কলকারখানা থেকে বাসাবাড়ি, গ্যাস সংকটে ভুগছে বাংলাদেশ
2024.01.19
ঢাকা

রাজধানী ঢাকা, শিল্পনগরী নারায়ণগঞ্জ, বন্দরনগরী চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় গ্যাস সংকট চরম আকার ধারন করেছে।
শুক্রবার সকাল থেকে চট্টগ্রামে আবাসিক ও বাণিজ্যিক খাতে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ ছিল। সামগ্রিক অসুবিধার কারণে দুঃখ প্রকাশ করেছে জ্বালানি মন্ত্রণালয়।
বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের জনসংযোগ কর্মকর্তা মীর আসলাম উদ্দিন শুক্রবার বেনারকে বলেন, “মূলত দুটি কারণে গ্যাস সংকট শুরু হয়েছে। মহেশখালীতে স্থাপিত ভাসমান এলএনজি টার্মিনালে হঠাৎ কারিগরি ত্রুটি দেখা দিয়েছে। সে কারণে চট্টগ্রাম এলাকায় শুক্রবার সকাল থেকে গ্যাস সরবরাহ সাময়িকভাবে বন্ধ রয়েছে।
“এছাড়া, শীতের কারণে দেশের অন্যান্য এলাকায় গ্যাসের স্বল্প চাপ বিরাজ করছে। বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে অতি দ্রুত মেরামতের লক্ষ্যে কাজ করছে মন্ত্রণালয়,” যোগ করেন তিনি।
দেশীয় গ্যাস উৎপাদন ও সরবরাহ অব্যাহত রয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, “সাময়িক অসুবিধার জন্য মন্ত্রণালয় আন্তরিকভাবে দুঃখ প্রকাশ করেছে।”
পেট্রোবাংলার হিসাবে, দেশে প্রতিদিন চার হাজার মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস প্রয়োজন হয়। তবে চাহিদা অনুসারে সব সময় গ্যাস সরবরাহ করতে পারে না কর্তৃপক্ষ।
রূপান্তরিত প্রাকৃতিক গ্যাস কোম্পানি লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রফিকুল ইসলাম বেনারকে বলেন, “মহেশখালীতে স্থাপিত ভাসমান দুটি এলএনজি টার্মিনালের একটির ক্ষমতা ৬০০ মিলিয়ন ঘনফুট। গত নভেম্বরে সেটি মেরামত করতে পাঠানো হয়, এটি চলে এসেছে। আরেকটি টার্মিনালের সক্ষমতা ৫০০ মিলিয়ন ঘনফুট, সেটি মেরামত করা হচ্ছে। টার্মিনালটি মেরামতে সময় লাগবে দুই মাসের মতো। মার্চ মাসের প্রথম সপ্তাহে টার্মিনালটি সচল হতে পারে। ”
গত বছর অক্টোবরে গ্যাস সংকটে পড়ে বাংলাদেশ। এর পর থেকে আবাসিক খাতের গ্রাহকদের ভোগান্তির পাশাপাশি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে রপ্তানি আয়ের প্রধান খাত তৈরি পোশাক শিল্প। শুক্রবার পরিস্থিতির চরম অবনতি ঘটে যা সহসা শেষ হওয়ার সম্ভাবনা নেই বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
দুই হাজার পোশাক কারখানা সংকটে
তৈরি পোশাক কারখানা মালিকরা বলছেন, গ্যাস সংকটে প্রায় দুই হাজার কারখানা পুরোদমে চলছে না।
তৈরি পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ গার্মেন্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিজিএমইএ) মুখপাত্র শোভন ইসলাম শাওন শুক্রবার বেনারকে বলেন, “গত কয়েক সপ্তাহ গ্যাস সরবরাহে বিঘ্ন ঘটায় নারায়ণগঞ্জের নিট কারখানাগুলোতে কোনো কাজ হচ্ছে না। ডাইংয়ের কাজে গ্যাস অপরিহার্য। শত শত কারখানায় উৎপাদন বন্ধ রয়েছে অথবা নামমাত্র চলছে।”
তিনি বলেন, “ঢাকায় ছোট ছোট ওভেন কারখানাগুলো বন্ধ রয়েছে। বড় কারখানাগুলো বিকল্প হিসেবে ডিজেল ব্যবহার করছে। ফলে উৎপাদন খরচ বেড়ে যাচ্ছে। গ্যাস সরবরাহে বিঘ্ন ঘটায় আমাদের হিসাবে কমপক্ষে এক হাজার ৮০০ কারখানা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এ রকম চলতে থাকলে অনেকেই ক্ষতি সামলে ঘুরে দাঁড়াতে পারবে না।”
