১৪৯ কোটি টাকায় হরিপুর গ্যাস ক্ষেত্রে কূপ খনন করবে চীনা কোম্পানি
2022.07.28
ঢাকা

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বাংলাদেশে সৃষ্ট গ্যাস সংকটের প্রেক্ষাপটে দেশের সবচেয়ে পুরানো হরিপুর গ্যাস ক্ষেত্র থেকে উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য সেখানে একটি কূপ খননের কাজ পেয়েছে চীনা কোম্পানি সিনোপেক।
অর্থমন্ত্রী আ. হ. ম মুস্তাফা কামালের সভাপতিত্বে বুধবার সরকারি ক্রয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির সভায় সিলেটের ১০ নম্বর কূপ খনন কাজ সিনোপেক ইন্টারন্যাশনাল পেট্রোলিয়াম সার্ভিসেস কর্পোরেশন চায়নাকে দেয়া হয়। অর্থ মন্ত্রণালয়ের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ কথা জানানো হয়েছে।
এই কাজে খরচ হবে ১৪৯ কোটি ১০ লাখ টাকার বেশি।
তবে বিশেষজ্ঞদের মতে, একটি কূপ খননে প্রায় ১৫০ কোটি টাকা ব্যয় অনেক বেশি। বাংলাদেশের রাষ্ট্রায়ত্ত্ব প্রতিষ্ঠান বাপেক্স কমপক্ষে ৫০ কোটি টাকা কম ব্যয়ে একই কাজ করতে সক্ষম।
সিলেট গ্যাসফিল্ড কোম্পানির আওতায় এই কূপ খনন প্রকল্পের পরিচালক আব্দুল কাদের ভূঁইয়া বৃহস্পতিবার বেনারকে বলেন, বুধবার সরকারি ক্রয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির সভায় সিনোপেক-কে যে কূপ খনন করতে দেয়া হয়েছে সেটি হরিপুর গ্যাসফিল্ডে করা হবে।
তিনি বলেন, হরিপুর গ্যাসফিল্ডে মোট নয়টি গ্যাস কূপ রয়েছে। সিনোপেককে ১০ নম্বর কূপ খননের কাজ দেয়া হয়েছে। খুব তাড়াতাড়ি আমরা আশা করছি কূপ খনন শেষ হবে।
তবে তিনি কোন সময় উল্লেখ করেননি।
আন্তর্জাতিক জরিপ অনুযায়ী, সিলেট গ্যাসফিল্ড কোম্পানির আওতায় থাকা হরিপুর গ্যাস ক্ষেত্রে চার’শ বিলিয়ন ঘনফুটের বেশি গ্যাস রয়েছে এবং সেখান থেকে দৈনিক কমপক্ষে ৭০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উত্তোলন করা সম্ভব।
এই উৎপাদন জাতীয় গ্রীডে দেয়া সম্ভব হলে গ্যাস সংকট কিছুটা কমবে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন।
পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান নাজমুল আহসান বৃহস্পতিবার বেনারকে বলেন, গ্যাস সংকট সমাধান করতে দেশের গ্যাসক্ষেত্রগুলো থেকে কীভাবে সরবরাহ বৃদ্ধি করা যায় সে ব্যাপারে কাজ করছে সরকার।
তিনি বলেন, “আমাদের সিদ্ধান্ত, ২০২২ সালে থেকে ২০২৫ সালের মধ্যে ১৭টি পুরানো গ্যাসকূপ, যেগুলো পরিত্যক্ত হয়েছে অথবা বন্ধ রয়েছে সেগুলোকে উৎপাদনে ফিরিয়ে আনা হবে। যেখানে প্রমাণিত গ্যাস রিজার্ভ রয়েছে সেখানে ১২টি কূপ খনন করা হবে; এবং ১৭টি নতুন অনুসন্ধান কূপ খনন করা হবে।”
নাজমুল আহসান বলেন, এসব কাজে দেশীয় কোম্পানি বাপেক্স, রাশিয়ার গ্যাসপ্রম এবং চীনের সিনোপেক কাজ করছে।
তিনি বলেন, “গত বছর রাশিয়ার গ্যাসপ্রমকে ভোলায় তিনটি গ্যাসক্ষেত্র খননের কাজ দেয়া হয়েছে এবং বুধবার চীনের সিনোপেককে কূপ খননের কাজ দেয়া হয়েছে। বর্তমানে সিনোপেক একটি কাজ করছে। এর আগে সিনোপেক একটি কাজ করেছিল।”
পেট্রোবাংলা চেয়ারম্যান বলেন, “বাপেক্সের চারটি রিগ রয়েছে। তারা কাজ করছে। এ ছাড়াও তাদের দুটি পুরানো রিগ রয়েছে। সেগুলোকেও ব্যবহার উপযোগী করার ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। আশা করা যায়, গ্যাস সংকটের সমাধান হবে।”
বাংলাদেশে প্রতিদিন প্রায় সর্বোচ্চ দুই হাজার ৮০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস প্রয়োজন হয়, যার বড় অংশ দেশের বিভিন্ন গ্যাসক্ষেত্র থেকে উৎপাদিত হয়। এসব গ্যাসক্ষেত্র থেকে প্রাপ্ত কন্ডেনসেট থেকে কেরোসিন, পেট্রোল ও অকটেন পাওয়া যায়।
