সাংবাদিক হত্যাকাণ্ড: কিনারা হয়নি সাগর-রুনি হত্যার, ঝুলে আছে আরো কুড়িটি বিচার

ঢাকা থেকে পুলক ঘটক
2017.02.09
সন্তান মেঘ এর সঙ্গে সাগর–রুনি দম্পতি। একমাত্র সন্তান মেঘ এর সঙ্গে সাগর–রুনি দম্পতি। ফাইল ফটো।
স্টার মেইল

সাংবাদিক দম্পতি সাগর সরওয়ার ও মেহেরুন রুনি হত্যাকাণ্ডের পাঁচ বছর পরও এই ঘটনার তদন্তে কোনো অগ্রগতির কথা জানাতে পারেননি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল। র‍্যাবের আবেদনের প্রেক্ষিতে আদালত এ পর্যন্ত ৪৮ বার সময় বাড়ালেও তদন্তে কোনো অগ্রগতি হয়নি।

এ নিয়ে ক্ষুব্ধ সাংবাদিক সমাজসহ বিভিন্ন শ্রেণি ও পেশার মানুষ। এরই মধ্যে গতকাল বৃহস্পতিবার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাংবাদিকদের বলেছেন, “হত্যা মামলার তদন্ত চলছে। র‍্যাব এর তদন্ত করছে। তবে এই মুহূর্তে তদন্তের অগ্রগতি সম্পর্কে আমার জানা নেই।”

আগামী শনিবার দেশের চাঞ্চল্যকর এই হত্যাকাণ্ডের পঞ্চম বার্ষিকী। বিচারের দাবিতে কর্মসূচি পালনের প্রস্তুতি নিচ্ছে বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন, ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন এবং ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিসহ সাংবাদিকদের বিভিন্ন সংগঠন। গতকাল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর মন্তব্যের পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে ব্যাপক সমালোচনা চলছে।

“বিচার নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত আমরা এই হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ কর্মসূচি চালাতে থাকব,” বেনারকে বলেছেন ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সভাপতি সাখাওয়াত হোসেন বাদশা।

সাগর–রুনি হত্যা বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে আলোচিত হত্যাকাণ্ডগুলোর একটি। ২০১২ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি ভোরে রাজধানীর পশ্চিম রাজাবাজারের একটি পাঁচতলা ভবনের পঞ্চম তলার ফ্ল্যাট থেকে মাছরাঙা টেলিভিশনের বার্তা সম্পাদক সাগর ও এটিএন বাংলার জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক রুনির ক্ষতবিক্ষত লাশ পাওয়া যায়।

ওই বাসায় বাবা-মায়ের লাশের সঙ্গে শুধু তাদের শিশু সন্তান মাহির সরওয়ার মেঘকেই পাওয়া গিয়েছিল। তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন তখন বলেছিলেন, “৪৮ ঘণ্টার মধ্যে অপরাধীদের গ্রেপ্তার করা হবে।”

পাঁচ বছর পার হতে চললেও কেন এই নৃশংস হত্যাকাণ্ড এবং কারা তা ঘটিয়েছে এর হদিস বের করতে পারেনি র‍্যাব বা পুলিশ। বিষয়টি নিয়ে বছরের পর বছর আন্দোলন করে যাচ্ছেন সাংবাদিকেরা। এক সময় লাগাতার আন্দোলন হয়েছে। এখন চলছে থেমে থেমে আন্দোলন।

এভাবেই মুখে কালো কাপড় বেঁধে মা-বাবা হত্যার প্রতিবাদ জানায় মেঘ (ডানে)। ফেব্রুয়ারি ১২, ২০১৫।
এভাবেই মুখে কালো কাপড় বেঁধে মা-বাবা হত্যার প্রতিবাদ জানায় মেঘ (ডানে)। ফেব্রুয়ারি ১২, ২০১৫।
স্টার মেইল
মামলার বাদী নিহত রুনির ভাই নওশের আলী রোমান বেনারকে বলেছেন, “তদন্তে র‍্যাব-পুলিশের কোনো আন্তরিকতা আছে বলে মনে হচ্ছে না। পরিকল্পিতভাবেই এই হত্যা মামলা নষ্ট করা হয়েছে।”

তিনি বলেছেন, “তদন্তকারী কর্মকর্তা সময়ে সময়ে আমাদের সঙ্গে দেখা করে। কিন্তু তদন্তের অগ্রগতির কথা জানাতে পারেন না। শুধু ধৈর্য ধরতে বলেন।”

মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ও র‍্যাবের সহকারী পরিচালক ওয়ারেস আলী মিয়া গত বুধবার নির্ধারিত দিনেও তদন্তের কোনো অগ্রগতি আদালতকে জানাতে পারেননি। তদন্তের ধীর গতিতে এর আগে বিরক্তি প্রকাশ করেছে উচ্চ আদালত এবং ম্যাজিস্ট্রেট আদালত।

এই প্রেক্ষিতে ঢাকার মহানগর হাকিম মাজহারুল ইসলাম এক আদেশে তদন্তের অগ্রগতি প্রতিবেদন দাখিলের জন্য আবারও তদন্ত কর্মকর্তাকে দেড় মাস সময় দিয়েছেন।

“তদন্তের কী অগ্রগতি হয়েছে, তা তদন্ত কর্মকর্তাকে আগামী ২১ মার্চ আদালতে হাজির হয়ে জানাতে হবে,” আদেশে উল্লেখ করেছেন বিচারক।