চট্টগ্রামে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ
কোনো ধরনের নোটিশ ছাড়াই শুক্রবার সকালে পুরো চট্টগ্রামে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়। বিপাকে পড়েন গৃহিনী, সিএনজিচালিত অটোরিকশা ও গ্যাসচালিত গাড়ির চালকরা।
ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, গ্যাস সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান কর্ণফুলী গ্যাস বিতরণ কোম্পানি লিমিটেড (কেজিডিসিএল) কর্তৃপক্ষ আগে থেকে কোনো বিজ্ঞপ্তি প্রচার করেনি। এ নিয়ে গ্রাহকদের কোনো রকম প্রস্তুতিও ছিল না। গ্যাস বন্ধ থাকায় অনেকেই রেস্তোরাঁয় খাবারের জন্য লাইন দিয়েছেন। কিন্তু বহু রেস্তোরাঁয় রান্নাও হয়নি। অনেক এলাকায় বৈদ্যুতিক চুলা ও লাকড়ি জ্বালিয়ে রান্না করেছেন।
মহানগরীর পাহাড়তলী এলাকার বাসিন্দা ফারজানা ইসলাম বেনারকে বলেন, “শীতের দিনে একটু বেলা করেই উঠি আমরা। শুক্রবার ছুটি থাকায় আরও কিছুটা দেরিতে ঘুম থেকে উঠে রান্নাঘরে গিয়েছিলাম। চুলা জ্বালাতে গিয়ে হতবাক, চুলা জ্বলছে না। খোঁজ নিয়ে জানলাম আমাদের আত্মীয়-স্বজন, প্রতিবেশী কারও বাড়িতে গ্যাস নেই।”
“পাশের হোটেলে নাস্তা কিনতে গিয়ে দেখি দীর্ঘ লাইন, সেখান খাবার কেনা যেন এক যুদ্ধ,” বলেন ফারজানা।
চট্টগ্রাম মহানগরীর বাসিন্দা মোশারফ হোসেন বেনারকে জানান, “শুক্রবার (সিএনজিচালিত) অটোরিকশার ভাড়া কম থাকে। রাস্তায় বের হয়ে দেখি কোনো অটোরিকশা নেই। একজন রিকশাওয়ালা জানালেন গ্যাস নেই, তাই অটোরিকশা বন্ধ।”
ঢাকা মহানগরীর মিরপুর এলাকার বাসিন্দা শওকত আরা বেনারকে বলেন, “গত অক্টোবর থেকে আমাদের বাসায় সকালে গ্যাস থাকে না। থাকলেও গ্যাসের চাপ এত কম থাকে যে, একটি ডিম ভাজতে গেলে বেশ কয়েক মিনিট লেগে যায়।”
তিনি বলেন, “গ্যাস আসে বিকেল ৫টার পরে, আবার অনেক সময় রাতে আসে। রান্না করে পরের দিন খেতে হয়। গ্যাসের এই অবস্থার কারণে রুটিন পাল্টে যাচ্ছে। রাতে পর্যাপ্ত ঘুমাতে পারি না।”
নারায়ণগঞ্জ: ৪০০ শিল্পকারখানা গ্যাস-সংকটে
নারায়ণগঞ্জের প্রায় সাড়ে ৪০০ শিল্পকারখানা বছরের শুরু থেকে তীব্র গ্যাস-সংকটে ভুগছে। নারায়ণগঞ্জের পাশাপাশি আরও দুই শিল্প এলাকা সাভার ও গাজীপুরের শ্রীপুরেও একই পরিস্থিতি। গ্যাসের তীব্র সংকটের কারণে এসব এলাকার ডাইং কারখানা, সুতার কল বা স্পিনিং মিল, খাদ্যপণ্য, কাগজকলসহ বিভিন্ন ধরনের শিল্পকারখানায় উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে।
বিজিএমইএ’র মুখপাত্র বলেন, এই পরিস্থিতিতে উৎপাদন ব্যয় বেড়েছে। গ্যাসের এমন সংকট চলতে থাকলে কারখানা বন্ধ হবে, এক পর্যায়ে শ্রমিকেরা কাজ হারাবেন।
গ্যাসের পরিস্থিতি এত খারাপ হওয়ার কারণ প্রসঙ্গে তিতাস গ্যাস কর্তৃপক্ষের বক্তব্য হচ্ছে, নারায়ণগঞ্জে গ্যাসের লাইন পুরোনো হওয়ায় সক্ষমতা কম। সেই তুলনায় গ্রাহকের সংখ্যা বেশি। এ কারণে সেখানে প্রায় সব সময় গ্যাসের কমবেশি সংকট থাকে। বর্তমানে জাতীয়ভাবে গ্যাসের সরবরাহ কমে যাওয়ায় পরিস্থিতি বেশি খারাপ হয়েছে।
ঢাকার ডেমরায় একটি পোশাক কারখানার কর্মরত শ্রমিকদের একাংশ। ১৮ ডিসেম্বর ২০২৩। ছবি: মো: হাসান, বেনারনিউজ।
কেন গ্যাস সংকট?
