মত প্রকাশের স্বাধীনতা, শান্তিপূর্ণ সমাবেশে আক্রমণ বন্ধ করুন: অ্যামনেস্টি

পুলক ঘটক
2020.08.11
ঢাকা
200811_Amnesty_story-1000.jpg সড়কে নিরাপত্তার দাবিতে রাজধানীতে সাইকেল র‍্যালী শেষে কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারে পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের সমাবেশ। মঙ্গলবার এক বিবৃতিতে নাগরিকদের শান্তিপূর্ণ সমাবেশে আক্রমণ বন্ধের দাবি জানিয়েছে মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল। ১১ আগস্ট ২০২০।
[ফোকাস বাংলা]

বাংলাদেশে মত প্রকাশের স্বাধীনতা ও শান্তিপূর্ণ সমাবেশের ওপর ক্রমবর্ধমান আক্রমণের ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল।

মঙ্গলবার এক বিবৃতিতে এসব বন্ধের দাবি জানানোর পাশাপাশি সাম্প্রতিক আক্রমণের ঘটনাগুলোর জরুরি তদন্ত দাবি করেছে সংগঠনটি।

বিবৃতিতে, অপহরণ, শারিরীক আক্রমণ এবং শান্তিপূর্ণ সমাবেশে পুলিশি বাধার তিনটি সাম্প্রতিক ঘটনা উল্লেখ করা হয়েছে।

এসব অভিযোগের ব্যাপারে সরকারের অবস্থান জানতে চাইলে তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ কোনো সাড়া দেননি।

তাৎক্ষণিক কোনো মন্তব্যও করতে রাজী হননি আইনমন্ত্রী আনিসুল হক।

“অ্যামনেস্টির বক্তব্য আমি নিজে এখনো দেখিনি। মন্তব্য করার আগে তারা কী বলেছে তা ভালোভাবে জানা দরকার। বিবৃতি দেখে আগামীকাল মন্তব্য করব,” বেনারকে বলেন আইনমন্ত্রী।

মন্তব্যের জন্য যোগাযোগ করা হলে মঙ্গলবার রাতে পররাষ্ট্রমন্ত্রী একে আব্দুল মোমেন বেনারকে বলেন, “উনারা (অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল) মাঝে মধ্যেই বাংলাদেশ নিয়ে এমন বিৃবতি দেন। এগুলোর ব্যাপারে আমার কোনো আগ্রহ নেই।”

অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক গবেষক সুলতান মুহাম্মদ জাকারিয়া বিবৃতিতে বলেছেন, “বাংলাদেশে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে গুমের উদ্বেগজনক প্রবণতা দেখা দিয়েছে। কেবল রাজনৈতিক মতভিন্নতার মানুষকে গুম করা হচ্ছে।”

অ্যামনেস্টির অভিযোগ, ২৭ বছর বয়সী মিশরের আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও ছাত্র নেতা আশরাফ উদ্দিন মাহদি গত ৬ আগস্ট রাত ১১টায় গুম হন।

নিকটাত্মীয়ের বাসা থেকে নিজ বাসায় ফেরার পথে রাজধানীর লালবাগ এলাকা থেকে অপরিচিত কিছু লোক মাহদিকে উঠিয়ে নিয়ে যায়। প্রায় ৪৮ ঘণ্টা আটকে রাখার পর নাগরিক সমাজের চাপের মুখে তাঁকে ছেড়ে দেওয়া হয়।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সরকারের সমালোচক হিসাবে আশরাফ মাহদির অনেক অনুসারী রয়েছে।

মাহদিকে উদ্ধৃত করে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালকে জানায়, অপহরণকারীরা তাঁকে ফেসবুকে সরকারপন্থী কয়েকজন ব্যক্তির বিরুদ্ধে লেখালেখি না করার শর্তে মুক্তি দিয়েছে।

সুলতান মুহাম্মদ জাকারিয়া বলেন, “আশরাফ উদ্দিন মাহদির কণ্ঠরোধ করতেই রাজধানীর কেন্দ্রস্থল থেকে জোরপূর্বক তাঁকে গুম করা হয়েছে।”

এ প্রসঙ্গে মানবাধিকার কর্মী ও আর্টিকেল-১৯ এর দক্ষিণ এশিয়া এবং বাংলাদেশ শাখার পরিচালক ফারুক ফয়সাল বেনারকে বলেছেন, “দেশে প্রচুর গুম এবং বিচারবহির্ভুত হত্যা সংগঠিত হয়েছে যা নিয়ে আমরা উদ্বিগ্ন।”

