করোনায় পরিবারের অভাব মেটাতে এসে কারখানার অগ্নিকুন্ডে শিশুরা
2021.07.12
ঢাকা

নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে সজীব গ্রুপের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান হাসেম ফুড অ্যান্ড বেভারেজের ফুডস ফ্যাক্টরিতে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় বেরিয়ে আসলো শিশু শ্রমের ঘটনা। ওই ভবনে আগুন লাগার ঘটনায় নিখোঁজ শ্রমিকদের পরিবারের সদস্যরা ডিএনএ নমুনা দিতে এসে যেসব তথ্য দিয়েছেন সেখানে দেখা যাচ্ছে নিখোঁজদের মধ্যে এমন অন্তত ১৬জন রয়েছেন, যারা বয়সে শিশু।
এদিকে বৃহস্পতিবার অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় নিহত, আহত এবং আগুন থেকে বেঁচে যেতে সক্ষম হয়েছেন এমন বেশকিছু শিশু শ্রমিক ও তাদের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, করোনাভাইরাসের মহামারি শুরুর পর থেকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকা এবং লকডাউন পরিস্থিতির কারণে আর্থিক অনটনে পড়েই অধিকাংশ পরিবার তাদের স্কুল–কলেজ পড়ুয়া শিশুদের কারখানায় পাঠিয়েছেন। শিশু শ্রমিকদের অধিকাংশই গত কয়েক মাসের মধ্যে কারখানায় যোগ দেয়।
কর্তৃপক্ষ বলছে, গত সপ্তাহের এই ভয়াবহ আগুনে কমপক্ষে ৫১জন প্রাণ হারিয়েছেন, যাদের মধ্যে ওই ভবনের চারতলায় আটকে পড়ে প্রাণ হারানো ৪৮জনের পরিচয় এখনো সনাক্ত করা যায়নি। তাদের পরিচয় সনাক্তের জন্য পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) ফরেনসিক বিভাগ ডিএনএ টেস্টের জন্য নমূনা সংগ্রহ করছে। এসময় নিখোঁজ স্বজনেরা যে তথ্য দিয়েছেন, তাতে দেখা যাচ্ছে, নিখোঁজদের মধ্যে অন্তত ১৬জন শিশু শ্রমিক রয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে তারা সবাই আগুনে পুড়ে যাওয়াদের মধ্যেই রয়েছে।
“আমি আমার মেয়েকে ঘটনার মাত্র তিনদিন আগে ওই ফ্যাক্টরিতে কাজে পাঠাই। সে একটি মাদ্রাসায় ক্লাস ফোরে পড়তো। আমার পরিবারের অভাবের কারনে মেয়েকে কাজে দিয়েছে,” বেনারকে বলেন অগ্নিকাণ্ডে নিখোঁজ ১২ বছর বয়সি শান্তা আক্তারের মা শিমু আক্তার।
ওই ঘটনায় পুড়ে আহত হয়ে শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে চিকিৎসা নিচ্ছে ১৩ বছর বয়সি নাহিদা আক্তার।
নাহিদার মা সাহানা আক্তার বেনারকে বলেন, পরিবারে আর্থিক সংকট ও করোনাভাইরাসরে কারনে স্কুল বন্ধ থাকায় মেয়েকে চার মাস আগে কাজে দিয়েছেন তিনি।
“অভাবের তাড়নায় আমি আমার মেয়েকে এই বিপজ্জনক পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দিয়েছে,” বলেন সাহানা।
ঘটনার দিন ভবনের দোতলায় কাজ করছিল ১৫ বছর বয়সী মো. রাকিব মিয়া। ভবনে আগুন লাগার খবর শুনে দোতলা থেকে লাফিয়ে নিচে পড়ে নিজেকে রক্ষা করতে সক্ষম হন তিনি।
“আমি এখানে কাজ করতে এসেছি পরিবারের অভাবের কারনে। আমার মা অন্য একটি কারখানায় চাকরি করতো। করোনভাইরাসের সময় তাঁর চাকরি চলে যায়। আমার স্কুল বন্ধ থাকায় আমি এখানে কাজে যোগ দেই,” বলেন রাকিব।
রাকিব আরও জানান, তিনি কিশোরগঞ্জ জেলার একটি স্কুলে অষ্টম শ্রেণির ছাত্র।
রূপগঞ্জের ওই ফ্যাক্টরির পাশেই গোলাকান্দাইল এলাকা। এই এলাকায় এক হৃদয়বিদারক পরিস্থিতির তৈরি হয়েছে। কারণ ওই ফ্যাক্টরিতে কর্মরতদের অধিকাংশই এই এলাকায় থাকেন।
সোমবার ওই গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, চম্পা আক্তার কান্না থামাতেই পারছেন না। কারণ তিনি কারখানা থেকে বের হবার কয়েক মিনিট পরেই কারখানায় আগুন লাগে। আর এসময় চারতলায় কর্মরত ছিলেন তার মা মীনা খাতুন।
