দিনভর নাটকীয়তার পর কথা বলতে পারলেন অরুন্ধতী রায়
2019.03.05
ঢাকা

দিনভর নানা নাটকীয়তা, শঙ্কা আর অনিশ্চয়তার পর অবশেষে বাংলাদেশে কথা বলার সুযোগ পেলেন বুকার পুরস্কার বিজয়ী ভারতীয় লেখক ও মানবাধিকার কর্মী অরুন্ধতী রায়।
প্রথমবারের মতো বাংলাদেশে এসে অনুষ্ঠান করতে গিয়ে পুলিশি বাধার মুখে পড়েন তিনি। পুলিশের বাধায় তাঁকে নিয়ে আয়োজিত অনুষ্ঠানের ভেন্যু বদলাতে বাধ্য হন আয়োজকরা।
বিষয়টি নিয়ে হতাশা প্রকাশ করেন আয়োজকরা। আর এ ধরনের অনুষ্ঠান বন্ধ করা বিচক্ষণের কাজ নয় বলে মনে করেন অরুন্ধতী।
এ বিষয়ে তিনি বিবিসি বাংলাকে বলেন, “আমার মনে হয় না, এ রকম একটি অনুষ্ঠান বন্ধ করা কারও জন্য বিচক্ষণ একটা ব্যাপার।”
“এমন ঘটনা শুধু বাংলাদেশে নয়, ভারতেও হচ্ছে। সাংবাদিকদের হত্যা করা হচ্ছে। জেলে পাঠানো হচ্ছে অধ্যাপকদের। আমরা তেমন মানুষ, যাঁরা বিরোধী মতের জায়গা তৈরির চেষ্টা করছি,” বলেন তিনি।
“যদি মানুষ মত প্রকাশ করতে না পারে, দ্বিমত পোষণ করতে না পারে, তাহলে সমাজের বুদ্ধিমত্তা তলানিতে গিয়ে ঠেকবে। এটা কারও জন্য ভালো হবে না,” বলেন অরুন্ধতী রায়।
দিনভর অনিশ্চয়তা
দক্ষিণ এশিয়ার সর্ববৃহৎ আলোকচিত্র উৎসব ছবিমেলার দশম আয়োজনের সাথে সম্পৃক্ত এক অনুষ্ঠানে অংশ নিতে সোমবার ঢাকা আসেন তিনি। মঙ্গলবার সন্ধ্যায় রাজধানীর কৃষিবিদ ইনস্টিটিউটে ‘আটমোস্ট এভরিথিং’ শিরোনামে অনুষ্ঠানে আলোকচিত্রী শহিদুল আলমের সাথে আলাপচারিতায় অংশ নেওয়ার কথা ছিল অরুন্ধতীর।
শহিদুল আলম ছবিমেলার অন্যতম আয়োজক সংস্থা দৃক এর প্রতিষ্ঠাতা। যিনি গত বছর বাংলাদেশে নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের সময় ‘গুজব ছড়ানোর অভিযোগে’ গ্রেপ্তার হন। সে সময় তাঁর মুক্তির দাবিতে খোলা চিঠি লিখেছিলেন অরুন্ধতী।
ছবিমেলার সমন্বয়ক এ এস এম রেজাউর রহমান বেনারকে জানান, তিনি অরুন্ধতী রায় স্মারক বক্তৃতা অনুষ্ঠান আয়োজনের অনুমতি চেয়ে গত ১৬ ফেব্রুয়ারি পুলিশের তেজগাঁও বিভাগের উপকমিশনারের কাছে চিঠি দেন। ২৫ ফেব্রুয়ারি শর্তসাপেক্ষে নিজস্ব নিরাপত্তা ব্যবস্থায় অনুষ্ঠানটি আয়োজনের অনুমতি মেলে।
কিন্তু অনুষ্ঠানের আগে সোমবার রাতে কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশন কর্তৃপক্ষ আয়োজকদের জানায়, মিলনায়তনের বরাদ্দ বাতিল করা হয়েছে। সোমবার রাত ১২টার দিকে তেজগাঁও থানার পুলিশও ছবিমেলার আয়োজকদের অনুষ্ঠানের অনুমতি বাতিলের খবর দেয়। তবে বাতিলের কোনো কারণ ব্যাখ্যা করেনি পুলিশ।
এ বিষয়ে তেজগাঁও থানার ওসি মাজহারুল ইসলাম বেনারকে বলেন, “অনিবার্য কারণবশত কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশনে ছবিমেলার ‘অ্যাটমোস্ট এভরিথিং’ শীর্ষক অনুষ্ঠানটি বাতিল করা হয়েছে। এর বেশি কিছু বলতে পারছি না।”
আলোকচিত্রী শহিদুল আলমও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে জানান, অনুষ্ঠানটি অন্য কোথাও আয়োজনের চেষ্টার করা হচ্ছে।
পরে মঙ্গলবার দুপুরে দিকে মাইডাস সেন্টারে অনুষ্ঠানের নতুন ভেন্যুর ঘোষণা দেন আয়োজকরা। দুপুরে আবার ছবিমেলার ওয়েবসাইটে জানানো হয়, ধানমন্ডির মাইডাস সেন্টারে পূর্ব নির্ধারিত সময় সন্ধ্যা ৬টায় অরুন্ধতী রায়কে নিয়ে অনুষ্ঠানটি হবে।
অনুষ্ঠানের সব আয়োজন যখন প্রায় শেষ তখন আবারও ছবিমেলা কর্তৃপক্ষ জানায়, মাইডাস সেন্টার কর্তৃপক্ষ সেখানে অরুন্ধতী রায়ের অনুষ্ঠানের জন্য করা বুকিংটি বাতিল করেছে।
