও জাপানের মতো দেশের সাথেও যৌথভাবে বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ চলছে।”
“২০০৬ সালের দিকে কলকারখানা দূরে থাক, সাধারণ মানুষই দিনে ১০-১২ ঘণ্টা করে বিদ্যুতের দেখা পেত না। এককভাবে কিংবা যৌথ বিনিয়োগের মাধ্যমে বিদ্যুৎ উৎপাদনের ফলেই এখন বিদ্যুতে আমাদের সারপ্লাস আছে। দেশের প্রয়োজনেই কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করা হচ্ছে,” বলেন তিনি।
এ ক্ষেত্রে পরিবেশের ক্ষতির বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে বলেও জানান মোহাম্মদ হোসেন।
প্রতিশ্রুতি ও বাস্তবতায় অমিল
টিআইবি জানায়, প্যারিস চুক্তি বাস্তবায়নের উদ্যোগের অংশ হিসেবে বাংলাদেশ ২০৩০ সালের মধ্যে পাঁচ শতাংশ কার্বন নিঃসরণ কমানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। কিন্তু বন ও সংরক্ষিত এলাকায় রামপাল, মাতারবাড়ি, পায়রা, ট্যাংরাগিরির মতো বড় কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রকল্প গ্রহণ করেছে, যা চুক্তির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।
আনু মুহাম্মদও বেনারকে বলেন, “জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে আন্তর্জাতিক সম্মেলনে বাংলাদেশ যেসব কথা বলছে তার প্রধান উদ্দেশ্য মনে হচ্ছে, জলবায়ুর সাথে সম্পর্কিত বিভিন্ন তহবিলের একসেস পাওয়া। অথচ এসব সম্মেলনে সরকারের প্রতিশ্রুতি এবং দেশের ভেতরের কাজ সম্পূর্ণ বিরোধী অবস্থান।”
টিআইবির সংহতি প্রকাশ কর্মসূচিতে বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধির হার সীমিত করা ও বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধির হার সর্বোচ্চ দুই ডিগ্রি সেলসিয়াসে রাখার জন্য কয়েকটি সুনির্দিষ্ট দাবি তুলে ধরা হয়। জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে ওই কর্মসূচিতে কয়েকশ শিক্ষার্থী, কিশোর, পরিবেশবাদি ও বেসরকারি সংস্থার কর্মীরা অংশ নেন।
কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র পরিস্থিতি
দিনাজপুরের বড়পুকুরিয়ায় দেশের একমাত্র কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু রয়েছে। এ কেন্দ্রের উৎপাদন ক্ষমতা প্রায় সাড়ে চারশ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ।
চীন ও বাংলাদেশ সরকার যৌথভাবে পটুয়াখালী জেলার পায়রায় এক হাজার ৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করছে। ইতিমধ্যে ৯০ ভাগ কাজ শেষ হওয়া বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি আগামী ডিসেম্বরের মধ্যেই চালু করতে চায় সরকার।
এ ছাড়া সুন্দরবনের অদূরে রামপালে এক হাজার ৩২০ মেগাওয়াট কেন্দ্রটির নির্মাণকাজ প্রায় ৪০ ভাগ শেষ হয়েছে। ভারতের ন্যাশনাল থারমাল পাওয়ার কোম্পানির সঙ্গে যৌথভাবে বাংলাদেশ পাওয়ার ডেভেলপমেন্ট বোর্ড এটি বাস্তবায়ন করছে।
জাপানের সহায়তায় কক্সবাজারের মাতারবাড়িতে ১২ শ’মেগাওয়াট ক্ষমতার কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের কাজ চলছে। এ ছাড়াও আরো বেশ কয়েকটি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্প সরকারের হাতে রয়েছে বলে জানান বিদ্যুৎ বিভাগের কর্মকর্তারা।
ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, দেশে বর্তমানে মোট উৎপাদিত বিদ্যুতের মাত্র ২ দশমিক ৯৯ শতাংশ আসছে নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে। তিনি বলেন, “কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের মাধ্যমে আমরা জলবায়ু পরিবর্তনে ভূমিকা রাখছি, এটা আমাদের জন্য খুবই বিব্রতকর।”