একজন শহিদুল আলম: গণতন্ত্রের পক্ষে নিরলস

মাহবুব লীলেন
2018.08.15
ওয়াশিংটন ডিসি
180814_Shahidul_1000.JPG শহিদুল আলমের মুক্তির দাবিতে ঢাকার শাহবাগে বিক্ষোভ। ১১ আগস্ট ২০১৮।
বেনারনিউজ

কারও কাছে তাঁর পরিচয় আলোকচিত্রী, কারও কাছে তিনি গুরু, কারও কাছে তিনি সাংবাদিক। তবে সবকিছু ছাপিয়ে দেশে–বিদেশে তাঁর পরিচয় গণতন্ত্র ও মত প্রকাশের স্বাধীনতার পক্ষে সুউচ্চ কণ্ঠে কথা বলা এক মানবাধিকার কর্মী।

তিনি ড. শহিদুল আলম। নিরলসভাবে কয়েক দশক ধরে মত প্রকাশের স্বাধীনতার পক্ষে কথা বলে শেষ পর্যন্ত নিজের মত প্রকাশের দায়ে এখন জেলে। সড়কে নৈরাজ্যের বিরুদ্ধে ঢাকায় শিক্ষার্থীদের যৌক্তিক আন্দোলন দমন করতে সরকারের ভূমিকার কঠোর সমালোচনা করেন তিনি। সরকারের দৃষ্টিতে তিনি রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করেছেন, আন্দোলন উসকে দিয়েছেন।

নিজের ফেসবুক ও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে কথা বলার দায়ে ৫ আগস্ট রাতে তাঁকে বাড়ি থেকে তুলে নেওয়া হয়। পরদিন পুলিশ তাঁকে গ্রেপ্তারের কথা স্বীকার করে, তাঁর বিরুদ্ধে মামলা হয় তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনে।

গ্রেপ্তারের পর পুলিশ তাঁর ওপর নির্যাতন চালায় বলেও আদালত প্রাঙ্গণে উপস্থিত সাংবাদিকদের জানান শহিদুল। যদিও পুলিশ এই অভিযোগ অস্বীকার করেছে।

“সর্বশেষ মঙ্গলবার আমি শহিদুলের সাথে দেখা করেছি,” বুধবার বেনারকে বলেন শহিদুলের স্ত্রী এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক রেহনুমা আহমেদ।
তিনি বলেন, “তার পায়ের ব্যথাটা সেরেছে কিনা তা বুঝতে পারিনি।”

রেহনুমা জানান, ১৪ আগস্ট ঢাকার সিএমএম আদালতে শহিদুলের জামিন আবেদন করেছিলেন আইনজীবীরা। আদালত আগামী ১১ সেপ্টেম্বর শুনানির দেন ধার্য করেছে।

এর আগে গত ৬ আগস্ট শহিদুলের জামিনের আবেদন নামঞ্জুর করে সাত দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করে সিএমএম আদালত। গত ১২ আগস্ট রিমান্ড শেষে তাঁকে কারাগারে পাঠানো হয়।

দেশের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ, দেশি ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা এবং বরেণ্য লেখক, সাংবাদিক ও আলোকচিত্রীরা তাঁর গ্রেপ্তারের প্রতিবাদ জানিয়ে মুক্তি দাবি করেছেন।

শহিদুল আলমকে গ্রেপ্তারের দিনটিকে ‘গণমাধ্যমের স্বাধীনতার ক্ষেত্রে একটি কালো দিন’ হিসেবে’ আখ্যায়িত করেছে ফ্রান্সের রিপোর্টার্স উইদাউট বডার্স।

“শহিদুল রাজনীতির সাথে যুক্ত না হলেও রাজনীতি সচেতন ও নিপীড়ন নির্যাতন বিরোধী ব্যক্তিত্ব। যেকোনো অন্যায়ের বিরুদ্ধেই তাঁর অবস্থান ছিল, সেটা প্যালেস্টাইন হোক, চট্টগ্রাম হোক বা সুন্দরবন রক্ষার ইস্যু হোক,” শহিদুল সম্পর্কে বেনারকে বলেন অর্থনীতিবিদ ও মানবাধিকার কর্মী অধ্যাপক আনু মোহাম্মদ।

