বিচারবহির্ভূত হত্যার দায়ে র‌্যাব কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে অবরোধের প্রস্তাব মার্কিন সিনেটরদের

কামরান রেজা চৌধুরী
2020.10.28
ঢাকা
201028-BD-senators-extrajudicial_1000.JPG পুরান ঢাকার সোয়ারিঘাটের দেবদাস লেনে ঢাকা-৭ আসনের সংসদ সদস্য হাজী সেলিমের বাসায় অভিযানকালে পাশের রাস্তায় র‍্যাবের পাহারা। ওই অভিযানে আগ্নেয়াস্ত্রসহ বিভিন্ন অবৈধ জিনিস রাখার দায়ে সাংসদের ছেলে ইরফান সেলিমকে গ্রেপ্তার করে র‍্যাব। ২৬ অক্টোবর ২০২০।
[বেনারনিউজ]

গত পাঁচ বছর ধরে ‘বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের’ দায়ে র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র‌্যাব) জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে অবরোধ আরোপের জন্য নিজ দেশের সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন মার্কিন সিনেটের দশজন সদস্য।

মার্কিন সিনেটের পররাষ্ট্র সম্পর্ক বিষয়ক কমিটি মঙ্গলবার মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও এবং অর্থমন্ত্রী স্টিভেন নুচিনকে লেখা এক চিঠিতে এই আহ্বান জানায়। মার্কিন সিনেটের ওয়েবসাইটে এই চিঠি প্রকাশ করা হয়েছে।

মার্কিন সিনেটরদের চিঠির ব্যাপারে যোগাযোগ করা হলে “আমি এখনও মার্কিন সিনেটরদের লেখা চিঠি দেখিনি,” জানিয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী একে আব্দুল মোমেন বেনারকে বলেন, “বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের ব্যাপারে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সব সময়ই স্বোচ্চার। তাঁরা যে অভিযোগ উত্থাপন করেছেন আমরা সেগুলো পরীক্ষা করে দেখব।”

তিনি বলেন, “আমাদের দেখতে হবে, বিচারবহির্ভুত হত্যাকাণ্ডের যে অভিযোগ উত্থাপিত হয়েছে সেগুলো কতটুকু সঠিক। একতরফা অভিযোগ গ্রহণযোগ্য নয়।”

বুধবার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানের অফিসে সশরীরে যোগাযোগ করা হলে তিনি নিজে মন্তব্য না করে মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ তথ্য কর্মকর্তা শরীফ মাহমুদ অপুকে এ বি​ষয়ে বেনারের সাথে কথা বলার নির্দেশ দেন।

“বাংলাদেশের কোনো আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের সাথে সম্পৃক্ত নয়,” মন্তব্য করে শরীফ মাহমুদ অপু বেনারকে বলেন, “দায়িত্ব পালনকালে আইনশৃঙ্খলাবাহিনী প্রায়ই সশস্ত্র মাদক ব্যবসায়ী ও চোরাকারবারিদের গোলাগুলির মুখোমুখি হয়। তখন বাধ্য হয়ে তাদেরও গুলি ছুঁড়তে হয়।”

চিঠিতে যা বলা হয়েছে

মার্কিন সিনেটরদের লেখা চিঠির একটি কপি বেনারের হাতে রয়েছে। চিঠিতে স্বাক্ষর করেছেন সিনেটর রবার্ট মেনেনডেজ, টড ইয়াং, বেঞ্জামিন এল. কার্ডিন, কোরি গার্ডনার, জাঁ শাহিন, মার্কো রুবিও, ক্রিস্টোফার এস. মারফি, ক্রিস্টোফার এ. কুনস, জেফরি এ. মার্কলি ও করি এ. বুকার।

ওই চিঠিতে দশ সিনেটর বলেন, “আমরা গভীর উদ্বেগের সাথে জানাচ্ছি যে, বাংলাদেশ পুলিশের র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব) মানবাধিকার লঙ্ঘন করে চলেছে। ২০১৫ সাল থেকে র‍্যাব চার শতাধিক মানুষকে বিচারবহির্ভূতভাবে হত্যা করেছে বলে জানা গেছে এবং ‘বিশ্বাসযোগ্যভাবে’ বিভিন্ন গুম ও নির্যাতনে ঘটনার সাথে র‌্যাবকে জড়িত করা হয়েছে।”

চিঠি​তে দাবি করা হয়, এই কাজগুলোর জন্য র‌্যাবকে জবাবদিহি করা যায়নি।

এতে আরও বলা হয়, ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে সরকার মাদকের বিরুদ্ধে যে যুদ্ধ শুরু করে তখন থেকে র‌্যাবের হাতে ‘বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড’ বৃদ্ধি পায়।

