লোহিত সাগরে জাহাজে হুতি আক্রমণ: পরিবহন ব্যয় বৃদ্ধি, চাপে পোশাক খাত
2024.01.12
ঢাকা

আন্তর্জাতিক জাহাজগুলো লোহিত সাগর হয়ে সুয়েজ খাল ব্যবহার করতে না পারায় বিপাকে পড়েছে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম তৈরি পোশাক রপ্তানিকারক বাংলাদেশ।
গাজায় হামাসের সমর্থনে গত বছরের অক্টোবরের মাঝামাঝি থেকে সুয়েজ খালের দক্ষিণ অংশ দিয়ে যাতায়াত করা বাণিজ্যিক জাহাজ লক্ষ্য করে হামলা শুরু করে হুতিরা।
ইরান সমর্থিত ইয়েমেনের এই সংগঠনের ভাষ্য, গাজায় ইসরায়েলের হামলার শোধ নিচ্ছে তারা।
তৈরি পোশাক মালিকরা জানিয়েছেন, ইয়েমেনের জলসীমার পরিবর্তে দক্ষিণ আফ্রিকার উত্তমাশা অন্তরীপ (কেপ অব গুড হোপ) ব্যবহার করায় ইউরোপ ও আমেরিকায় তৈরি পোশাক রপ্তানিতে ব্যয় বেড়েছে কমপক্ষে শতকরা ২৫ শতাংশ। কমপক্ষে ১০ দিন সময় বেশি লাগছে।
ক্রয়াদেশে নির্ধারিত সময়ে পণ্য পৌঁছে দিতে অনেকে উচ্চ খরচে আকাশ পথ ব্যবহার করছেন।
তাঁদের মতে, এই সমস্যার সুরাহা না হলে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাত বড় ক্ষতির মুখে পড়বে।
গত বছরের ৭ অক্টোবর ফিলিস্তিনে হামাসের সঙ্গে ইসরায়েলের যুদ্ধ শুরু হয়। ১৯ নভেম্বর হুতিরা ইয়েমেনের এডেন উপসাগরে ইসরায়েলের স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট একটি ব্রিটিশ বাণিজ্যিক জাহাজ আটক করে। এরপর থেকে বাণিজ্যিক জাহাজে হুতি আক্রমণ অব্যাহত রয়েছে।
বিশ্ব বাণিজ্য স্বাভাবিক রাখতে বৃহস্পতিবার হুতিদের প্রতিরোধে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য যৌথভাবে আক্রমণ চালিয়েছে।
অনেকেই এটিকে হামাস-ইসরায়েল যুদ্ধের বিস্তার বলে মনে করছেন।
বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম শুক্রবার বেনারকে বলেন, “লোহিত সাগরে হুতি বিদ্রোহীরা বাণিজ্যিক জাহাজে আক্রমণ শুরু করায় বিশ্বের জাহাজ কোম্পানিগুলো ঝুঁকি এড়াতে সুয়েজ খালের পরিবর্তে কেপ অব গুড হোপ ব্যবহার করছে।
“এতে প্রথমত সময় বেশি লাগছে। বাংলাদেশ থেকে সুয়েজ খাল হয়ে একটি কন্টেইনার ইউরোপের কোনো গন্তব্যে পাঠাতে ২৫ দিন সময় লাগে। কেপ অব গুড হোপ দিয়ে যেতে কমপক্ষে ১০ দিন বেশি লাগছে। অর্থাৎ এখন প্রায় ৩৫ দিনে পণ্য পৌঁছাচ্ছে,” বলেন তিনি।
হাতেম বলেন, “পথের দূরত্ব বাড়ায় সময়ের পাশাপাশি জ্বালানি খরচ বেড়ে যাওয়ায় জাহাজ কোম্পানিগুলো বেশি চার্জ করছে। হিসাব করে দেখা যাচ্ছে, প্রতিটি ২০ ফুট কন্টেইনারে শতকরা ২৫ শতাংশ খরচ বেড়ে গেছে। ক্রেতারা এখন সবচেয়ে কাছের দেশ; যেমন তুরস্ক থেকে তৈরি পোশাক কিনছে।”