গ্রেপ্তারের পর শহিদুল আলমকে ঢাকার আদালতে হাজির করে পুলিশ। ৬ আগস্ট ২০১৮।
গ্রেপ্তারের পর শহিদুল আলমকে ঢাকার আদালতে হাজির করে পুলিশ। ৬ আগস্ট ২০১৮।
বেনারনিউজ
মত প্রকাশ ও গণমাধ্যমের অধিকার চর্চা করতে গিয়ে বিপদাপন্ন দেশি বিদেশি অনেককেই সহায়তা করেছেন শহিদুল আলম। এর মধ্যে রয়েছেন, কয়েক দশক ধরে নির্বাসিত বাংলাদেশি লেখক তসলিমা নাসরিন।

গত ৯ আগস্ট তসলিমা তাঁর ফেসবুকে লেখেন, “শহিদুল আলমের মতো সভ্য, শিক্ষিত, নির্ভীক মুক্ত চিন্তককে ভিন্ন মত প্রকাশের জন্য আজ যে দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে, এ তাঁর নয়, এ গোটা দেশের লজ্জা।”

১৯৯৪ সালের একটি ঘটনা স্মরণ করে তসলিমা লেখেন, রাস্তায় যখন তাঁর ফাঁসির দাবিতে মৌলবাদীরা মিছিল করছিল, তখন হাতে গোনা কয়েকজন মানুষ ঝুঁকি নিয়ে তাঁকে প্রাণে বাঁচিয়েছিলেন, এঁদের একজন শহিদুল আলম।

গত বছর সেপ্টেম্বরে মিয়ানমারের দুজন ফ্রিল্যান্স আলোকচিত্রী; মিনজাইয়ার এবং হকুন লাটকে কক্সবাজার থেকে গ্রেপ্তার করে বাংলাদেশ পুলিশ। তাঁদের মুক্তি ও নিরাপদে দেশ ফিরতে শহিদুল আলম সহায়তা করেছিলেন বলেও ৬ আগস্ট এক টুইট বার্তায় জানান রয়টার্সের সাংবাদিক অ্যান্ড্রু মার্শাল।

দৃক এর পাঠশালার মাধ্যমে বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলের অসংখ্য ফটোগ্রাফারদের প্রশিক্ষণও দিয়েছেন শহিদুল আলম।

পাঠশালায় শহিদুল আলমের ছাত্র তানভীর মুরাদ। বেনারকে তিনি বলেন, “শহিদুল আলম শিক্ষক হিসেবে যেমন দক্ষ, তেমনি অসাধারণ ভালো মানুষ।”

“উনি (শহিদুল) আমাদের শিক্ষক হলেও আমরা তাঁকে ‘স্যার’ বলি না। তাঁকে আমরা ‘আলম ভাই’ বলে ডাকি।

এ প্রসঙ্গে তানভীর মুরাদ জানান, “স্যার সম্বোধন করে যখন কারও বশ্যতা শিকার করা হয়, তখন তাঁর কোনো কার্যকলাপে তাঁকে আর প্রশ্ন করা যায় না। সেই চর্চাটাই আমাদের শিখিয়েছেন শহিদুল, যা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।”

শহিদুল আলমের তোলা ছবি: লেট ডেমোক্রেসি লিভ-১৯৮৭।
শহিদুল আলমের তোলা ছবি: লেট ডেমোক্রেসি লিভ-১৯৮৭।
সৌজন্যে দৃক

