অপহরণের ১৮ ঘন্টা পর ফরহাদ মজহার উদ্ধার
2017.07.03
ঢাকা

রাজনৈতিক ভাষ্যকার ফরহাদ মজহারকে গতকাল সোমবার ভোরে ঢাকা থেকে তুলে নেওয়ার প্রায় ১৮ ঘন্টা পর যশোরের অভয়নগর থেকে উদ্ধার করা হয়েছে। রাত পৌনে ১২টার দিকে এ তথ্যের সত্যতা নিশ্চিত করেছেন ফরহাদ মজহারের স্ত্রী ফরিদা আক্তার।
“কিছুক্ষণ আগে আমাকে একজন ফোন করেন। তিনি নিজেকে র্যাব সদস্য বলে পরিচয় দেন ও জানান ফরহাদ মজহার এখন তাঁদের হেফাজতে আছেন,” বেনারকে বলেন ফরিদা আক্তার।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বরাত দিয়ে বলা হচ্ছে, তাঁকে খুলনার নিউমার্কেট এলাকায় দেখা যায়। রাত ৮টা ২০ মিনিটে তিনি গ্রীল হাউস নামের একটি খাবার দোকানে ছিলেন। তাঁকে যশোর থেকে ঢাকাগামী একটি বাস থেকে র্যাব উদ্ধার করে।
এর আগে র্যাব ৬ এর পরিচালক খন্দকার রফিকুল ইসলাম জানান, খুলনা শহরের কেডিএ এলাকায় ফরহাদ মজহার দীর্ঘসময় অবস্থান করেন। সে কারণে ওই এলাকার প্রতিটি বাড়ি ও গাড়িতে অভিযান চালানো হয়।
গতকাল ভোর ৫টা ৫ মিনিটে ঢাকার শ্যামলীর নিজ বাড়ি থেকে বের হন ফরহাদ। এরপর থেকে তাঁর আর কোনো খোঁজ ছিল না। দিনভর বিষয়টি নিয়ে আলোচনা–সমালোচনা হয়, রাতে নাটকীয়ভাবে তিনি উদ্ধার হন।
রাত সাড়ে ১০টার দিকে ফরহাদ মজহারের স্ত্রী ফরিদা আক্তার তাঁদের শ্যামলীর বাসায় একটি সংবাদ সম্মেলন করেন। তিনি বলেন, রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তাঁদের উৎকণ্ঠা বাড়ছে।
“সরকারের উচ্চ পর্যায়কে বলতে চাই, তিনি যেন আজ রাতেই জীবিত ও অক্ষত অবস্থায় ফিরে আসেন,” ফরিদা আক্তার বলেন।
ওই সংবাদ সম্মেলনে গণবিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোক্তা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী উপস্থিত ছিলেন। তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রীর প্রজ্ঞার তুলনা নেই। ফরহাদ মজহার অপহৃত হয়েছেন, এটি তাঁর অজানা থাকার কথা নয়।
গতকাল রাত পযর্ন্ত ফরহাদ মজহারকে কী কারণে অপহরণ করা হয়েছে সে সম্পর্কে জানা যায়নি। স্থানীয় সময় রাত পৌণে একটায় শেষ খবর পাওয়া যায়, জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তাঁকে খুলনায় নেওয়া হচ্ছে।
দিনভর ফরহাদ মজহারের অপহরণ নিয়ে বাংলাদেশের রাজনীতি ও সংবাদমাধ্যমগুলো ছিল সরগরম।
ফরহাদ মজহারের আকস্মিক নিখোঁজ হওয়ার ঘটনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে বিএনপি। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে তারা নয়াপল্টন কার্যালয়ে একটি তাৎক্ষণিক সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে। ওই সম্মেলনে দলের পক্ষে জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, তাঁকে টার্গেট করে সরকারের কোনো বাহিনী তুলে নিয়ে গেছে।
এর আগে বিকেলের দিকে শ্যামলীর হক গার্ডেনে ফরহাদ মজহারের বাড়ির নিচ তলার গ্যারেজে দাঁড়িয়ে তাঁদের পারিবারিক বন্ধু শিরীন হক, গৌতম দাশ ও মোস্তাইন জহির কথা বলেন।
গৌতম দাশ বলেন, তিনি খুব সকালে কেন, কার ডাকে বাড়ি থেকে বেরিয়েছিলেন সেটাই একটা বিস্ময়। তাঁরা পুলিশের সঙ্গে কথা বলে ধারণা করছেন, বাড়ির মূল ফটক থেকে বের হওয়ার পরপরই কে বা কারা তাঁকে তুলে নিয়ে যায়।
