ফরহাদ মজহার নিজে অপহরণের ঘটনা সাজিয়েছেন: আইজিপি
2017.07.13
ঢাকা

ফরহাদ মজহার অপহৃত হননি। তিনি স্বেচ্ছায় আত্মগোপনে যান। সরকারকে বিব্রত করতে তিনি অপহরণের ঘটনা সাজিয়েছেন। বৃহস্পতিবার সংবাদ সম্মেলন করে এমন দাবি করেছেন পুলিশের মহাপরিদর্শক শহীদুল হক।
পুলিশ মহাপরিদর্শকের এই বক্তব্যের মধ্য দিয়ে কবি ও বুদ্ধিজীবী ফরহাদ মজহার ‘অপহরণ’ ঘটনা নাটকীয় মোড় নিল। অপহরণের দিনের কিছু ভিডিও ফুটেজও নতুন প্রশ্নের সামনে এনে দাঁড় করিয়েছে। এমন অবস্থায় অনেকেই আর সরাসরি ফরহাদ মজহারের পক্ষে কথা বলছেন না, কয়েক দিন আগেও যারা তাঁর ‘অপহরণের’ বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন।
গত ৩ জুলাই রাজধানীর আদাবর থানায় ফরিদা আকতার অভিযোগ করেন, ফরহাদ মজহার নিখোঁজ। প্রায় সাড়ে ১৮ ঘণ্টা পর ওই দিনই রাত সাড়ে ১১ টার দিকে যশোরের অভয়নগর থেকে তাঁকে উদ্ধার করা হয়।
গতকাল বৃহস্পতিবার পুলিশ তাদের বক্তব্যের সমর্থনে ‘অপহরণের’ দিন বিকেল ৪ টা থেকে ৬টা পর্যন্ত খুলনা নিউমার্কেটে ধারণ করা চারটি সিসিটিভি ফুটেজ সাংবাদিকদের দেখান।
ওই ফুটেজগুলোয় ফরহাদ মজহারকে খুলনা নিউমার্কেট এলাকায় একা একা ঘুরতে দেখা যায়। এ সময় তাঁর পরনে ছিল সাদা পাঞ্জাবি, লুঙ্গি, মাথায় সাদা পাগড়ি ও হাতে সাদা রং এর ব্যাগ। কোনো কোনো সময় তিনি লুকানোর চেষ্টা করছেন বলেও মনে হয়েছে।
সন্ধ্যা ৭টার দিকে তাঁকে নিউমার্কেটের পাশের একটি মার্কেটে দেখা যায়। সেখান থেকে তিনি কোথাও টাকা পাঠান এবং কাউকে ফোন করেন। পুলিশ বলছে, ওই টাকা তিনি উবিনীগের সাবেক এক নারী কর্মীকে পাঠান। তাঁর জন্যই তিনি এই অপহরণের ঘটনা সাজিয়েছেন।
“কেউ অপহৃত অবস্থায় টাকা পাঠাবে, মার্কেটে মার্কেটে ঘুরে বেড়াবে—এগুলো অবাস্তব না? ৩ জুলাই ঘটনার আগে ফরহাদ মজহার একজন নারীর সঙ্গে কথা বলেন। ওই নারী তাঁর কাছ থেকে ৩৫ লাখ টাকা চেয়েছিলেন। বিষয়টা নিয়ে তিনি বেশ উদ্বিগ্নও ছিলেন। টাকা যোগাড় করতেই তিনি ওই ঘটনা সাজান,” সংবাদ সম্মেলনে বলেন একেএম শহীদুল হক।
পুলিশ মহাপরিদর্শক আরও বলেন, নিখোঁজ অবস্থায় মুঠোফোন থেকে তিনি দশবার স্ত্রী ফরিদা আকতার ও ছয়বার উবিনীগের সাবেক এক নারী কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলেন।
তবে গতকাল পুলিশ মহাপরিদর্শকের বক্তব্যের তাৎক্ষণিক কোনো প্রতিক্রিয়া দেননি ফরহাদ মজহার। ফরহাদ মজহারের স্ত্রী ফরিদা আকতার বেনারকে বলেছেন, অপহরণের ঘটনাকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করতে নানা কাহিনির অবতারণা করা হচ্ছে।
“অপহরণের বিষয়টিকে অন্যদিকে নেওয়ার জন্যই এটার করা হচ্ছে। ফরহাদ মজহারকে উদ্ধারে পুলিশ যে পেশাদারি দেখিয়েছে, তদন্তেও একইরকম পেশাদারি দেখাবে বলে এখনো আশা করি আমি,” বলেন ফরিদা আকতার।
জবানবন্দির সঙ্গে পুলিশের তদন্ত মিলছে না