তিনি বলেন, “প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে নির্ধারিত সময়ে পণ্য পৌঁছে দিতে অনেক রপ্তানিকারক আকাশ পথ ব্যবহার করছেন, যা অত্যন্ত ব্যয়বহুল এবং টেকসই মাধ্যম নয়।”
ব্যয়ের পার্থক্য ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, “জাহাজে ইউরোপের কোনো বন্দরে ২০ ফুট কন্টেইনার পাঠাতে তিন হাজার মার্কিন ডলার খরচ হয়। উড়োজাহাজ পাঠাতে ব্যয় হয় কমপক্ষে ১০ হাজার, কখনো কখনো ১৫ হাজার মার্কিন ডলার।”
চট্টগ্রাম বন্দরের সাবেক চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল (অব.) মোহাম্মদ শাহজাহান শুক্রবার বেনারকে বলেন, “যেসব দেশ পোশাক রপ্তানি করে সেগুলোর প্রায় সবগুলোই এশিয়ায় অবস্থিত। সে কারণে খরচ সব দেশের জন্যই বাড়ছে। ফলে আমদানিকারক দেশগুলোতে আমাদের পণ্যের দাম বৃদ্ধি পাবে।”
“আমি মনে করি না এই অচলাবস্থা বেশি দিন চলবে। হুতিরা একটি সন্ত্রাসী সংগঠন। এদের নৌ-সক্ষমতা নেই। তারা ইরান অথবা অন্যান্য দেশ থেকে ড্রোন, ক্ষেপণাস্ত্র ও অন্যান্য অস্ত্র পাচ্ছে। এরা মূলত ভূমিভিত্তিক বাহিনী। পশ্চিমা দেশগুলো একত্রিত হয়ে আক্রমণ চালালে এরা টিকতে পারবে না,” বলেন তিনি।
হুতিদের প্রতিরোধে যুক্তরাষ্ট্র-যুক্তরাজ্যের যৌথ আক্রমণ ‘সঠিক সিদ্ধান্ত’ উল্লেখ করে নৌপরিবহন অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক কমডোর আরিফুল ইসলাম বেনারকে বলেন, “বাণিজ্যিক জাহাজে আক্রমণ জাতিসংঘের সমুদ্র বিষয়ক আইনের (আনক্লজ) লঙ্ঘন। হুতিরা যা করছে সেটি গ্রহণযোগ্য নয়। তারা যদি কোনো সামরিক জাহাজে আক্রমণ চালাতো সেটি অন্য কথা হতো।”
তিনি বলেন, “এভাবে যদি বাণিজ্যিক জাহাজে আক্রমণ চলতে থাকে তাহলে আন্তর্জাতিক অর্থনীতির মূল ভিত্তি—সরবরাহ ব্যবস্থা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তাতে সারা বিশ্বে মূল্যস্ফীতি বেড়ে অর্থনৈতিক মন্দা অবস্থা চলে আসতে পারে। ইউরোপ-আমেরিকার অর্থনীতি খারাপ হলে আমাদের তৈরি পোশাক খাত মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।”
প্রয়োজনে সামরিক ব্যবস্থার মাধ্যমে লোহিত সাগরে বাণিজ্যিক জাহাজে আক্রমণ বন্ধ করতে হবে বলেও মত দেন তিনি।
প্রসঙ্গত, বাংলাদেশের রপ্তানি আয়ের শতকরা প্রায় ৮৪ শতাংশ আসে তৈরি পোশাক খাত থেকে। বাংলাদেশি তৈরি পোশাকের শতকরা ৭০ শতাংশ বাজার ইউরোপের দেশগুলো