ভারতে বিক্ষোভের মুখে তসলিমা নাসরিন

প্রভাত শরণ
2017.08.01
মুম্বাই
নয়াদিল্লিতে নিজের বাসায় তসলিমা নাসরিন। নয়াদিল্লিতে নিজের বাসায় তসলিমা নাসরিন। ১ নভেম্বর ২০১৬।
AFP

বিতর্কিত বাংলাদেশি লেখক তসলিমা নাসরিনকে আওরঙ্গাবাদে বেড়াতে বাধা দেবার জন্য ভারতীয় গোঁড়া মুসলিমদের সমালোচনা করেছেন মানবাধিকার কর্মীরা।

পুলিশ জানায়, আওরঙ্গাবাদের অজন্তা ও ইলোরা গুহা পরিদর্শনের পরিকল্পনা ছিল তসলিমা নাসরিনের। কিন্তু শহরে গোড়াপন্থী অল ইন্ডিয়া মজলিস-ই-ইত্তেহাদ-উল-মুসলেমিন এর বিক্ষোভের মুখে তাকে বিমানবন্দর থেকেই ফিরিয়ে দেওয়া হয়।

পুলিশের ডেপুটি কমিশনার রাহিল শ্রীরাম সাংবাদিকদের জানান, বিক্ষোভকারীরা নগরীর চিকলথানা বিমানবন্দরের বাইরে এবং তসলিমা যে হোটেলে থাকার কথা সেই হোটেলের সামনে “তসলিমা ফিরে যাও” শ্লোগান দিয়ে বিক্ষোভ করায় তাঁকে মুম্বাইর একটি ফিরতি ফ্লাইটে চলে যেতে বলা হয়।
শ্রীরাম বলেন, “তাঁর ভ্রমণের কারণে আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হওয়ার আশঙ্কা ছিল। ফলে আমরা তাঁকে বিমানবন্দরের বাইরে যেতে নিষেধ করি এবং পরের ফ্লাইটেই মুম্বাই ফিরে যেতে অনুরোধ করি।

বাংলাদেশে ধর্মীয় সহিংসতার প্রেক্ষাপটে লেখা তাঁর বই ‘লজ্জা’ প্রকাশের পর মৌলবাদীদের কাছ থেকে হত্যার হুমকি পাওয়ায় তসলিমা নাসরিন ১৯৯৪ সালে নির্বাসিত হন। লজ্জা বইটি পরবর্তীতে বাংলাদেশ সরকার নিষিদ্ধ করে। বর্তমানে সুইডিশ পাসপোর্টধারী তসলিমা নাসরিন ২০০৪ সাল থেকে ভারতে বসবাস করছেন।

মঙ্গলবার এক টুইটার বার্তায় তিনি লেখেন, “অজন্তা-ইলোরার গুহা দেখার একটা স্বপ্ন ছিল আমার। এটা বিশ্বাস করতেও কষ্ট হয় যে পৃথিবীর বৃহত্তম গণতন্ত্রের দেশে এই জিনিসটা করা আমার পক্ষে সম্ভব হলো না।”

“এদের মধ্যে একজনও কি বলতে পারবে যে আমি নবী সম্পর্কে কী লিখেছি? কেউই পারবে না, কারণ তারা কেউ আমার বই পড়েনি। তারা শুধু তাদের রাজনৈতিক স্বার্থে আমার নাম ব্যবহার করে,” বলেন তসলিমা নাসরিন।

বহুবার পশ্চিমবঙ্গে স্থায়ীভাবে বসবাসের ইচ্ছা জানালেও তাঁর বিরুদ্ধে গোঁড়া মুসলিমদের সহিংস বিক্ষোভের মুখে তাঁকে বাধ্য হয়ে ২০০৭ সালে কলকাতা ছাড়তে হয়। তখন থেকেই তিনি নয়াদিল্লিতে বসবাস করছেন।

প্রতিবাদের প্রতীক

১৯৯২ সালে ভারতের উত্তর প্রদেশে বাবরি মসজিদ ধ্বংসের পর কীভাবে বাংলাদেশি এক হিন্দু পরিবারের জীবন দুর্বিসহ হয়ে ওঠে তারই আখ্যান তসলিমা নাসরিনের ‘লজ্বা’ বইটি।