গ্যাস শুধু জ্বালানি হিসাবে ব্যবহৃত হয় না, দেশের শতকরা ৬৫ ভাগ বিদ্যুৎ কেন্দ্র গ্যাসে পরিচালিত হয়। এ ছাড়াও, সার উৎপাদনের কাঁচামাল হিসাবে গ্যাস ব্যবহৃত হয়।
বাংলাদেশে মোট ২৬টি গ্যাস ক্ষেত্র রয়েছে যেগুলোর অধিকাংশই বৃহত্তর সিলেট জেলায়। সবকটি গ্যাস ক্ষেত্রের মধ্যে হবিগঞ্জের বিবিয়ানা থেকে দেশের মোট গ্যাস চাহিদার প্রায় ৫০ ভাগ গ্যাস আসে।
সিলেট গ্যাস ফিল্ড কোম্পানির আওতায় থাকা চারটি গ্যাস ক্ষেত্র রয়েছে। সেগুলো হলো; হরিপুর গ্যাস ক্ষেত্র, কৈলাসটিলা গ্যাস ক্ষেত্র, রশিদপুর গ্যাস ক্ষেত্র এবং বিয়ানিবাজার গ্যাস ক্ষেত্র।
দেশের প্রয়োজনীয় গ্যাসের ঘাটতি কাতারসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো থেকে তরলীকরণ করে আমদানি করা হয়। তরলীকৃত গ্যাস দেশে পুনরায় গ্যাস আকারে ব্যবহার করা হয়।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর রাশিয়ার তেল-গ্যাস বিক্রির ওপর পশ্চিমা অবরোধের কারণে বিশ্ববাজারে গ্যাসের দাম প্রায় ১০ গুণ বেড়েছে। যুদ্ধ শুরুর আগে প্রতি ঘনফুট গ্যাস সর্বোচ্চ পাঁচ ডলারে কেনা যেতো। সেই একই পরিমাণ গ্যাসের দাম ৫০ ডলার পর্যন্ত উঠেছে।
এই অস্বাভাবিক দামের কারণে সরকার বিদেশ থেকে এলএনজি কিনছে না। ফলে দেশের বিভিন্ন শিল্প, কলকারখানাসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে গ্যাসের সংকট দেখা দিয়েছে। সংকটের কারণে বিদ্যুৎ উৎপাদন কমে এসেছে এবং সারাদেশে বিদ্যুৎ বিভ্রাট চলছে।
সিলেট গ্যাস ফিল্ড কোম্পানির আওতায় চার ক্ষেত্রের বর্তমান অবদান খুব বেশি না হলেও তা বৃদ্ধির সুযোগ রয়েছে।
কোম্পানির ৩৭তম পরিচালক বোর্ডের সভার কার্যপত্রে বলা হয়, হরিপুর গ্যাস ক্ষেত্র বাংলাদেশের সবচেয়ে পুরানো এবং এই ক্ষেত্রে এখন পর্যন্ত নয়টি কূপ খনন করা হয়েছে।
বলা হয়েছে, মেসার্স স্লুমবার্গার সিয়াকো কোম্পানির সাম্প্রতিক একটি ত্রিমাত্রিক জরিপ অনুযায়ী হরিপুর গ্যাস ক্ষেত্র থেকে চার’শ ছয় বিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উত্তোলন করা সম্ভব।
পাকিস্তান আমলে ১৯৫৫ সালে শুরুর পর থেকে হরিপুর গ্যাস ক্ষেত্র থেকে ২০১৯ সালের জুন মাস পর্যন্ত ২১৫ বিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উত্তোলন করা হয়েছে।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের পেট্রোলিয়াম ও খনিজ সম্পদ প্রকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ম. তামিম বৃহস্পতিবার বেনারকে বলেন, যদি হরিপুর গ্যাস ক্ষেত্রে চার’শ বিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস থাকে সেক্ষেত্রে সেখান থেকে দৈনিক ৭০ থেকে ১০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উত্তোলন করা যাবে।
তিনি বলেন, “একটি কূপ খননের জন্য ১৪৯ কোটি টাকা অনেক বেশি বলে আমি মনে করি। এই কাজ আমাদের রাষ্ট্রায়ত্ব প্রতিষ্ঠান বাপেক্স এক’শ কোটি টাকায় করতে পারতো।”
অধ্যাপক তামিম বলেন, “কূপ খনন খুব সাধারণ কাজের একটি। এই কাজ করার সক্ষমতা ও যন্ত্রপাতি দুটিই বাপেক্সের আছে। বাপেক্সের চারটি রিগ আছে। সেগুলোর একটি বসিয়ে খুব সহজেই এই খনন কাজ করা যেতো। সেটি না করে চীনা প্রতিষ্ঠানকে দেয়া হলো। কেন দেয়া হলো বুঝলাম না।”
তিনি বলেন, “কথায় কথায় বাপেক্সকে কাজে লাগানোর কথা বলা হয়। এমনকি যেসকল কাজ করার সক্ষমতা বাপেক্সের নেই সেখানেও বাপেক্সকে কাজে লাগানোর কথা বলা হয়। অথচ যেই কাজ বাপেক্স খুব সহজভাবে করতে পারে, সেই কাজের জন্য গ্যাসপ্রম, সিনোপেককে বেশি টাকায় নিয়োগ করা হচ্ছে।”
অধ্যাপক তামিম বলেন, “যদি সরকার সাধারণ কাজও বিদেশি কোম্পানিকে দিয়ে করায়, সেক্ষেত্রে কথায় কথায় বাপেক্সকে কাজে লাগানোর কথা বলা বন্ধ করতে হবে।”