মৌলবাদী হুমকির পাশাপাশি রাষ্ট্রীয় চাপে মুক্তবুদ্ধির চর্চা
2018.03.02
ঢাকা

বাংলাদেশে ইসলামি জঙ্গিগোষ্ঠীর হুমকি ছাড়াও রাষ্ট্রীয় নজরদারির কারণে দেশে মুক্তবুদ্ধির চর্চা কমে এসেছে বলে অভিযোগ করেছেন লেখক-প্রকাশকেরা। তাঁদের মতে একুশে বইমেলা আয়োজনকারী বাংলা একাডেমিও লেখকদের নিয়ন্ত্রণ করছে।
“মৌলবাদী জঙ্গিদের হুমকি তো সব সময়ই ছিল। কিন্তু এখন বাংলা একাডেমি অর্থাৎ খোদ রাষ্ট্রযন্ত্র লেখক-প্রকাশকদের গলা চেপে ধরে বুঝিয়ে দিচ্ছে এসব বই না করাই ভালো,” বেনারকে বলেন শ্রাবণ প্রকাশনীর কর্ণধার রবীন আহসান।
দুই বছর আগে বইমেলা চলাকালে গ্রেপ্তার হওয়া ‘ইসলাম বিতর্ক’ নামের বইয়ের সম্পাদক ও প্রকাশক শামসুজ্জোহা মানিকের প্রকাশনী নিষিদ্ধ ও তাঁর গ্রেপ্তার হওয়ার ঘটনা স্মরণ করিয়ে দেন রবীন।
মানিকের ব-দ্বীপ প্রকাশনের পক্ষাবলম্বনের দায়ে গত বছর রবীনের শ্রাবণকেও নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছিল বাংলা একাডেমি।
তবে লেখক-প্রকাশকদের ওপর নিয়ন্ত্রণের জন্য যারা বাংলা একাডেমিকে দায়ী করছেন তাঁদেরকে “দেশীয় সংস্কৃতির বিরোধী গোষ্ঠী” বলে আখ্যায়িত করে এই দায় অস্বীকার করেছেন বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক ড. শামসুজ্জামান খান।
“তাঁদের সঙ্গে মূলধারার ভাষা-সাহিত্যচর্চার কোনো সংশ্লেষ নেই। সাধারণত বিবিধ ব্যক্তিগত স্বার্থে তাঁরা এসব বলে থাকেন,” বেনারকে বলেন ড. শামসুজ্জামান খান।
কমে গেছে মুক্তবুদ্ধির চর্চা; বেড়েছে স্ব-নিয়ন্ত্রণ
লেখক-প্রকাশকদের ওপর বাংলা একাডেমির খবরদারির অভিযোগ অস্বীকার করলেও যুক্তিবাদ ও মুক্তবুদ্ধির চর্চা কমে যাওয়ার কথা স্বীকার করেন ড. শামসুজ্জামান খান।
এর জন্য ইসলামি মৌলবাদ আর মাদ্রাসাসহ পুরো শিক্ষা ব্যবস্থাকে দায়ী করে তিনি বেনারকে বলেন, “লেখক-প্রকাশকদের মনে হুমকির প্রভাব থাকেই।”
তবে “এক শ্রেণির ব্লগ লেখকও উগ্র আচরণ করছেন,” অভিযোগ করেন মহাপরিচালক।
তিনি বলেন, “অনেক ব্লগারও অসহনশীল। তাঁদের লেখার অনেককিছুই সমর্থনযোগ্য নয়।”
এদিকে গত দুই বছর ধরে বইমেলা শুরুর আগে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানতে পারে এমন বইয়ের জন্য সংশ্লিষ্ট লেখক-প্রকাশকদের বিরুদ্ধে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করছেন ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া।
“এমন কোনো বই যাতে বইমেলায় ঢুকতেও না পারে সেজন্য গোয়েন্দা নজরদারি থাকবে,” ২০১৭ সালে বইমেলা শুরুর আগে বলেন আছাদুজ্জামান মিয়া।
এসব কারণে লেখক ও প্রকাশকদের মধ্যে স্ব-নিয়ন্ত্রণ আরোপের ঘটনা বাড়ছে বলে মনে করেন লেখক-প্রকাশকেরা।
“বাংলাদেশে সেলফ সেন্সরশিপ এখন ওপেন সিক্রেট। অপ্রত্যাশিতভাবে লেখক-প্রকাশকদের এখন এটাই বাধ্যতামূলক অবলম্বন,” বেনারকে বলেন মৌলবাদীদের হামলার শিকার হয়ে দেশত্যাগে বাধ্য হওয়া শুদ্ধস্বর প্রকাশনীর আহমেদুর রশীদ টুটুল।
“মুক্তচিন্তা ও তা প্রকাশের স্বাধীনতা এখন বাস্তবিকই রুদ্ধ। …এমনিক এখন স্বপ্ন দেখাও এক ধরনের যুদ্ধ,” বেনারের সাথে সাম্প্রতিক এক সাক্ষাৎকারে বলেন ২০১৫ সালে মৌলবাদীদের হামলার শিকার লেখক রণদীপম বসু।
“গত তিন বছরের বইমেলার পরিসংখ্যান দেখলে সহজেই বোঝা যায়, চলমান সমাজে বিজ্ঞানমনস্কতা বা যে তর্ক-বিতর্ক চালু থাকে তা এখন আর নেই। এখন বিজ্ঞানমনস্ক বইয়ের প্রকাশনা অনেক কমে গেছে,” বলেন রবীন।