মাইডসের পক্ষ থেকে পাঠানো এক বার্তায় জানানো হয়, “অনিবার্য কারণবশত মাইডাসে দেওয়া ‘দৃক’-এর বুকিংটি বাতিল করা হয়েছে। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে অনুষ্ঠান আয়োজনের অনুরোধ করা গেল।”
তবে এর কিছুক্ষণ পরেই ছবিমেলার কর্মকর্তা পারভেজ আহমদ রনি বেনারকে জানান অনুষ্ঠানটি হচ্ছে।
মাইডাসে অনুষ্ঠান করা নিয়ে কিছুটা ঝামেলা হলেও বিকেল সোয়া ৫টার দিকে পুলিশের অনুমতি পাওয়া গেছে বলে বেনারকে জানান পাঠশালার ভাইস প্রেসিডেন্ট আবির আবদুল্লাহও।
অরুন্ধতী রায়ের অনুষ্ঠানে দর্শক ছিলেন ইসরাত জাহান উর্মি।
তিনি বেনারকে বলেন, “অরুন্ধতী রায় সারা বিশ্বের নীপিড়িত মানুষের জন্যই প্রাসঙ্গিক। তাঁর বুদ্ধিবৃত্তিক উচ্চতা, সাহিত্য সবই রাজনীতিক সচেতনতা। বাংলাদেশের জন্যও তাই তিনি প্রাসঙ্গিক।”
অনুষ্ঠানটি নিয়ে দিনভর নাটকীয় পরিস্থিতি সম্পর্কে তিনি বলেন, “মানুষের কথা বলার স্বাধীনতা আর মুক্তচিন্তা নিয়ে কাজ করা একজন লেখককে গণতান্ত্রিক বাংলাদেশে কথা বলতে দেয়া হবে না- এটা ভয়ঙ্কর। শেষ পর্যন্ত অনুষ্ঠানটি করতে দেয়া হয়েছে, এটা সুখের।”
যা বললেন অরুন্ধতী
সবশেষে কাঙ্খিত অনুষ্ঠানটি শুরু হয় সন্ধ্যা সাতটা নাগাদ। শুরুতে একটি লিখিত বক্তব্য উপস্থাপন করেন অরুন্ধতী। এরপরেই জবাব দেন শহিদুল আলমের প্রশ্নের।
অরুন্ধতী রায় বলেন, “আমার দুটো সত্তা। একটি লেখক ও অন্যটি কর্মী সত্তা। বাংলাদেশের পাঠকের কাছে আমি এসেছি লেখক হিসেবে।”
প্রায় দুই ঘণ্টাব্যাপী কথোপকথনে অরুন্ধতী রায় বাক্স্বাধীনতা, জাতীয়তাবাদ, উন্নয়ন, গণতন্ত্র, বড় বড় প্রকল্প এসব নিয়ে কথা বলেন।
আমি নদীকে কেন্দ্র করে বাঁধ কিংবা কোনো উন্নয়ন প্রকল্পে বিশ্বাসী নই জানিয়ে তিনি বলেন, “নদীকে ভাগ করা যায় না। বড় বড় বাঁধ নির্মাণের পেছনে ফ্যসিবাদ আর জাতীয়তাবাদী চেতনা লুকানো থাকে।”
ভারতের সঙ্গে ট্রানজিট, রামপালসহ নানা বিষয়ে জটিলতা প্রসঙ্গে ভারতের প্রগতিশীল গোষ্ঠী উচ্চকণ্ঠ নয় কেন– এমন প্রশ্নের সাথে একমত পোষণ করে অরুন্ধতী রায় বলেন, তিনি জেনে বুঝে এসব বিষয় নিয়ে লেখালেখি করছেন।
এই ইস্যুতে প্রয়োজনে বাংলাদেশে আসবেন বলেও জানান তিনি।
তিনি বলেন, “অক্সফামের সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে, ভারতে ৫০ কোটি লোকের সম্পদ পুঞ্জীভূত রয়েছে নয়জন লোকের কাছে। তাই উন্নয়নের কথা এলে লোকজন জানতে চায়, কার জন্য উন্নয়ন।”
ভারতের বিখ্যাত ঔপন্যাসিক অরুন্ধতী রায়ের বাবার আদি নিবাস বাংলাদেশের বরিশালে। তিনি শুধু একজন ঔপন্যাসিক নন একজন অ্যাকটিভিস্টও। তিনি পরিবেশগত সংশ্লিষ্টতা এবং মানবাধিকার সংক্রান্ত বিষয়েও জড়িত আছেন।
অরুন্ধতী রায় প্রথম উপন্যাস ‘দ্য গড অব স্মল থিংস’ এর জন্য ১৯৯৭ সালে ম্যান বুকার পান । ২০১৭ সালে তার দ্বিতীয় উপন্যাস ‘দ্য মিনিস্ট্রি অব দ্য আটমোস্ট হ্যাপিনেস’ প্রকাশিত হয়।
স্থাপত্যের ছাত্রী হলেও অরুন্ধতীর আগ্রহ ছিল চলচ্চিত্রের দিকে। ‘মাসি সাহিব’ নামক একটি চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন তিনি। পরে শুরু করেন চিত্রনাট্য লেখা। ভারতের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারও পায় তাঁর চিত্রনাট্য।
অরুন্ধতী রায় কাশ্মীরের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে ভারত সরকারের অবস্থানের কট্টর সমালোচক। মাওবাদী আন্দোলন নিয়ে বুদ্ধিজীবীদের বড় একটি অংশের সঙ্গে তর্কে জড়ানোর কারণে ‘ভারতবিরোধী’ আখ্যাও পেয়েছেন এই প্রতিবাদী নারী।