“ফরহাদ মজহার রাত ৩টার দিকে ঘুম থেকে ওঠেন ও লেখাপড়া করেন। সকাল ৯টা বা ১০টার আগে বাড়ি থেকে বের হন না। গতকাল ভোর সাড়ে ৫টার দিকে একটা অচেনা নম্বর থেকে স্ত্রী ফরিদার কাছে ফোন আসে। ফোনে ফরহাদ বলে, ওরা আমাকে তুলে নিয়ে যাচ্ছে, ওরা আমাকে মেরে ফেলবে,” বেনারকে বলেন গৌতম দাশ।
সকাল ১০টার দিকে ফরিদা আক্তার এক ব্যক্তিকে দিয়ে আদাবর থানায় ফরহাদ মজহার নিখোঁজ হওয়ার বিষয়ে অভিযোগ দেন বলে জানান আদাবর থানার উপপরিদর্শক আলেয়া আক্তার। এর পরপরই তেজগাঁও ডিভিশনের উপকমিশনারসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা তাঁদের বাড়িতে যান।
“আমরা হক গার্ডেন থেকে ৫ টা ৫ মিনিটের একটা ভিডিও ফুটেজ পেয়েছি। তিনি খুব স্বাভাবিকভাবেই বেরিয়ে যাচ্ছিলেন। এরপর আর কোনো খবর পাওয়া যায়নি। আমরা শ্যামলীতে তাঁর বাসা থেকে মূল সড়ক পর্যন্ত যতগুলো সিসি ক্যামেরা আছে সবগুলোর ফুটেজ খুঁটিয়ে দেখছি,” আলেয়া আক্তার বলেন।
এর আগে তেজগাঁও বিভাগের উপকমিশনার বিপ্লব কুমার সরকার সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন, তাঁরা ফরহাদ মজহারকে খুঁজে পেতে সর্বাত্মক চেষ্টা চালাচ্ছেন। তাঁর অবস্থান একবার মানিকগঞ্জ ও একবার মাগুরায় দেখা গেছে।
আলোচিত সমালোচিত ফরহাদ মজহার
নানা কারণে আলোচনা-সমালোচনার জন্ম দিয়েছেন ফরহাদ মজহার। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসি থেকে পাস করার পর যুক্তরাষ্ট্রের একটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে উচ্চতর লেখাপড়া করে তিনি দেশে ফেরেন। দেশে ফিরে তিনি ও তাঁর স্ত্রী ফরিদা আক্তার নয়া কৃষি আন্দোলন গড়ে তোলেন।
এক সময়ের প্রগতিবাদী চেতনার অধিকারী ফরহাদ মজহারকে সাম্প্রতিক সময়ে উচ্চ কণ্ঠে সরকারের নেওয়া বিভিন্ন পদক্ষেপের সমালোচনা করতে শোনা গেছে। কখনো কখনো ইসলামপন্থী দলগুলোর পক্ষেও কথা বলেন তিনি। তিনি নিয়মিত বিরোধী দল বিএনপি আয়োজিত অনুষ্ঠানে যোগ দেন।
প্রধানমন্ত্রীর তথ্য উপদেষ্টা ইকবাল সোবহান চৌধুরী বেনারকে বলেন, “ফরহাদ মজহার সম্প্রতি তার বিভিন্ন বক্তব্য ও কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে নিজেকে রহস্যজনক ও বিতর্কিত ব্যক্তিতে পরিণত করেছেন।
“তিনি প্রগতিশীল চিন্তা চেতনার কথা বলেন অথচ হেফাজতে ইসলাম ও মৌলবাদী গোষ্ঠীকে প্রণোদনা দেন। তার বিরুদ্ধে সরকারি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও তদন্তকারীদের কাছে তথ্য আছে। তার বিতর্কিত কর্মকাণ্ড নিয়ে অনেকের মনেই সন্দেহ ও প্রশ্ন আছে। এই বিতর্কের অবসান একমাত্র তিনিই করতে পারেন,” বলেন ইকবাল সোবহান চৌধুরী।
ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মুক্তিযোদ্ধা আফসান চৌধুরী বেনারকে বলেন, “এ ধরনের ঘটনায় আমরা সবাই চিন্তিত। এতে সাধারণ মানুষের মধ্যে উদ্বেগ তৈরি হচ্ছে। এটি কেবল ফরহাদ মজহারের নিরাপত্তার বিষয় নয়, সকল মানুষের বিষয়। এমন পরিস্থিতি কারও বেলায় কাম্য নয়।”
উল্লেখ্য, ফরহাদ মজহার গত রোববার ভারতে গো–রক্ষা আন্দোলনের নামে মুসলমানদের হত্যা বিষয়ে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে বক্তৃতা করেন। ওই সম্মেলনের আয়োজন করেন বন্ধ হওয়া আমার দেশ পত্রিকার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মাহমুদুর রহমান।
প্রতিবেদনে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন পুলক ঘটক