চুলের স্টাইলের ওপর পুলিশি নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার

প্রাপ্তি রহমান
2019.03.25
ঢাকা
190315_Hair_style_1000.jpg বিভিন্ন চুলের স্টাইলের মডেলদের ছবি দিয়ে সাজানো ঢাকার একটি সেলুন। ২৫ মার্চ ২০১৯।
[মেঘ মনির/বেনারনিউজ]

স্টাইল করে চুল-দাঁড়ি-গোঁফ কাটলে জরিমানা দিতে হবে মর্মে পুলিশের দেওয়া নোটিশটি প্রত্যাহার করে নিয়েছে টাঙ্গাইলের ভূঞাপুর উপজেলা প্রশাসন।

সরকারি বিধিমালায় এ ধরনের নিষেধাজ্ঞা জারির সুযোগ নেই তাই আদেশটি প্রত্যাহার করা হয়েছে বলে বেনারকে জানান উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ঝোটন চন্দ।

“প্রথমত, কে কীভাবে চুল কাটবে সেটা একান্তই তার স্বাধীনতা। এখানে হস্তক্ষেপের সুযোগ নেই, দ্বিতীয়ত, ৪০ হাজার টাকা জরিমানা করার এখতিয়ারও প্রশাসনের নেই,” ঝোটন চন্দ বলেন।

গত ৭ মার্চ ভূঞাপুর উপজেলায় একটি নোটিশ ইস্যু করা হয়। উপজেলা শীল সমিতির সভাপতি শেখর চন্দ্র শীল, সাধারণ সম্পাদক অরুণ চন্দ্র শীল ও থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) রাশিদুল হাসান স্বাক্ষরিত ওই নোটিশে বলা হয়, স্টাইল করে চুল, দাঁড়ি ও গোঁফ কাটায় সরকারি নিষেধাজ্ঞা জারি হয়েছে।

“এই আদেশ অমান্যকারীর বিরুদ্ধে ৪০ হাজার টাকা অর্থদণ্ডসহ আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে,” বলা হয় ওই নোটিশে।

তবে নোটিশে স্বাক্ষরকারী ভূঞাপুর থানার ওসি রাশিদুল হাসানের দাবি, স্থানীয় অভিভাবক ও শিক্ষকেরাই কিশোর-তরুণদের চুল কাটার ব্যাপারটা নিয়ে কিছু একটা করার অনুরোধ করেছিলেন।

“আসলে তাঁদের অনুরোধের পরিপ্রেক্ষিতেই নোটিশটা আসে। তাঁরাই নোটিশটা লিখে এনেছিলেন। আমি স্বাক্ষর দিয়েছি,” বেনারকে বলেন রাশিদুল হাসান।

কথা হচ্ছিল শীল সমিতির সভাপতি শেখর চন্দ্র শীলের সঙ্গে। তিনি বলছিলেন, স্কুলের ওপরের ক্লাসে পড়া কিশোর ও কলেজ পড়ুয়া তরুণেরা চুল-গোঁফ-দাঁড়ির ফ্যাশনটা করে। একেক মৌসুমে একেক রকম। যেমন বিশ্বকাপ ফুটবলের সময় অনেকেই প্রিয় খেলোয়াড়ের মতো করে চুল কাটতে চাইত। কেউ কেউ পছন্দের নায়কের মতো চুল কাটতে চায়। স্থানীয় পুলিশ মনে করছে, এমন স্টাইলে কিশোর-তরুণদের বখাটেদের মতো দেখায়।

“ওসি সাহেব আমাদের ডাকলেন। বললেন, সমাজটা সবার। ছেলেরা যেভাবে চুল-গোঁফ-দাঁড়ি কাটছে তাতে তাদের দেখতে বখাটেদের মতো লাগে। আমরা ভাবলাম, সমাজের জন্য যেটা ভালো সেটাই করা উচিত। তিনি একটা জরিমানাও ধার্য করলেন। আমরাও সবাইকে জানিয়ে দিলাম কীভাবে চুল কাটতে হবে,” বেনারকে বলেন শেখর চন্দ্র শীল।

নোটিশটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ মূল ধারার গণমাধ্যমগুলোয় ব্যাপক সাড়া ফেলে। বড় অংশই পুলিশের এই ভূমিকার সমালোচনা করেন। তবে “চুল-দাঁড়ি-গোঁফ কাটার নোটিশটি নিয়ে এত হৈ চৈ হবে” তা বুঝতে পারেননি বলে মন্তব্য করেন রাশিদুল হাসান।

‘চুলের সাথে বখাটেপনার কী সম্পর্ক’

ভূঞাপুরের নোটিশ নিয়ে আলোচনার সূত্রপাত হলেও, এর মাস কয়েক আগে টাঙ্গাইলের সখিপুরেও এমন একটি আদেশ জারি হয়েছিল। তবে সেখানে জরিমানার বিষয়টি ছিল না। জরিমানার অঙ্ক বেশি হওয়ায় সমালোচনা বেশি হয়েছে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো।

৭ মার্চ নোটিশটি জারির পরপরই আলোচনায় আসেনি। যখন কিশোর-তরুণেরা চুল কাটতে গিয়ে নিষেধাজ্ঞার কথা জানতে পারেন, তখনই ফেসবুকে বিষয়টি ভাইরাল হয়।

কে কেজ ডায়েরি নামের একটি আইডি থেকে একজন প্রশ্ন তোলেন, পুলিশ স্টাইল করে চুল কাটা নিষেধ করার কে।

“মত প্রকাশের স্বাধীনতা নেই, ভোট দেওয়ার অধিকার নেই এখন, জীবনের নিরাপত্তা নেই আর এখন আবার স্বাধীনভাবে চুল কাটব, সেটাও পারবে না এদেশের জনগণ? আমার চুল আমি কাটব, যেভাবে খুশি সেভাবে কাটব,” তিনি লেখেন।

কথা হচ্ছিল সদ্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেরুনো শিক্ষার্থী আসিফুর রহমানের সঙ্গে। একটি টেলিকমিউনকেশন ফার্মে সম্প্রতি যুক্ত হয়েছেন তিনি। তাঁরও প্রশ্ন চুল কাটার সঙ্গে বখাটেপনার কী সম্পর্ক।

“চুল যারা ফ্যাশন করে কাটে তারাই বখাটে এমন কোনো প্রমাণ কি পুলিশের কাছে আছে? সেলুনে নাপিত ক্যাটালগ দেখাবেন তা দেখে চুল কাটব- এমনটাই চলে আসছে বরাবর। ক্যাটালগ দেখানো নিষেধ হবে কেন,” আসিফুর রহমান বেনারনিউজকে বলেন।

নিষেধাজ্ঞা আসছে অন্যান্য জায়গা থেকেও

টাঙ্গাইলের ভূঞাপুরে চুল-দাঁড়ি-গোঁফ কাটা নিয়ে পাল্টাপাল্টি নোটিশের মধ্যে গতকাল সোমবার ঢাকার কাছে সাভার পৌরসভার ৮ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর ও সাভার পৌর প্যানেল মেয়র হাজী মো সেলিম নরসুন্দর সমিতির সঙ্গে বৈঠক করেন। ওই সভায় স্কুল কলেজ পড়ুয়া ছাত্রদের ‘কুরুচিপূর্ণ’ ও ‘বখাটে স্টাইলে’ চুল দাঁড়ি না কাটার ব্যাপারে ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ করেন তিনি।

এর আগে দেশের দক্ষিণাঞ্চলীয় জেলা ঝালকাঠিতে গত ১৪ মার্চ পুলিশ নরসুন্দর সমিতির সঙ্গে বৈঠক করে। স্থানীয় বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্রী, তাদের অভিভাবক ও শিক্ষকদের অভিযোগ স্টাইল করে কাটা চুলের ছেলেরা বখাটেপনা করছে।

বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াড কমিটির সাধারণ সম্পাদক মুনির হাসান এ ধরনের নোটিশ ইস্যু করার এখতিয়ার কোনো কর্তৃপক্ষের আছে কি না তা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন।

“আমি মনে করি জনপ্রতিনিধি ও পুলিশ কারোরই কে, কীভাবে চুল কাটবে সেটা নির্ধারণ করে দেয়ার এখতিয়ার নেই। কোন আইনে তারা এটা করছে সেটা খতিয়ে দেখা দরকার,” বেনারকে বলেন মুনির হাসান।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।