তিনি বলেন, “গত বছর তসলিমা নাসরিনের বই ছাপানোর সময় ৪০ পাতা বাদ দিয়েছি। আর এবার পাণ্ডুলিপিই চাইনি।”
“আগে এমন পাণ্ডুলিপি আগে থেকে চেয়ে রাখতাম। আর এখন পেলেও ছাপছি না,” বলেন রবীন।
তবে লেখকদের স্ব-নিয়ন্ত্রণের জন্য পুরো রাজনৈতিক সংস্কৃতিকেই দায়ী করছেন অনেকে।
এ প্রসঙ্গে লেখক, গবেষক ও ভাস্কর গোঁসাই পাহলভী বেনারকে বলেন, “কেবল পুলিশ বা বাংলা একাডেমির কারণে নয়, রাষ্ট্র, সমাজ এবং বর্তমান সংস্কৃতিও সেলফ সেন্সরড হতে বাধ্য করছে একজন লেখক বা ভাবুককে।”
অভিজিৎ রায়কে যে স্থানে কুপিয়ে হত্যা করা হয়, তার পাশেই ২০০৪ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি বইমেলা থেকে বের হওয়ার সময় বহুমাত্রিক লেখক ড. হুমায়ুন আজাদকে কুপিয়েছিল দুর্বৃত্তরা।
হুমায়ুন আজাদের ওপর হামলার প্রসঙ্গ টেনে পাহলভী বলেন, “হুমায়ূন আজাদের ওপর আক্রমণের পর যারা ভিন্নমত অর্থাৎ রাষ্ট্র ও ধর্মভিত্তিক সংখ্যাগুরুদের মতের বাইরে গিয়ে ভাবছেন, তাঁরা নিজ দায়িত্বেই ভাবছেন। দেশের সংবিধান তাঁদের আশ্রয় হবে না, নির্বাহী বিভাগ তাঁদের নিরাপত্তা দেবে না, এমন ঝুঁকি নিয়েই তারা ভাবছেন।”
এদিকে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল ২০১৭-১৮ সালের বার্ষিক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। এতে সরকারের প্রস্তাবিত ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনে বাংলাদেশে মত প্রকাশের স্বাধীনতা আরো সংকুচিত হতে পারে বলে মন্তব্য করেছে তারা।
অভিজিতের বই: মেলায় নেই, অনলাইনে উন্মুক্ত
রায়হান আবীরের সাথে যৌথভাবে অভিজিৎ রায়ের লেখা ‘অবিশ্বাসের দর্শন’ বইটির সাথে সংশ্লিষ্টদের ওপর ২০১৫ সালে মৌলবাদী জঙ্গিদের চারটি আক্রমণের ঘটনা ঘটে। এতে নিহত হন তিনজন আর মারত্মকভাবে আহত হন চার।
জঙ্গিদের আক্রমণে ২০১৫ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি খুন হন অভিজিৎ রায়, মারাত্মকভাবে আহত হন বিজ্ঞান লেখক বন্যা আহমেদ।
একই বছর ১২ মে জঙ্গিরা খুন করে বইটির সম্পাদক অনন্ত বিজয় দাশকে। ৩১ অক্টোবর মৌলবাদীরা আক্রমণ চালায় বইটির দুই প্রকাশনী সংস্থায়।
ওইদিনের আক্রমণে লেখক রণদীপম বসু ও তারেক রহিমের সাথে আহত হন বইটির প্রথম প্রকাশক শুদ্ধস্বর প্রকাশীর কর্ণধার আহমেদুর রশীদ টুটুল।
একই দিনে ভিন্ন একটি হামলায় নিহত হন বইটির দ্বিতীয় সংস্করণের প্রকাশক জাগৃতির ফয়সল আরেফীন দীপন।
দীপন নিহত হবার পর তাঁর স্ত্রী ডা. রাজিয়া রহমান জলি জাগৃতির দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নেওয়ার পর এবার বইমেলায় জাগৃতির স্টল থাকলেও সেখানে অভিজিৎ রায়ের কোনো বই ছিল না।
এদিকে টুটুল বাধ্য হয়ে দেশ ছাড়ার কারণে গত কয়েক বছর দেশে শুদ্ধস্বরের কার্যক্রম বন্ধ থাকলেও বিকল্প হিসেবে ই-বুক প্রকাশনা চালিয়ে যাচ্ছে সংস্থাটি।
গত ২৬ ফেব্রুয়ারি হত্যাকাণ্ডের তিন বছরপূর্তিতে শুদ্ধস্বর অভিজিৎ রায়ের সমকামিতা, শূন্য থেকে মহাবিশ্ব, অবিশ্বাসের দর্শন, বিশ্বাসের ভাইরাস ও ভালোবাসা কারে কয় বইগুলোর ই-বুক ভার্সন অনলাইনে সম্পূর্ণ বিনা মূল্যে পাঠকদের জন্য উন্মুক্ত করেছে।
“আমাদের কাছে জরুরি বিষয় হলো অভিজিৎ এর টেক্সট ছড়িয়ে দেয়া, মানুষকে পাঠের সুযোগ করে দেয়া,” অভিজিতের বইয়ের অনলাইন প্রকাশনা উপলক্ষে বলেন আহমেদুর রশীদ টুটুল।