চালের দাম অস্বাভাবিক বেড়েছে, সংকটে স্বল্প আয়ের মানুষ

পুলক ঘটক
2017.09.19
ঢাকা
চালের দাম অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়ার প্রেক্ষাপটে সরকার খোলাবাজারে ন্যায্যমূল্যে চাল বিক্রি শুরু করেছে। চালের দাম অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়ার প্রেক্ষাপটে সরকার খোলাবাজারে ন্যায্যমূল্যে চাল বিক্রি শুরু করেছে। ১৯ সেপ্টেম্বর ২০১৭।
নিউজরুম ফটো

দেশে মোটা চালের দাম এক সপ্তাহের ব্যবধানে কেজিপ্রতি ১০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। ফলে প্রধান এই খাদ্যপণ্য কিনতে গিয়ে খেটে খাওয়া দিনমজুর ও মধ্যবিত্তদের নাভিশ্বাস উঠছে।

দাম বৃদ্ধির জন্য ধান থেকে চাল উৎপাদনকারী বড় বড় মিল মালিকদের আড়তদার ও সরকারের দিক থেকে দায়ী করা হলেও তাঁরা বলছেন বেশি আমদানিমূল্যই চালের দাম বাড়ার জন্য দায়ী।

“মিলাররা সংকট তৈরি করছে এ অভিযোগ ডাহা মিথ্যা। বিদেশ থেকে চালের আমদানিমূল্য বেশি হচ্ছে। এর ফলে দেশের বাজারেও দাম বাড়ছে,” বেনারকে বলেন দিনাজপুর চাল কল মালিক সমিতির সভাপতি মোসাদ্দেক হোসেন।

ইতিমধ্যে দেশের বিভিন্ন স্থানে মজুতদারদের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করেছে সরকার। রাজশাহী, নাটোর, ফরিদপুর, গাজীপুর এবং কুষ্টিয়ায় বেশ কিছু গুদামে এবং দোকানে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে গ্রেপ্তার ও জরিমানা করার খবর পাওয়া গেছে।

গত সোমবার থেকে মঙ্গলবার দুপুর পর্যন্ত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে অভিযান পরিচালনা করে অন্তত ২ লাখ ৭০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে বলে বেনারকে জানিয়েছেন নাটোরের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মো. রাজ্জাকুল ইসলাম।

সরকারের সঙ্গে মিল মালিকদের বৈঠক

এদিকে সরকারের তিন প্রভাবশালী মন্ত্রী-বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ, কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী ও খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম গতকাল মঙ্গলবার সচিবালয়ে চালকল মালিকদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন ।

বৈঠকে বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ সরাসরি বলেন, “অসাধু ব্যবসায়ীরাই চাল গুদামজাত করে কৃত্রিম সংকট তৈরি করছে।”

তবে ব্যবসায়ীরা বৈঠকে বলেছেন, চালের জোগান কম থাকায় বাজারে তার প্রভাব পড়েছে। সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে চালের জোগান বাড়ানোর জন্য তারা সরকারের কাছে দাবি জানান। তাঁরা সরকারের কাছে চাল আমদানি ও পরিবহনে পাটের বস্তার পরিবর্তে প্লাস্টিকের ব্যাগ ব্যবহারের অনুমতি চেয়েছেন। সেই সঙ্গে স্থলবন্দর দিয়ে চালবাহী ট্রাকগুলো যাতে দ্রুত আসতে পারে, সে ব্যবস্থা করার দাবি জানিয়েছেন।

বৈঠকে আড়তদার ও চাল ব্যবসায়ীদের এসব দাবি মেনে নেওয়া হয়েছে, এর ফলে অচিরেই বাজারে চালের দাম কিছুটা কমবে বলে আশা করছে সরকার।

কী অবস্থা বাজারের?

দেশের নিম্ন মধ্যবিত্ত ও স্বল্প আয়ের মানুষ মোটা চালই বেশি কিনে। পাইকারি ও খুচরা উভয় বাজারেই এই চালের দাম বেড়েছে।

পাইকারি বাজারে এক সপ্তাহ আগে মোটা চালের দাম ছিল কেজি প্রতি ৪১-৪২ টাকা। মঙ্গলবার ঢাকার কাওরানবাজার, বাবুবাজার ও বাদামতলীর পাইকারি বাজারে খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, মোটা চাল ৫০-৫২ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে।

অন্যান্য চালের দামও প্রায় একই হারে বেড়েছে বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। কাওরানবাজারে প্রতি কেজি মিনিকেট চাল এক সপ্তাহ আগে ৫২-৫৩ টাকায় বিক্রি হয়েছে। বর্তমানে এর দাম উঠেছে মান ভেদে ৫৮-৬০ টাকা পর্যন্ত। এক সপ্তাহ আগে নাজিরশাইল চাল বিক্রি হয়েছে ৫৮-৬০ টাকায়। এখন তার দাম ৬৮-৭০ টাকা।

বাদামতলী-বাবুবাজার চাল আড়তদার সমিতির সাংগঠনিক সম্পাদক হাজি রফিকুল ইসলাম বেনারকে বলেন, “তিন-চার দিন ধরে বড় চালকল মালিকেরা সরবরাহ আদেশ নিচ্ছেন না। তবে হাসকিং মিল মালিকেরা এখনো চাল সরবরাহ দিচ্ছেন।”