গ্যাস সংকটের নেপথ্যে চাহিদার তুলনায় সরবরাহ কম থাকার কথা উল্লেখ করেছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, দেশে গ্যাসের উৎপাদন না বাড়া, পাইপ লাইনে গ্যাসের চাপ কম থাকা, আন্তর্জাতিক বাজারে গ্যাস ও জ্বালানির দাম বৃদ্ধি ও ডলার সংকটের কারণে পরিস্থিতি নাজুক অবস্থায় গেছে।
দেশে গ্যাসের সরবরাহ স্বাভাবিক করাই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ উল্লেখ করে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেছেন, ২০২৬ সালের মধ্যে দেশে নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহে কাজ চলছে।
তৃতীয়বার প্রতিমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নিয়ে গত ১৬ জানিুয়ারি এক প্রেস ব্রিফিংয়ে তিনি এই আশাবাদ জানান।
নসরুল হামিদ বলেন, “আন্তর্জাতিক বাজারে গ্যাস ও জ্বালানির দাম বেড়ে যাওয়ায় আমাদের অতিরিক্ত ১৩ বিলিয়ন ডলার খরচ হয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন এলাকায় এখন আবার অস্থিতিশীলতা দেখা যাচ্ছে। আমরা জানি না পরিস্থিতি কী হবে। তবে আমরা প্রস্তুতি নিচ্ছি।”
প্রতিমন্ত্রী বলেন, “আমাদের প্রধান অগ্রাধিকার থাকবে দেশীয় গ্যাসক্ষেত্রগুলো থেকে গ্যাস উত্তোলন বাড়ানো।”
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক ম. তামিম শুক্রবার বেনারকে বলেন, “বাংলাদেশে প্রতিদিন চার হাজার মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের প্রয়োজন হয়। তবে সরবরাহ তিন হাজার ঘনফুট রাখতে পারলে সমস্যা হয়। শীতকালে গ্যাসের চাহিদা বেড়ে যায়। কারণ মানুষ গোসল করা, এমনকি কাপড় ধোয়ার জন্যও গরম পানি ব্যবহার করে।”
তিনি বলেন, “বর্তমানে চাহিদার বিপরীতে গ্যাস সরবরাহ করা যাচ্ছে না। বাংলাদেশের ক্ষেত্রগুলো থেকে এক হাজার ৮০০ থেকে সর্বোচ্চ দুই হাজার মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করা যায়। বাকি চাহিদা মেটানো হয় এলএনজি আমদানির মাধ্যমে। ডলার সংকটের কারণে কম এলএনজি আমদানি হচ্ছে।
“এলএনজি আমদানি করার পরে সেটিকে তরল অবস্থা থেকে গ্যাসে রূপান্তরিত করা হয় দুটি ফ্লোটিং স্টেশনে। প্রতিটি স্টেশন থেকে গড়ে প্রতিদিন ৫০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ সম্ভব হয়। বর্তমানে একটি স্টেশন সচল থাকায় মোট সরবরাহ দুই হাজার ৫০০ থেকে ৬০০ মিলিয়ন ঘনফুটে এসে দাঁড়িয়েছে,” বলেন তিনি।
গত ১০ জানুয়ারি প্রকাশিত ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের বৈশ্বিক ঝুঁকি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জ্বালানি স্বল্পতাই আগামীতে বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য সবচেয়ে বড় ঝুঁকির কারণ হতে পারে।
প্রতিবেদনে জ্বালানি-সংকটের কারণে গ্যাসনির্ভর শিল্প বিশেষ করে সিরামিক, ইস্পাত, টেক্সটাইল—এসব খাতে উৎপাদন ব্যাহত হওয়ার কথা উল্লেখ করা হয়। বর্ধিত দামে চাহিদার তুলনায় ৬০ শতাংশ গ্যাস সরবরাহ পাওয়ার কথাও বলা হয়েছে ওই প্রতিবেদনে।