এ মামলায় ছয়জনকে গ্রেপ্তার দেখিয়ে পাঁচ বছর যাবৎ কারাগারে রাখা হয়েছে। গ্রেপ্তারকৃতরা হলেন; সাগর-রুনি যে বাড়িতে থাকতেন ওই বাড়ির নিরাপত্তা রক্ষী এনাম আহমেদ ওরফে হুমায়ুন কবির, রফিকুল ইসলাম, বকুল মিয়া, মিন্টু ওরফে বারগিরা মিন্টু ওরফে মাসুম মিন্টু, কামরুল হাসান অরুণ ও আবু সাঈদ। অন্যদিকে তানভীর রহমান ও ওই বাড়ির দারোয়ান পলাশ রুদ্র পাল সুপ্রিম কোর্ট থেকে জামিন নিয়েছেন।

যত সাংবাদিক হত্যা

ঠিক একই ভাবে ঝুলে আছে আরও অন্তত ২০ টি হত্যাকাণ্ডের বিচার। ১৯৯৬ সাল থেকে এ পর্যন্ত অন্তত ২২জন সাংবাদিক নিহত হয়েছেন।

সাগর-রুনি ছাড়াও এ তালিকায় যারা রয়েছেন তারা হলেন; মোহাম্মদ কামরুজ্জামান, সাইফুল আলম মুকুল, মির ইলিয়াস হোসাইন, শামসুর রহমান, নহর আলি, হারুনুর রশিদ, শুকুর হোসাইন, সৈয়দ ফারুক আহমেদ, মানিক সাহা, হুমায়ুন কবির, কামাল হোসেন, দীপঙ্কর চক্রবর্তী, শহীদ আনোয়ার, শেখ বেলালউদ্দিন আহমেদ, গোলাম মাহফুজ, গৌতম দাস, বেলাল হোসেন দফাদার, জামাল উদ্দিন, তালহাদ আহমেদ কবিদ, সদরুল আলম।

গত সপ্তাহে সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরে দৈনিক সমকালের প্রতিনিধি আব্দুল হাকিম শিমুল শহরের মেয়র হালিমুল হক মিরুর গুলিতে নিহত হন। বৃহস্পতিবার মেয়র ও তার প্রতিপক্ষের সংঘর্ষের ছবি তোলার সময় গুলিবিদ্ধ হন শিমুল, পরে মারা যান। এটা দুর্ঘটনা না লক্ষ্য করে হত্যা—এটা এখন পর্যন্ত স্পষ্ট নয়।

সাগর-রুনি হত্যার বিচারের দাবিতে সমাবেশ, ১২ ফেব্রুয়ারি ২০১৩।
সাগর-রুনি হত্যার বিচারের দাবিতে সমাবেশ, ১২ ফেব্রুয়ারি ২০১৩।
স্টার মেইল
প্রশ্নবিদ্ধ গণমাধ্যমের স্বাধীনতা

এদিকে মাদক ব্যবসায় চার সংসদ সদস্যের সম্পৃক্ততা বিষয়ে ডেইলি অবজারভারে একটি রিপোর্ট প্রকাশের প্রতিক্রিয়ায় সংসদ সদস্যদের বিশেষ অধিকার ক্ষুণ্ন হয়েছে মর্মে প্রস্তাব গ্রহণ করেছে জাতীয় সংসদ। ওই পত্রিকার সম্পাদক প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা ইকবাল সোবহান চৌধুরী।

এর আগে প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমান এবং ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহ্‌ফুজ আনামের কঠোর সমালোচনা হয়েছে জাতীয় সংসদে।

সম্প্রতি বাংলাদেশ প্রতিদিনের সাভার প্রতিনিধি নাজমুল হুদাকে গ্রেপ্তার করে তার বিরুদ্ধে অনেকগুলো মামলা দেওয়া হয়েছে। দৈনিক মানবকণ্ঠের সিনিয়র রিপোর্টার সিদ্দিকুর রহমানকে তার গ্রাম এলাকায় একটি মামলায় অভিযুক্ত করা হয়েছে। গত ২৬ জানুয়ারি হরতালের সংবাদ সংগ্রহের সময় এটিএন নিউজের নিজস্ব প্রতিবেদক এহসান বিন দিদার ও ক্যামেরাম্যান আবদুল আলিম পুলিশি নির্যাতনের শিকার হয়েছেন।

ঘটনাসমূহ উল্লেখ করে সাংবাদিক ও প্রেস ফ্রিডম অ্যাকটিভিস্ট জাহাঙ্গির খান বাবু তার ফেসবুক পোস্টে লিখেছেন, “দেশের সর্বস্তরের গণমাধ্যম কর্মীদের মাঝে তীব্র আতঙ্ক ও ক্ষোভ বিরাজ করছে। সাংবাদিকদের পেশাগত দায়িত্ব পালনের গ্যারান্টি দিতে হবে।”

সাংবাদিক হত্যার বিচারহীনতায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের মহাসচিব ওমর ফারুক।

বেনারকে তিনি বলেছেন, “গত এক দশকে অনেক সাংবাদিক নিহত হলেও অভিযুক্তদের বিচার হয়নি।” তিনি সর্বশেষ শিমুল হত্যার ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত ও সুবিচার নিশ্চিত করার দাবি জানান।

ওমর ফারুক বলেছেন, “সাংবাদিকদের ওপর একের পর এক হামলা, মামলা, গ্রেপ্তার ও হত্যার ঘটনায় গণমাধ্যমের স্বাধীনতা প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে।”

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।