পাইকারি বাজারে দাম বাড়ায় খুচরা পর্যায়েও দাম বেশি। সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) তথ্য অনুযায়ী, সোমবার রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় খুচরা বাজারে প্রতি কেজি মোটা চাল বিক্রি হয় ৫০-৫৪ টাকায়। এক সপ্তাহ আগেও এ চাল বিক্রি হয়েছিল প্রতি কেজি ৪৩-৪৫ টাকায়।

“মোটা চালের দাম ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে যাওয়ায় নিম্ন আয়ের লোকজন কষ্টে আছে। সরকার চাল আমদানি শুল্ক ২ শতাংশে নামিয়ে আনলেও বাজারে তার প্রভাব নেই,” বেনারকে বলেন কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট হ‌ুমায়ূন কবির ভূঁইয়া।

দ্বিগুণ দামে ওএমএস

বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকার খোলা বাজারে চাল বিক্রি শুরু করেছে। তবে এর দাম বাড়িয়ে দ্বিগুণ করেছে। এ আগের নির্ধারিত ১৫ টাকার সরকারি চাল এখন কিনতে হচ্ছে ৩০ টাকায়।

এর কারণ ব্যাখ্যা করে খাদ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. বদরুল হাসান বেনারকে বলেছেন, “বাজারের তুলনায় মূল্য ব্যবধান অতিমাত্রায় বেশি হলে অপব্যবহার হয়। এ জন্যই মূল্য সমন্বয় করা হয়েছে।”

তিনি বলেছেন, “রোববার থেকে সারা দেশে মোট ৬২৭টি ট্রাকে করে খোলাবাজারে চাল ও আটা বিক্রি করা হচ্ছে। ঢাকায় ১২০টি ট্রাক ঘুরছে। প্রতি ট্রাক থেকে দুই টন আটা ও এক টন চাল বিক্রি করা হবে। ঢাকার বাইরে বিক্রি হবে শুধু চাল।”

তবে সরকার খোলা বাজারে যে চাল বিক্রি করছে সেটা সিদ্ধ নয়, আতপ চাল। দেশের বেশির ভাগ অঞ্চলের মানুষ আতপ চালের ভাত খেতে অভ্যস্ত না হওয়ায় ওএমএস এর চাল কিনতে আগ্রহী হচ্ছে না মানুষ।

চালের আমদানি শুল্ক

মজুত ভালো থাকায় আমদানি নিরুৎসাহিত করতে ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে চালের শুল্কহার ১০ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ২৫ শতাংশ করেছিল সরকার। এর সঙ্গে রেগুলেটরি ডিউটি তিন শতাংশ যোগ হওয়ায় ব্যবসায়ীদের ২৮ শতাংশ শুল্ক গুনতে হতো।

ফলে গত দেড় বছর ধরে বেসরকারি পর্যায়ে চাল আমদানি প্রায় বন্ধ ছিল। কিন্তু এ বছর মজুতে ঘাটতি দেখা দেওয়ায় চাল আমদানি বাড়ানোর জন্য গত রমজানে মাসে শুল্কহার কমিয়ে ১০ শতাংশ করা হয়।

আগস্টের মাঝামাঝিতে এসে আরও ৮ শতাংশ কমিয়ে নির্ধারণ করা হয় মাত্র ২ শতাংশ। ব্যাংকগুলোকে বিনা বিনিয়োগে আমদানি ঋণপত্র (এলসি) খোলার অনুমতি দেওয়া হয়। তার পরও বাজারে এর প্রভাব পড়েনি।

মজুদ ও আমদানী পরিস্থিতি

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে দেশে তিন কোটি ৪৯ লাখ ৬৮ হাজার টন চাল উৎপাদিত হয়েছে। চলতি অর্থবছরে উৎপাদনের লক্ষ্য ছিল তিন কোটি ৫০ লাখ টন।

তবে হাওর অঞ্চলে বন্যা এবং ১৯ জেলায় ধানখেতে ছত্রাকের আক্রমণে (ব্লাস্ট রোগ) এ বছর ১০ লাখ টনের বেশি বোরো ধান নষ্ট হয়েছে।

এরপরও দেশে বর্তমানে এক কোটি টন চালের মজুত আছে বলে জানিয়েছেন খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম।

তবে সারা দেশের কলমালিক ও পাইকারি ব্যবসায়ীরা সরকারকে জানিয়েছে, তাদের কাছে সর্বসাকুল্যে প্রায় ৬ হাজার টন ধান ও সাড়ে ৫ হাজার টন চাল আছে।

ব্যবসায়ীদের কাছে মজুতের হিসাব জানতে এর আগে চিঠি দিয়েছিল সরকার। গত সপ্তাহে সব জেলা থেকে পাওয়া চিঠির জবাব একত্রিত করে এই পরিমাণ মজুতের ধারণা পাওয়া যায়।

এ বাস্তবতায় মিয়ানমারের কাছ থেকে এক লাখ টন আতপ চাল কেনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। গত রবিবার সন্ধ্যায় হোটেল সোনারগাঁওয়ে দুই দেশের মধ্যে এক বৈঠকে আমদানির চুক্তি চূড়ান্ত করা হয়েছে বলে সাংবাদিকদের জানিয়েছেন খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম।

এর আগে ভিয়েতনাম থেকে জরুরি ভিত্তিতে তিন লাখ টন চাল আমদানির জন্য সমঝোতা স্মারক করা হয়। এ ছাড়া আরও দেড় লাখ টন চাল আমদানি করতে গত দুই সপ্তাহের মধ্যে তিনটি আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বান করেছে বাংলাদেশ।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।