“আমি সারা রাত মায়ের জন্য অপেক্ষা করেছি কারখানার সামনে। তিনি আর ফিরে আসেননি। আমি কাজ করতাম দোতলায় মা ছিল চারতলায়,” বলেন চম্পা।
চম্পা শ্রমিকদের হাজিরা খাতা দেখভাল করতেন। তিনি বলেন, অনেক মেয়েকে তিনি কারখানায় কাজ করতে দেখেছেন যাদের অধিকাংশেই অল্প বয়সি; অষ্টম ও নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী।
অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় কারখানা মালিক মোহাম্মদ আবুল হাসেম ও তার চার ছেলেসহ কারখানর তিন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলার বাদি নাসির উদ্দিন মজুমদার বেনারকে বলেন, কিছুদিন আগে কারখানার সামনে বকেয়া পাওনার দাবিতে বিক্ষোভ করতে দেখেছেন তিনি। সেই বিক্ষোভে অনেক শিশু শ্রমিক দেখেছেন বলে তিনি দাবি করেন।
তবে শিশু শ্রমের বিষয়ে হাসেম ফুডসের মূল প্রতিষ্ঠান সজিব গ্রুপের ভ্যাট ম্যানেজার মো. নুরুজ্জামান বেনারকে বলেন, তাদের কারখানা শিশু শ্রমের বিরুদ্ধে।
“কিছু কিছু সময় মেয়েরা বোরকা পরে চাকরির জন্য আসলে তাদের বয়স বোঝা যায় না। এ কারনে কিছু অল্প বয়সী মেয়ে কাজে ঢুকে পড়ার সুযোগ পায়। তা ছাড়া এসব নিয়োগ কারখানা পর্যায়েই হয়। মালিকরা এ বিষয়ে কিছু জানেন না,” দাবি করেন নুরুজ্জামান।
কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর নারায়ণগঞ্জ কার্যালয়ের প্রধান সৌমেন বড়ুয়া বেনারকে বলেন, হাসেম ফুডস লিমিটেডের কারখানায় শিশু শ্রমের বিষয় তিনি অবগত নন।
তিনি বলেন, বাংলাদেশের শ্রম আইনে ১৪ বছর থেকে ১৮ বছরের নিচের ব্যাক্তিদের ‘কিশোর শ্রমিক’ বলা হয়েছে। ওই কারখানায় কিশোর শ্রমিক থাকতে পারে হয়তো।
“তা ছাড়া গত দেড় বছরে কারখানাগুলো স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলছে কিনা সেদিকে নজর দিতে গিয়ে অন্য অনেকদিকে নজর রাখা আমাদের জন্য কঠিন হয়ে পড়েছে,” বলেন সৌমেন বড়ুয়া।
বাংলাদেশ গার্মেন্টস অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল ওয়ার্কার্স ফেডারেশনের সভাপতি কল্পনা আক্তার বেনারকে বলেন, অবহেলা, অপ্রতুল আইন এবং অন্যান্য ত্রুটির বিষয়গুলো আবারো চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখালো এই অগ্নিকাণ্ড।
“কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর ১৯৯০ সালে দেশের ইতিহাসে প্রথম বড় ধরনের কারখানা অগ্নিকাণ্ডের সময় বলেছিল, তাদের প্রয়োজনীয় লোকবল নেই। এখন ২০২১ সালে এসেও একই কথা বলছে এটা কোন যুক্তি হতে পারে না,” বলেন কল্পনা।
বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের পরিচালক মো. আবদুস শহীদ কারখানায় শিশু শ্রমিকদের নিয়োগ দেয়া এবং এটি দেখভাল করতে ব্যর্থতার জন্য দায়ীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেন।
ইন্ডাস্ট্রিয়াল গ্লোবাল ইউনিয়ন ও ইউনিয়ন নেটওয়ার্ক ইন্টারন্যাশনাল গ্লোবাল ইউনিয়নের নেতারা এই ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করে বাংলাদেশের কারখানগুলোতে শ্রমিকদের নিরাপত্তা আরো জোরদার করার স্বার্থে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণের আহবান জানিয়েছেন।
গত শনিবার সজীব গ্রুপের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আবুল হাসেমসহ আট জনের চার দিনের করে রিমান্ড মঞ্জুর করেছে আদালত। নারায়ণগঞ্জ সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট ফাহমিদা খাতুন এ রিমান্ড মঞ্জুর করেন।