সীসা দূষণ: নারায়ণগঞ্জে দুই চীনা ব্যাটারি কারখানাকে জরিমানা

কামরান রেজা চৌধুরী
2021.07.12
ঢাকা
সীসা দূষণ: নারায়ণগঞ্জে দুই চীনা  ব্যাটারি কারখানাকে জরিমানা ব্যাটারি চালিত একটি রিকশার ছবি। জুলাই ১২। ঢাকা।
বেনার নিউজ

পরিবেশ অধিদপ্তরের বাধ্যতামূলক ছাড়পত্র ছাড়াই কারখানা পরিচালনা এবং পরিবেশ আইন লঙ্ঘন করে সীসা দূষণের দায়ে নারায়ণগঞ্জে চীনা মালিকানাধীন দুই ব্যাটারি কারখানাকে দুই লাখ টাকা করে জরিমানা করেছে ভ্রাম্যমাণ আদালত।

পরিবেশ অধিদপ্তরের উপপরিচালক আব্দুল্লাহ আল মামুন বেনারকে বলেন, রোববার নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ উপজেলাধীন তারাবো বিশ্বরোডের কাছে জিউজো ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের (ইউনিট-১) এবং একই উপজেলায় বরপা এলাকায় জিউজো ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের ইউনিট-২ কে জরিমানা করেন র‍্যাবের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট।

তিনি বলেন, কোম্পানি দুটি ব্যাটারি তৈরি করে। এই কারখানাগুলোতে ইটিপি বন্ধ রেখে পরিবেশসম্মতভাবে ব্যাটারি তৈরির উপাদান সীসা না রাখায় তারা বাংলাদেশে পরিবেশ আইনের ৬(ক) ধারা লঙ্ঘন করেছেন।

পরিবেশ অধিদপ্তরের নারায়ণগঞ্জ অঞ্চলের সহকারি পরিচালক মো. আব্দুল গফুর বেনারকে বলেন, প্রতিষ্ঠান ‍দুটির মালিক চীনা নাগরিক ঝু লেইঝি।

তবে তিনি জানান, বিদেশি নাগরিক হওয়ায় ওই চীনা নাগরিককে আসামী করা হয়নি।

একইদিন রূপগঞ্জের বরপা এলাকায় রিসমো ব্যাটারি প্রস্তুত ও রিসাইকেল কোম্পানিকে তিন লাখ টাকা জরিমানা করা হয় বলে জানান আব্দুল্লাহ আল মামুন। এই প্রতিষ্ঠানটি বাংলাদেশি মালিকানাধীন।

পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক জিয়াউল হক বেনারকে বলেন, বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে এখন ব্যাটারি তৈরি এবং রিসাইক্লিং কারখানা গড়ে উঠেছে এবং এই খাতে চীনাদের অনেক বিনিয়োগ রয়েছে।

তিনি বলেন, চীনা বিনিয়োগকারীরা অনেক সময় দেশীয় ব্যবসায়ীদের সাথে যৌথভাবে এসব কোম্পানি স্থাপন করে থাকেন।

বেনারের হাতে আসা পরিবেশ অধিদপ্তরের তালিকা অনুযায়ী, নারায়ণগঞ্জ জেলায় চীনা মালিকানাধীন মোট আটটি ব্যাটারি তৈরি অথবা রিসাইক্লিং প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এগুলোর মধ্যে ছয়টিরই পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র নেই।

এর মধ্যে বন্দর থানাধীন লক্ষণখোলা এলাকায় চীনা মালিকানাধীন একটি ব্যাটারি কোম্পানিকে গত বছর দুই বার মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করে এক লাখ টাকা জরিমানা করা হয়।

পরিবেশ আইন ১৯৯৫ অনুযায়ী, ব্যাটারি সংশ্লিষ্ট কারখানার জন্য ইটিপি (বর্জ্য পরিশোধনকারী যন্ত্র) থাকতে হবে। এ ছাড়াও ব্যাটারির মূল উপাদান সীসা মানবদেহ ও পরিবেশের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকারক। ক্যান্সারের অন্যতম কারণ সীসা দূষণ।