তাঁর মতে, “গুম হওয়া মানুষগুলোর পরিবার প্রতিবাদ করতেও ভয় পায়। ফলে অধিকার কর্মীদের মুখ বন্ধ করার জন্য চাপ দেওয়ার সুযোগ পায় সরকার।”

“শান্তিপূর্ণ সমাবেশে বাধা দেওয়ার ঘটনা বারবারই ঘটছে যা সংবিধান পরিপন্থী। সরকারকে অবশ্যই এসব বন্ধ করতে হবে,” বলেন ফয়সাল।

২০০৯ সালে বর্তমান সরকার ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে বাংলাদেশে গুমের ঘটনা বেড়ে চলছে।

প্যারিস ভিত্তিক ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন ফর হিউম্যান রাইটস (এফআইডিএইচ)-এর মতে, ২০০৯ থেকে ২০১৮ এই দশ বছরে কমপক্ষে ৫০৭ জন মানুষ গুমের শিকার হন। এর মধ্যে ৬২ জনের লাশ পাওয়া যায়, ২৮৬ জন জীবিত ফিরে আসেন, এবং ১৫৯ জনের এখনো কোনো হদিস মেলেনি।

বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনের কর্মীরা সরকার দল-সংশ্লিষ্ট সংগঠনগুলো দ্বারাও হামলার শিকার হয়েছেন।

গত ৮ আগস্ট, শাসক দল আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্র লীগের কর্মীরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের ছাত্র সালেহ উদ্দিন শিফাতকে অনলাইনে ‘সরকার বিরোধী কার্যক্রমের’ অভিযোগে চট্টগ্রাম জেলার সীতাকুণ্ড নামক স্থানে পিটিয়ে আহত করে।

হাসপাতালে চিকিৎসাধীন সিফাত মঙ্গলবার টেলিফোনে বেনারকে বলেছেন, স্থানীয় ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা তাঁকে বাড়িতে না ফেরার হুমকি দিয়েছে।

“ওরা বলেছে বাড়িতে গেলে আমাকে মেরে ফেলবে,” বলেন সিফাত।

অ্যামনেস্টির অভিযোগ, একই দিনে (৮ আগস্ট) দক্ষিণাঞ্চলীয় বরগুনা জেলায় একটি শান্তিপূর্ণ সমাবেশ ও মানববন্ধন সহিংস উপায়ে বানচাল করে দেয় স্থানীয় পুলিশ।

সমাবেশকারীরা স্ট্যামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সাহেদুল ইসলাম সিফাতের মুক্তি দাবি করছিলেন। পুলিশ শান্তিপূর্ণ সমাবেশে লাঠিচার্জ করে এবং কমপক্ষে ১০ জন মানববন্ধনকারীকে পিটিয়ে আহত করে।

অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল ওই ঘটনার ধারণকৃত একাধিক ভিডিও বিশ্লেষণ করে জানিয়েছে, পুলিশ কোনো প্রকার উসকানি ছাড়াই মানববন্ধনকারীদের সহিংসভাবে দমন করেছে।

প্রতিষ্ঠানটি বলেছে, “বাংলাদেশে জনগণের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও শান্তিপূর্ণ সমাবেশের অধিকার অবশ্যই জরুরি।”

অ্যামনেস্টির মতে, জনগণ যাতে কোনো প্রকার ভয়ভীতি ছাড়াই সরকারের সমালোচনা করতে পারে, সরকারকে অবশ্যই সেটি নিশ্চিত করতে হবে। সরকারের সমালোচকদের জোরপূর্বক গুম করে ফেলার সংস্কৃতি বন্ধ করতে হবে।

গুম ও সহিংসতার যেসব ঘটনা ঘটেছে সেগুলোর তাৎক্ষণিক ও কার্যকর তদন্ত করতে হবে এবং তদন্তকাজ অবশ্যই নিরপেক্ষ ও স্বাধীন হতে হবে। দোষীদের সুষ্ঠু বিচার প্রক্রিয়ায় মৃত্যুদণ্ড ব্যতিরেকে শাস্তির আওতায় নিয়ে আসতে হবে বলে জানান সুলতান মুহাম্মদ জাকারিয়া।

অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের মতে, মত প্রকাশের স্বাধীনতা দমনের অংশ হিসেবে গত বছর বাংলাদেশ অন্তত এক হাজার ৩২৫ জনকে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এছাড় চলতি বছরের জুন পর্যন্ত এই আইনে বাংলাদেশে গ্রেপ্তার হয়েছেন ৫০০ জনের বেশি মানুষ।

প্রতিবেদনে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন ঢাকা থেকে কামরান রেজা চৌধুরী।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।