শ্রমিক নেতা শহীদুল হত্যা: প্রভাবশালী দুই আসামির নাম বাদ দেওয়ার অভিযোগ

রিয়াদ হোসেন
2024.03.28
ঢাকা
শ্রমিক নেতা শহীদুল হত্যা: প্রভাবশালী দুই  আসামির নাম বাদ দেওয়ার অভিযোগ ঢাকার জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে গার্মেন্টস শ্রমিকদের মজুরি আন্দোলনে চার শ্রমিক হত্যার বিচারের দাবিতে মানববন্ধন করে শ্রমিক কর্মচারী ঐক্য পরিষদ। ২৩ নভেম্বর ২০২৩।
[মেহেদী রানা/বেনার নিউজ]

গাজীপুরে শহীদুল ইসলাম হত্যাকাণ্ডের তদন্ত শেষে পুলিশের দেওয়া অভিযোগপত্রে প্রধান দুই আসামির নাম অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি বলে অভিযোগ করেছে বাংলাদেশ গার্মেন্টস অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল শ্রমিক ফেডারেশন (বিজিআইডব্লিওএফ)।

সংগঠনটির পক্ষ থেকে অভিযোগপত্রের বিষয়ে নারাজি আবেদন করা হলেও আদালত তা খারিজ করে দেয়।

শ্রমিকপক্ষের প্রতিনিধিদের দাবি, কারখানার মালিক ও স্থানীয় প্রভাবশালী কামরুল ইসলামের নাম অভিযোগপত্র থেকে বাদ দেওয়া হলে ন্যায় বিচার পাওয়া যাবে না।

বাদীপক্ষের আইনজীবী মুনিম খান বেনারকে জানান, গাজীপুরের শিল্পাঞ্চল পুলিশ গত ২৪ ফেব্রুয়ারি গাজীপুর মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে অভিযোগপত্র দেয়। ২৫ মার্চ মামলার বাদী বিজিআইডব্লিওএফের সভাপতি কল্পনা আক্তার নারাজি আবেদন করেন। ওই দিনই আবেদনের ওপর শুনানি হয়।

বৃহস্পতিবার তিনি বলেন, “কী কারণে আদালত আমাদের আবেদন গ্রহণ করেননি, তা আমরা এখনো নিশ্চিত হতে পারিনি। নথিপত্র তোলার পর আমরা গাজীপুরের জজ কোর্টে যাব।”

নারাজি আবেদনের একটি কপি বেনারের হাতে এসেছে। তাতে দেখা যায়, প্রিন্স জ্যাকার্ড সোয়েটার নামে ওই কারখানার মালিক (নাম উল্লেখ করা হয়নি) এবং স্থানীয় ঝুট ব্যবসায়ী কামরুল ইসলামের নাম অভিযোগপত্রে অন্তর্ভুক্ত না করায় নারাজি আবেদন করা হয়।

এতে বলা হয়, বাদীর সাক্ষীদের জিজ্ঞাসা না করে অভিযোগপত্র দাখিল করে তদন্তকারী কর্মকর্তা আসামিদের অব্যাহতির আবেদন করেন। এতে মূল আসামিরা মামলা থেকে বাদ পড়েছেন। ফলে বাদী ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হবেন।

মুনিম বলেন, ওই কারখানার ম্যানেজার আবু সালেহ ও প্রধান অভিযুক্ত কামরুল ইসলামের ভাইকে আসামি হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হলেও অভিযোগ কিছুটা হালকা করা হয়েছে।

“এর ফলে বাদীর অপূরণীয় ক্ষতির সম্ভাবনা রয়েছে” বলেও উল্লেখ করা হয় নারাজি আবেদনে।

ঈদুল আজহার আগে, গত বছরের ২৫ জুন ঢাকার অদূরে গাজীপুর জেলার টঙ্গীর সাতাইশ বাগানবাড়ী এলাকায় 'প্রিন্স জ্যাকার্ড সোয়েটার লিমিটেড' কারখানায় শ্রমিকদের পাওনা টাকা আদায়ে নেমে দুর্বৃত্তের হামলায় নিহত হন শহীদুল ইসলাম। তিনি বিজিআইডব্লিওএফের গাজীপুর জেলা শাখার সভাপতি ছিলেন।

এরপর গত অক্টোবর ও নভেম্বরজুড়ে মজুরি বৃদ্ধির আন্দোলনে চার পোশাক শ্রমিক প্রাণ হারান।