তসলিমা লজ্জা বইয়ের নতুন একটি ইংরেজি অনুবাদের ভূমিকায় লেখেন, “অনেকে মনে করে যে আমি লজ্জা বইয়ে ইসলামের সমালোচনা করেছি, আর এজন্যই মৌলবাদীরা আমার বিরুদ্ধে ফতোয়া জারি করেছে- এটা ঠিক নয়। ‘লজ্জা’য় আমি ইসলামের সমালোচনা করিনি এবং আমার বিরুদ্ধে ফতোয়া জারিও ‘লজ্জা’র কারণে হয়নি। বরং আমি অন্যান্য লেখায় ইসলামের যে সমালোচনা করেছি, আমার বিরুদ্ধে ফতোয়া সেই কারণেই।”

তিনি লেখেন, “লজ্জা একটি প্রতিবাদের প্রতীক। ধর্মের নামে সারা বিশ্বে চলমান সহিংসতা, ঘৃণা এবং হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ‘লজ্জা’।

“আমার বইটি মূলত উপমহাদেশের ধর্মীয় বর্বরতার একটি দলিল। ধর্ম মানুষকে উন্মাদ এবং মনুষ্যত্বহীনে পরিণত করে,” বলেন তসলিমা নাসরিন।

মৌলবাদীদের স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া

নেতৃস্থানীয় মুসলিম মানবাধিকার কর্মী হাসিনা খান বলেন, তসলিমা নাসরিনের বিরুদ্ধে মজলিস-ই-ইত্তেহাদের বিক্ষোভ ডানপন্থী মুসলিম মৌলবাদীদের স্বাভাবিক একটি প্রতিক্রিয়ার উদাহরণ।

“এটা পরিষ্কার যে ডানপন্থী গোঁড়া মুসলিমরা তাঁকে ঘৃণা করে। কিন্তু তাঁদের এই ধরনের পদক্ষেপ অন্যান্য ডানপন্থী সহিংসতাকেও যৌক্তিকতা দিতে পারে,” বেনারকে বলেন হাসিনা।

এ প্রসঙ্গে মুম্বাইভিত্তিক সেন্টার ফর স্টাডি সোসাইটি অ্যান্ড সেকুলারিজম এর প্রকৌশলী ইরফান বেনারকে বলেন, “একজন লেখকের সাথে একমত হতে না পারলেই কিন্তু কারো সহিংসতা বা ভাংচুর করার অধিকার জন্মায় না।”

“এই ধরনের ঘটনা নিয়ন্ত্রণে পুলিশের কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া উচিত", বলেন ইরফান।

‘ইচ্ছাকৃত বিতর্ক’
কেউ কেউ ইচ্ছাকৃতভাবে বিতর্ক তৈরির জন্য তসলিমা নাসরিনের সমালোচনা করেছেন।

“এটা বুঝতে হবে যে তসলিমা নাসরিনের বই মুসলমানদের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দিয়েছে। তিনি ইচ্ছাকৃতভাবে এইসব নোংরা বিতর্ক তৈরি করেন। যার কারণে তার বিরুদ্ধে খুব সহজেই লোকজনকে সংগঠিত করা যায়,” বেনারকে বলেন ইসলামি ক্যালিগ্রাফার মোহাম্মদ জামশেদ।

এ প্রসঙ্গে উর্দুভাষী সাংবাদিক সাঈদ আহমদ খান বেনারকে বলেন, “ইচ্ছাকৃতভাবে কারো ধর্মীয় বিশ্বাসকে আঘাত কিংবা অপমান করলে প্রবল প্রতিক্রিয়া হতে বাধ্য।”
চলমান অবৈধ স্থাপনা বিরোধী অভিযানের কারণে আওরঙ্গাবাদ বর্তমানে নাজুক অবস্থায় রয়েছে। এ অবস্থায় নগরীতে তসলিমা নাসরিনের বিরুদ্ধে বিক্ষোভের নেতা মজলিস-ই-ইত্তেহাদ এর বিধায়ক ইমতিয়াজ জলিল সাংবাদিকদের বলেন, “তসলিমা নাসরিনকে আসতে না দেবার জন্য পুলিশকে অনুরোধ করার এটা একটা কারণ।”

“আমরা পুলিশকে জানিয়েছিললাম যে তসলিমা নাসরিন বিমানবন্দরের বাইরে এলে বিক্ষোভকারীরা তার উপর ডিম বা টমোট ছোড়ার পরিকল্পনা করেছে,” বলেন ইমতিয়াজ।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।