ব্যক্তি শহিদুল আলম

নিজের কাজের স্বীকৃতি হিসেবে শহিদুল আলম ২০১৪ সালে বাংলাদেশ শিল্পকলা পদক অর্জন করেন। তাঁর পিতা চিকিৎসক ও অণুজীব বিজ্ঞানী ডা. কাজী আবুল মনসুর আহমেদ বাংলাদেশের সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা স্বাধীনতা পুরস্কারপ্রাপ্ত (১৯৯৬)। তাঁর মা স্বনামধন্য শিক্ষিকা কাজী আনোয়ারা মনসুর।

দৃক ওয়েবসাইটের তথ্য মতে, ১৯৮৪ সালে দেশে ফিরে ছবি তোলার কাজে জড়িয়ে পড়ার আগে শহিদুল ইউনিভার্সিটি অব লন্ডন থেকে রসায়নে পিএইচডি করেন।

তিনি যুক্তরাজ্যের সান্ডারল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অতিথি অধ্যাপক ও রয়্যাল ফটোগ্রাফিক সোসাইটির সম্মানিত ফেলো। এ ছাড়া তিনি ওয়ার্ল্ড প্রেস ফটো জুরির সদস্য হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন।

তাঁর ছবি বাংলাদেশ ছাড়াও যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, যুক্তরাজ্য, ইরানসহ বিভিন্ন দেশে প্রদর্শিত হয়েছে।

১৯৫৫ সালে ঢাকায় জন্ম নেওয়া শহিদুল বাংলাদেশের প্রথম ফটো লাইব্রেরি দৃক ও ফটো এজেন্সি মেজরিটি ওয়ার্ল্ড এর প্রতিষ্ঠাতা। তাঁর লেখা ‘মাই জার্নি এজ এ উইটনেস’ কে এ পর্যন্ত ‘কোনো ফটোগ্রাফারের লেখা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বই’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন লাইফ ম্যাগাজিনের ছবি বিষয়ক সাবেক সম্পাদক জন মরিস

যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল পাবলিক রেডিও (এনপিআর) ২০১১ সালে শহিদুল আলমের একটি সাক্ষাৎকার প্রচার করে। সেখানে বাংলাদেশ সম্পর্কে শহিদুল বলেন, “বাংলাদেশের অর্থনীতির মূল ভিত তৈরি করেছে গার্মেন্টস শ্রমিক, প্রবাসী শ্রমিক আর মাঠের কৃষকরা। তাঁরাই দেশের প্রকৃত বীর।”

আর শহিদুল আলম সম্পর্কে এনপিআরের পর্যবেক্ষণ হলো, “উন্নয়নশীল বিশ্বের দৃশ্যগুলো পশ্চিমা আলোকচিত্রীর চোখে দেখতে চাওয়াই একজন সাবেক রসায়নবিদের ফটোগ্রাফারে রূপান্তরিত হওয়ার মূল কারণ।”

বাংলাদেশে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের ওপর তৈরি ‘ক্রসফায়ার’ ছিল তাঁর সর্বশেষ উল্লেখযোগ্য আলোকচিত্র প্রদর্শনী।

২০১০ সালের মার্চে এই প্রদর্শনীটির উদ্বোধন অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ সরকার বাধা দেয়, পরে আদালতের নির্দেশে আবার দর্শকদের জন্য উন্মুক্ত হয়। পরবর্তীতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এটি প্রদর্শিত হয়।

বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৪০ বর্ষপূর্তি উপলক্ষে ‘একটি জাতির জন্ম যন্ত্রণা’ নামে মুক্তিযুদ্ধের প্রামাণ্যচিত্র তৈরি করে দৃক গ্যালারি, এর পরিকল্পনা ও ধারাভাষ্য করেন শহিদুল।

তাঁর চলমান প্রকল্পগুলোর মধ্যে রয়েছে ১৯৭১ সালের বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের আর্কাইভ ও দেশের গ্রাম পর্যায়ে সাংবাদিকতার নেটওয়ার্ক তৈরি।