হত্যাকাণ্ডের পরে বিজিআইডব্লিওএফের সভাপতি কল্পনা আক্তার বাদী হয়ে ছয় জনের নাম উল্লেখ করে মামলা করেন। এর প্রায় আট মাস পর অভিযোগপত্র দেয় পুলিশ।

শহীদুল হত্যাকাণ্ডে সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচারের দাবি জানায় যুক্তরাষ্ট্রসহ পোশাকের বিভিন্ন ক্রেতা দেশ এবং শ্রমিকের অধিকার নিয়ে কাজ করা সংগঠন। এছাড়া চলতি মাসে জেনেভায় অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার গভর্নিং বডির সভায় বিষয়টি আলোচনায় আসে।

ওই সভায় উপস্থিত ছিলেন কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের (ডিআইএফই) মহাপরিদর্শক আব্দুর রহিম খান। তিনি বেনারকে বলেন, “বিষয়টি আলোচনায় এসেছে। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে মামলার অগ্রগতি তুলে ধরা হয়েছে।”

এ ব্যাপারে মতামত জানতে শ্রম মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. মাহবুব হোসেনের মোবাইল ফোনে কল করা হলেও কথা বলা সম্ভব হয়নি।

মামলার তদন্ত দলের প্রধান ছিলেন গাজীপুর শিল্পাঞ্চল পুলিশের অতিরিক্ত সুপার মো. ইমরান আহম্মেদ। তিনি বেনারকে বলেন, “আমরা নিরপেক্ষভাবে কাজ করেছি। তদন্তে যা পেয়েছি, তার ভিত্তিতে চার্জশিট দেওয়া হয়েছে।”

জোর করে কাউকে আসামি করা যায় না মন্তব্য করে তিনি বলেন, “উনারা মামলায় ছয় জনের নাম দিয়েছিলেন। তদন্তে আরও কয়েকজনের সম্পৃক্ততা পাওয়ায় মোট ১৪ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছে।”

বিজিআইডব্লিওএফের সাধারণ সম্পাদক বাবুল আক্তার বেনারকে বলেন, “মামলায় অজ্ঞাতনামা আসামির উল্লেখ করা হয়েছে। কারা দায়ী সেটা পুলিশ তদন্ত করে বের করবে।”

অভিযোগপত্রে যাদের নাম এসেছে তারা হলেন, মাজাহারুল ইসলাম, আকাশ আহম্মেদ ওরফে বাবুল, রাসেল মন্ডল, রাইতুল ইসলাম ওরফে রাতুল, সোহেল রানা, জুলহাস আলী, সোহেল হাসান সোহাগ, শাহীনুল ইসলাম, শাকিল মোল্লা, আমির হোসেন, হালিম মিয়া, রফিকুল ইসলাম, জুয়েল মিয়া ও আবু সালেহ।

ন্যায়বিচার পাওয়া নিয়ে শঙ্কায় শ্রমিকপক্ষ

বিজিআইডব্লিওএফের সাধারণ সম্পাদক বাবুল আক্তার বলেন, “সরকারের পক্ষ থেকে গত আইএলওর সভায় বলা হয়েছে, যত দ্রুত সম্ভব এই মামলার কার্যক্রম সম্পন্ন করা হবে। আমরা আশঙ্কা করছি, কোনো রকম একটি রায় দিয়ে হয়তো মামলাটি শেষ করা হবে। প্রকৃত দোষী ব্যক্তিরা সাজার আওতায় আসবে কি না তা নিয়ে সংশয় আছে।”

তিনি আরও বলেন, এই মামলায় ১২ আসামি গ্রেপ্তার হলেও ইতোমধ্যে ছয়জন জামিন পেয়েছেন।

শ্রম আইন বিশেষজ্ঞ জাফরুল হাসান শরিফ বেনারকে বলেন, “নারাজি আদালত আমলে না নিলেও বাদীপক্ষের সেখানকার দায়রা জজ আদালত এবং সেখানেও প্রতিকার না পেলে উচ্চ আদালতে যাওয়ার সুযোগ আছে। ন্যায় বিচারের স্বার্থে যদি কোনো পক্ষ আপত্তি জানায়, তা আমলে নিয়ে নিষ্পত্তি করা উচিত।”

মামলাটি খুবই স্পর্শকাতর উল্লেখ করে তিনি বলেন, “এমনভাবে মামলাটির নিষ্পত্তি হওয়া উচিত, যাতে কোনো পক্ষ কোনো ধরনের ফাঁক-ফোকর খুঁজে না পায়।”

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।