ফারাক্কা বাঁধ তুলে দেওয়ার দাবি বিহারের,পশ্চিমবঙ্গের ‘না’

ঢাকা থেকে জেসমিন পাপড়ি
2016.08.25
20160825-farakka-barrage620.jpg প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে সাক্ষাৎ করে ফারাক্কা বাঁধ খুলে দেওয়ার দাবি জানান বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নিতীশ কুমার। আগস্ট ২৩, ২০১৬।
প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়,ভারত

শুষ্ক মৌসুমে পানি ধরে রাখতে গঙ্গা নদীর ওপরে ভারত ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণ করে। এ নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে আপত্তি জানিয়ে আসছে বাংলাদেশ। বিষয়টি নিয়ে জাতিসংঘের কাছে গিয়েও ফল পায়নি বাংলাদেশ।

ফলে শুষ্ক মৌসুমে গঙ্গার ন্যায্য পানি না পেয়ে আরও শুকিয়ে গেছে এ দেশের নদী-নালা। প্রাকৃতিক পরিবেশের ওপর পড়েছে এর বিরূপ প্রভাব।

বিলম্বে হলেও ফারাক্কা বাঁধ তুলে দিতে ভারতের ভেতর থেকেই দাবি উঠেছে। এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করছে।

১৯৭৫ সালের ২১ শে এপ্রিল থেকে চালু হয় এই বাঁধ।গঙ্গার নাব্যতা বজায় রেখে কলকাতা বন্দর চালু রাখার উদ্দেশ্যে নির্মিত এই বাঁধের কারণে গঙ্গার ভাঁটি এলাকা বাংলাদেশে যেমন পানি কমেছে, একই সঙ্গে বাঁধের বিভিন্ন ফটকে পলি জমে প্রতি বছর বন্যার সম্মুখীন হচ্ছে ভারতের বিহার রাজ্যও।

এ কারণে প্রথমবারের মত ভারতের প্রভাবশালী রাজনীতিক ও বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নিতীশ কুমার ফারাক্কা বাঁধ একেবারেই তুলে দেওয়ার কথা সরাসরি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে জানিয়েছেন। তাঁর দাবির মুখে বিহারের বর্তমান পরিস্থিতি দেখতে বিশেষজ্ঞ দলও পাঠানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী মোদী।

বিহার মুখ্যমন্ত্রী নিতীশ কুমারের ফারাক্কা বাঁধ সরানোর প্রস্তাবে এখনো আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া দেখায়নি বাংলাদেশ। আলোচনাটি যেহেতু ভারতের ভেতরেই উঠেছে, তাই আপাতত এ বিষয়ে কিছু না বলে, পরিস্থিতি বুঝে নিতে চাইছে সরকারের সংশ্লিষ্ট মহল।

তবে ভারতের ফারাক্কা বাঁধের কারণে গঙ্গার পানিপ্রবাহের উপাত্ত নিয়ে একটি মূল্যায়নপত্র তৈরি করতে যৌথ নদী কমিশনকে নির্দেশনা দিয়েছে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়।

বিশ্লেষকেরা বলছেন, ফারাক্কা বাঁধের ফলে ভারতের অপর রাজ্য পশ্চিমবঙ্গের কিছুটা সুবিধা হলেও এর ক্ষতিকারক প্রভাব পড়ছে উভয় দেশেই। বাংলাদেশ সবচেয়ে বেশি ক্ষতির সম্মুখীন হয়েও দীর্ঘ কয়েক দশক ধরে শুধু পানির ন্যায্য হিস্যা চেয়ে এসেছে। তবে এবার ভারতের ভেতর থেকেই দাবি উঠেছে বাঁধ সরানোর।

তবে তাঁদের মতে, এই মুহূর্তে বাংলাদেশের খুশি হওয়ার কিছু নেই। কারণ ফারাক্কা পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতির অংশ।তাই আপাতত এ বাঁধ নিয়ে যে হইচই হচ্ছে; বর্ষার পানি কমার সঙ্গে সঙ্গে সেটাও কমে যাবে। বাঁধ থাকবে আগের মতোই। তাই বাংলাদেশকে পানির ন্যায্য হিস্যা পেতেই আলোচনা চালিয়ে যেতে হবে বলে মত দিচ্ছেন কেউ কেউ।

যে কারণে বাঁধ তুলতে বললেন মুখ্যমন্ত্রী

গত মঙ্গলবার বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নিতীশ কুমার প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে দেখা করে গঙ্গা নদীর ওপর নির্মিত ফারাক্কা বাঁধকে পুরোপুরি সরিয়ে দেওয়ার প্রস্তাব দেন বলে জানায় বিবিসি বাংলা, এনডিটিভি, আনন্দবাজারসহ বিভিন্ন গণমাধ্যম।

নীতিশ জানান, ফারাক্কা বাঁধের কারণে বিহার অঞ্চলের প্রায় দুই লাখ মানুষের বাড়ি-ঘর বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এ ছাড়া মধ্য প্রদেশ, উত্তর প্রদেশ এবং ঝাড়খণ্ডেও বন্যা হচ্ছে।

বিবিসি বাংলা জানিয়েছে, ফারাক্কা তৈরি হওয়ার আগে ও পরে বিহারে গঙ্গা নদীর গভীরতা বা নাব্যতা কতটা কমেছে, সে বিষয়ে বিহার সরকারের পক্ষ থেকে এক পরিসংখ্যান নরেন্দ্র মোদীর কাছে তুলে দেওয়া হয়েছে।

একমত নয় পশ্চিমবঙ্গ

এদিকে বিহারে পক্ষ থেকে ফারাক্কা বাঁধ তুলে দেওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হলেও এর সঙ্গে একমত নয় ভারতের আরেক রাজ্য পশ্চিমবঙ্গ। ফারাক্কা বাঁধের সঙ্গে ওই রাজ্যের স্বার্থ ওতপ্রোতভাবে জড়িত।