২০১৮ সালের জুন মাসে বাংলাদেশ সরকারকে লেখা এক চিঠিতে জাতিসংঘ বিশেষজ্ঞ এবং মানবাধিকার, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বিষয়ক র‌্যাপোর্টিয়ার জানান, মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ প্রকৃতপক্ষে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের নীতি বলে মনে হয়।

জাতিসংঘের পক্ষ থেকে এই হত্যাকাণ্ড বন্ধ করে আইনের শাসনকে শ্রদ্ধা জানাতে আহ্বান জানানো হয়। কিন্তু সরকার এই মানবাধিকার লঙ্ঘন বন্ধ করতে ব্যর্থ হয়েছে এবং জবাবদিহি ছাড়াই র‌্যাবের এসব বিচারবহির্ভুত হত্যাকাণ্ড চলতে থাকে।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে নিহত দেড় হাজারের বেশি

মার্কিন সিনেটরদের চিঠিতে র‍্যাবের হাতে ২০১৫ সাল থেকে চার শতাধিক মানুষ মারা যাওয়ার কথা বলা হলেও মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) হিসেবে, সংখ্যাটি ৪৪০।

আসক’র হিসাবমতে, ২০১৫ সালের জানুয়ারি থেকে এ বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে মোট নিহত হয়েছেন এক হাজার ৬১৯ ব্যক্তি। এদের মধ্যে​ পুলিশের হাতে মারা গেছেন ৮৯২ জন, র‍্যাবের হাতে ৪৪০ জন এবং অন্যান্য বাহিনীর হাতে ২৮৭ জন।

মার্কিন সিনেটরদের চিঠিতে বলা হয়, প্রায় সকল ঘটনার পর র‌্যাব দাবি করে ‘বন্দুকযুদ্ধ’ অথবা ‘ক্রসফায়ারে’ এই সকল মৃত্যু ঘটেছে। কিন্তু নামকরা মানবাধিকার সংগঠনগুলোর বক্তব্য অনুযায়ী নিহত ব্যক্তিদের অনেকেই মৃত্যুর সময় র‌্যাব হেফাজতে ছিলেন এবং তাঁদের শরীরে হত্যার আলামত পাওয়া যায়।

উদাহরণ হিসাবে টেকনাফের পৌর কাউন্সিলর একরামুল হকের নিহত হওয়ার ঘটনা উল্লেখ করা হয় চিঠিতে।

চিঠিতে বলা হয়, জাতিসংঘ বিশেষজ্ঞ, সাংবাদিক ও মানবাধিকার কর্মীদের দেয়া তথ্যপ্রমাণ অনুযায়ী বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ছাড়াও গুম ও নির্যাতনের সাথে যুক্ত রয়েছে র‌্যাব। কিন্তু এ ধরনের মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য র‌্যাব এবং এর জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তারা কোনো ফলাফল ভোগ করেননি।

মার্কিন আইন অনুযায়ী, এ ধরনের মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন উল্লেখ করে র‌্যাবের জ্যেষ্ঠ অধিনায়কদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট (টার্গেটেড) অবরোধ আরোপের আহ্বান জানান ওই দশ সিনেটর।

এ প্রসঙ্গে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক মিজানুর রহমান বেনারকে বলেন, “বাংলাদেশের ইতিহাসে এই প্রথমবার আমাদের কোনো সংস্থার কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে অবরোধের কথা বললেন মার্কিন সিনেটররা। এটি আমাদের জন্য দুঃখজনক ঘটনা।”

তিনি বলেন, “সিনেটরদের এই আহ্বানের মাধ্যমে এটি প্রমাণ হয়ে গেলো যে, আমাদের দেশে যে সকল বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ঘটছে তা বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ও সংস্থা পর্যবেক্ষণ করছে।”

“আমরা বার বার বিচারবহির্ভুত হত্যাকাণ্ড ও মানবাধিকার লঙ্ঘন বন্ধ করতে সরকারকে আহ্বান জানিয়ে আসছি। কিন্তু সরকার বরাবর সেগুলো অস্বীকার করছে,” বলেন অধ্যাপক মিজানুর রহমান।

তাঁর মতে, এই চিঠির ফলে বাংলাদেশের ওপর খুব বেশি ‘প্রভাব’ না পড়লেও “বাংলাদেশের কোনো বাহিনীর বিরুদ্ধে মার্কিন সিনেটরদের উদ্বেগ প্রকাশ আন্তর্জাতিক মহলে আমাদের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করবে।”

“এই ঘটনা থেকে শিক্ষা নিয়ে সরকারের উচিত বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, নিরাপদ হেফাজতে ‍মৃত্যুসহ সকল ধরনের মানবাধিকার লঙ্ঘন বন্ধ করা,” বলেন মিজানুর রহমান।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।