বাংলাদেশ পরিবেশ আইনজীবী সমিতি (বেলা) প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বেনারকে বলেন, যেহেতু মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে জরিমানা আদায় করা হয়েছে সেহেতু জরিমানার পরিমাণ কম। মোবাইল কোর্ট দুই লাখ টাকার বেশি জরিমানা করতে পারে না।

তিনি বলেন, “সীসা পরিবেশের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। সীসা দূষণের ফলে ক্যান্সার সৃষ্টি হয়। তাই অভিযুক্ত কোম্পানিকে শুধু জরিমানা করলেই চলবে না। ওই অঞ্চলে গবেষণা করে দেখতে হবে কোম্পানিগুলো কতদিন ধরে দূষণ করে যাচ্ছে।”

রিজওয়ানা হাসান বলেন, “ওই গবেষণার ফলাফলের ভিত্তিতে সেখানে ক্ষতির পরিমাণ নির্ধারণ করে এদের কাছ থেকে ক্ষতিপুরণ আদায় করতে হবে, কারখানা বন্ধ করতে হবে এবং এদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি অপরাধে মামলা দায়ের করতে হবে।”

তিনি আরও বলেন, “চীনা মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান হলেও মালিকের বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা না নিয়ে প্রতিষ্ঠানটির বাংলাদেশি ব্যবস্থাপকসহ ছোট কর্মচারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়। এটা গ্রহণযোগ্য নয়।”

রিজওয়ানা হাসান আরও বলেন, দূষণের দায়ে যদি কোন চীনা নাগরিক দোষী হোন তাহলে তাদের বিরুদ্ধেও কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। অন্যথায় এই সমস্যার সমাধান হবে না।

ঢাকাস্থ চীনা দূতাবাসে এ ব্যাপারে মন্তব্যের জন্য যোগাযোগ করা হলেও কোন উত্তর পাওয়া যায়নি।

বাংলাদেশে প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ইজাজ হোসেন বেনারকে বলেন, বাংলাদেশে ব্যাটারির বাজার ধীরে ধীরে অনেক বড় হচ্ছে। কারণ হিসাবে তিনি বলেন, বাস, ট্রাক, ব্যক্তিগত গাড়ি ছাড়াও সারা দেশে ব্যাটারি চালিত রিক্সা এবং তিন চাকার ব্যাটারি চালিত ইজিবাইকের ব্যাপক বিস্তার ঘটেছে।

অধ্যাপক এজাজ বলেন, এই ব্যাটারি চালিত বাহনের জন্য একদিকে প্রতি বছর প্রচুর নতুন ব্যাটারি প্রয়োজন হয়, অন্যদিকে প্রচুর সংখ্যক ব্যাটারি বাতিল হয়ে যায়।

তিনি বলেন, এই বাতিল ব্যাটারিগুলো রিসাইকেল করে নতুন ব্যাটারি তৈরি করা যায়। তাই দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীরা এই খাতে বিনিয়োগ করছে।

অধ্যাপক এজাজ বলেন, সীসা একটি বিষাক্ত ধাতু। এগুলো রিসাইকেল করার কতগুলো নির্দেশনা আছে। বাতাসের সংস্পর্শে গেলে পরিবেশ দুষিত করে এই ধাতু।

তিনি বলেন, বাংলাদেশে আট থেকে দশটি কোম্পানি নিয়ম অনুসরণ করে ব্যাটারি রিসাইকেল করে থাকে। বাকি কোম্পানিগুলো কোনওরকম নিয়ম অনুসরণ করে না। ফলে পরিবেশ দূষণ হওয়া ছাড়াও সেখানে যাঁরা কাজ করেন তাঁদের মারাত্নক স্বাস্থ্য ঝুঁকির মধ্যে পড়তে হয়। এগুলো বন্ধ করতে হবে।

পরিচালক জিয়াউল হক বেনারকে বলেন, পরিবেশ আইন সবাইকে মানতে হবে। কিন্তু সমস্যা হলো সারা দেশে সকল প্রতিষ্ঠানের ওপর তদারকি করতে পারে না পরিবেশ অধিদপ্তর। এর অন্যতম কারণ সীমিত জনবল।

তিনি বলেন, তবে সীমিত জনবলের মধ্যেও সাধ্যমতো কাজ করে যাচ্ছে পরিবেশ অধিদপ্তর এবং আমাদের নজরে আসলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেয়া হবে।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।