আদালতে ১৬৪ ধারায় দেওয়া জবানবন্দিতে ফরহাদ মজহার বলেন, ৩ জুলাই তিনি চোখের ওষুধ কিনতে ভোরবেলা বাসা থেকে বের হন। এরপরপরই দুর্বৃত্তরা তাঁকে একটি মাইক্রোবাসে তুলে ফেলে। তারা তাঁকে মারধর করে এবং তিনি বাড়াবাড়ি করছেন বলে শাসায়। ফরহাদ মজহারের চোখও বেঁধে ফেলে তাঁরা। সন্ধ্যা ৭টার দিকে তাঁর চোখের বাঁধন খুলে খুলনায় ছেড়ে দেওয়া হয়।
“যারা আমাকে তুলে নিয়ে গিয়েছিল, আমি তাদের চিনি না। তারা আমাকে কোনো কিছুর বিনিময় ছাড়াই ছেড়ে দেয়। আমার কাছে সবচেয়ে যেটি বেশি মনে হচ্ছে যারা বর্তমান সরকারকে পছন্দ করে না, তারা সরকারকে দেশের মধ্যে ও বিশ্ব দরবারে বিব্রত করানোর জন্য আমাকে তুলে নিয়ে গিয়েছিল,” ফরহাদ মজহার জবানবন্দিতে উল্লেখ করেন।
পুলিশের মহাপরিদর্শক একেএম শহীদুল হক বলছেন, সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টির একটি মাধ্যম হিসেবে অপহরণকে কাজে লাগিয়েছে সরকার বিরোধী পক্ষ।
পুলিশের সহকারী মহাপরিদর্শক (গোপনীয়) মো. মনিরুজ্জামান বেনারকে বলেন, তাঁর জবানবন্দিতে গরমিল পাওয়া যাচ্ছে।
“খুলনায় বিকেল ৪টার সময় তাঁকে স্বাধীনভাবে ঘুরতে দেখা গেছে। অথচ তিনি বলছেন ৭টা পর্যন্ত তাঁর চোখ বাঁধা ছিল,” মনিরুজ্জামান বলেন। এ বিষয়গুলো সুরাহা হওয়া প্রয়োজন।
তবে ফরহাদ মজহার কী করে খুলনা পৌঁছালেন সে সম্পর্কে কিছু জানাতে পারেনি পুলিশ। তারা বলছে, এ জন্য ফরহাদ মজহার সুস্থ হওয়া পর্যন্ত তারা অপেক্ষা করবে। এসব প্রশ্নের উত্তর তিনিই দিতে পারবেন।
তিনি যদি মিথ্যা বলে থাকেন, তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হবে কিনা—এমন প্রশ্নে পুলিশের মহাপরিদর্শক শহীদুল হক বলেন, “উনি তদন্তকে চ্যালেঞ্জ করলে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া যায় কি না পুলিশ তা ভেবে দেখবে।”
সংশয়ে অনেকেই
ভিডিও ফুটেজ প্রকাশের পর ফরহাদ মজহারের ভক্ত–অনুরাগী ও উবিনীগের কর্মীদের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। তাঁর অন্যতম সহচর নুরুল ইসলাম ছোটন বলেন, সবকিছু ভিডিও ফুটেজে দেখার পর আসলে তিনি কী করবেন বুঝে উঠতে পারছেন না।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যারা ফরহাদ মজহারের নিরাপদ প্রত্যাবর্তন চেয়ে প্রোফাইল ফটো পরিবর্তন করেছিলেন, তাঁরা প্রোফাইল ফটো নামিয়ে নিয়েছেন। তাঁর ভক্ত অনুরাগীদের অনেকে তাঁকে এড়িয়েও চলছেন।
তবে উবিনীগের পরিচালক সীমা দাস শিমু বলেছেন এসব কথা অসত্য।
“আমরা সবাই ফরহাদ ভাইকে খুব ভালোবাসি। কেউ তাঁকে ছেড়ে চলে গেছেন, বা অপহরণের ব্যাপারে অন্তত তাঁদের মনে কোনো সংশয় আছে বলে আমি মনে করি না,” বেনারকে বলেন সীমা দাস।
এদিকে যুক্তরাজ্যভিত্তিক পত্রিকা দ্য গার্ডিয়ানকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ফরহাদ মজহার বলেছেন, তিনি চুপ করে থাকবেন না। অপহরণের ব্যাপারে অচিরেই মুখ খুলবেন।