টিশার্টের বুকে ‘আমি ব্লগার’ লিখে শহিদুলের মুক্তমনা ব্লগার ও লেখকদের হত্যার প্রতিবাদ।
টিশার্টের বুকে ‘আমি ব্লগার’ লিখে শহিদুলের মুক্তমনা ব্লগার ও লেখকদের হত্যার প্রতিবাদ।
সৌজন্যে দৃক

গণতন্ত্রের পথে নিরলস

গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের পক্ষে সব সময় সোচ্চার ছিলেন শহিদুল। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার দাবিতে গড়ে ওঠা শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চ আন্দোলন সম্পর্কে ২০১৩ সালে নিউ ইয়র্ক টাইমসে তিনি নিবন্ধ লেখেন। ওই আন্দোলনকে তিনি মূল্যায়িত করেন “ন্যায় বিচার নিশ্চয়তার দাবিতে একটি গণতান্ত্রিক কণ্ঠস্বর” হিসেবে।

হাজারো স্বতঃস্ফূর্ত তরুণের সেই আন্দোলন সম্পর্কে শহিদুল লেখেন, “যারা জাতীয় স্বার্থের চেয়ে ব্যক্তিগত লাভের হিসাব বেশি করেন, সেই সব ব্যর্থ নেতৃবৃন্দের হাত থেকে জাতির নিয়ন্ত্রণ ছিনিয়ে নেবার উদ্যোগ এটি।”

২০১৫-১৬ সালে জঙ্গি মৌলবাদীদের হামলায় একের পর এক অভিজিৎ রায়, ওয়াশিকুর রহমান বাবু, অনন্ত বিজয় দাশ ও নিলয় নীলসহ দেশের মুক্তমনা লেখকেরা নিহত হন। সরকারের নিষ্ক্রিয়তার কারণেই যে ওই সব জঙ্গিরা আশকারা পাচ্ছে সে বিষয়েও খুব সুস্পষ্ট বক্তব্য ছিল তাঁর।

ওই সময় মৌলবাদীদের হামলার ভয় উপেক্ষা করে কালো টিশার্টের বুকে রক্তের অক্ষরে ‘আমি ব্লগার’ লিখে সাইকেল চালিয়ে ঢাকা শহর ঘুরে সরকারের নিষ্ক্রিয়তা ও হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদও জানিয়েছেন শহিদুল।

সাউথ এশিয়ান ফটো’র ওয়েবসাইটের তথ্য মতে, আশির দশকে ছবি তুলতে তুলতেই শহিদুল যুক্ত হয়ে পড়েন স্বৈরাচার বিরোধী গণ-আন্দোলনে। তাঁর আন্দোলনের মাধ্যম ফটোজার্নালিজম।

গণ আন্দোলনের ওপর করা তাঁর কাজগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে শহীদ নূর হোসেনের ছবিসহ একটি দেয়ালচিত্রের ছবি: ‘লেট ডেমোক্রেসি লিভ; বা গণতন্ত্রকে বাঁচতে দাও’।

স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের প্রতীক নূর হোসেন নিজের উদোম বুকে ‘স্বৈরাচার নিপাত পাক’ ও পিঠে ‘গণতন্ত্র মুক্তি পাক’ লিখে মিছিল করার সময় ১৯৮৭ সালের ১০ নভেম্বর পুলিশের গুলিতে নিহত হন।

“শহিদুল সামগ্রিকতার প্রতীক। শুভবোধ এবং সাংগঠনিক একটা তৎপরতা তাঁর মধ্যে আছে,” বেনারকে বলেন পাঠশালায় শহিদুল আলমের সহকর্মী আবদুল হালিম।

তিনি বলেন, “শহীদুল নিজে সাংঘাতিক কর্মঠ, অন্যদের কর্মস্পৃহা জাগাতে কিংবা কাউকে তৈরি করতে তাঁর জুড়ি নেই।”

প্রতিবেদনে তথ্য দিয় সহায়তা করেছেন ঢাকা থেকে জেসমিন পাপড়ি ও শরীফ খিয়াম।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।