কলকাতার আনন্দবাজার পত্রিকা জানিয়েছে, এই বাঁধ ভেঙে দেওয়া হলে সবচেয়ে বেশি সমস্যায় পড়বে পশ্চিমবঙ্গ। প্রতি বর্ষা মৌসুমে বন্যায় ভাসবে এখানকার জনপদ।

এ ছাড়া গ্রীষ্মে পানি সংকটে ভুগবে কলকাতাসহ বিস্তীর্ণ এলাকা। নাব্যতা হারিয়ে কার্যত ধ্বংস হয়ে যাবে কলকাতা বন্দর। এসব বিবেচনায় নিয়ে বিহার মুখ্যমন্ত্রীর এ দাবির মুখে পশ্চিমবঙ্গ পাল্টা যুক্তি দেখানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে।

গুরুত্বের সঙ্গে নেবে বাংলাদেশ

ফারাক্কা বাঁধ নিয়ে বিহার মুখ্যমন্ত্রীর অবস্থান সম্পর্কে জানতে বাংলাদেশ সরকারের বিভিন্ন মহলে যোগাযোগ করা হলে এ বিষয়ে কেউই কথা বলতে রাজি হননি। তবে বুধবার দৈনিক প্রথম আলোকে পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ নজরুল ইসলাম বলেন, “ফারাক্কা নিয়ে নিতীশ কুমারের প্রস্তাব গুরুত্বের সঙ্গে নেবে বাংলাদেশ সরকার। এটা নিয়ে ভবিষ্যতে আলোচনা হবে।”

“আমরা যৌথ নদী কমিশনকে এর ওপর একটা অবস্থানপত্র তৈরি করতে বলেছি। সেটি পাওয়ার পরেই আমরা পরবর্তী পদক্ষেপ নেব ঠিক করব,” জানান প্রতিমন্ত্রী।

ফারাক্কা বাঁধ তুলে দেওয়ার প্রস্তাব ইতিবাচক

ফারাক্কা বাঁধ তুলে দিতে বিহার মুখ্যমন্ত্রীর প্রস্তাবকে ইতিবাচক বলে মনে করছেন বাংলাদেশের বিশ্লেষকেরা। তবে রাজনৈতিক কারণে এ প্রস্তাব গুরুত্ব পাবে না বলেও মনে করেন তাঁরা।

এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মৃত্তিকা, পানি ও পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. দিদার-উল-আলম বেনারকে বলেন, “ক্ষতিগ্রস্ত হলেও বাংলাদেশ কখনো ফারাক্কা বাঁধ তুলে দেওয়ার কথা বলতে পারেনি। আমরা শুধু পানির ন্যায্য হিস্যা চেয়েছি। অথচ এতদিন পরে বিহারের মুখ্যমন্ত্রী বাঁধ তুলে দিয়ে অভিন্ন নদীর অকৃত্রিম পানি প্রবাহের কথা বলছেন। এটা যদি হয়, আমরা অবশ্যই সাধুবাদ জানাব।”

তাঁর মতে, “ফারাক্কা বাঁধের কারণে পশ্চিমবঙ্গ কিছুটা সুবিধা পেলেও বিহার পরিবেশগত ক্ষতির সম্মুখীন। তবে সে ক্ষতির চেয়ে মূলত রাজনৈতিক বিবেচনায় বাংলাদেশকে কিছুটা চাপে রাখার জন্য ফারাক্কার পক্ষে পশ্চিমবঙ্গ।”

এ বিষয়ে একই বিভাগের আরেকজন অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ শাহজাহান চৌধুরী বেনারকে বলেন, “যে শঙ্কার কথা গত কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশ বলে আসছে, এবার ভারতের ভেতর থেকেই সে প্রস্তাব উঠেছে। এটা ভাববার মতো বিষয়।”

ফারাক্কার ১০০ গেট খুলে দেবে ভারত

এ দিকে বিহারে প্রস্তাব অনুযায়ী ফারাক্কা বাঁধ তুলে দেওয়া হবে কী হবে না, সে সিদ্ধান্ত সময়ের ব্যাপার হলেও আপাতত প্রদেশটির বন্যা পরিস্থিতির অবনতি নিয়ন্ত্রণে আনতে বাঁধের প্রায় এক শ গেট খুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে দেশটির কেন্দ্রীয় পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়।

গণমাধ্যমগুলো ভারতের কেন্দ্রীয় পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র সমীর সিনহাকে উদ্ধৃত করে জানিয়েছে, ফারাক্কায় একশ চারটি গেটের মধ্যে একশটি গেট খুলে দেওয়া হবে। যার ফলে প্রায় ১১ লাখ কিউসেক পানি সরে গিয়ে বিহারের বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হবে।

এ গেটগুলো খুলে দেওয়ার বিষয়ে বাংলাদেশকে নোটিশ দিয়ে জানানো হয়েছে এবং এ বিষয়ে দুদেশের মধ্যে আলোচনা হয়েছে বলেও উল্লেখ করা হয়।

এই ১১ লাখ কিউসেক পানির প্রবাহ বাংলাদেশে ঢুকে এ অঞ্চলে বন্যা পরিস্থিতি হতে পারে বলে আশঙ্কা করা হলেও সে আশঙ্কাকে উড়িয়ে দিয়েছে বাংলাদেশের বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র।

কেন্দ্রের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বেনারকে বলেন, এখন ব্রহ্মপুত্র-যমুনায় পানি কমার কারণে ভারতের পানি এসে বাংলাদেশ অংশে পদ্মার পানি বাড়াবে। তবে তাতে বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে না।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।