গাজীপুরে গ্যাস সিলিন্ডারের আগুনে একজনের মৃত্যু, ১০ জনের শরীর ৯০ শতাংশ পুড়েছে
2024.03.15
ঢাকা

গাজীপুরের কালিয়াকৈরে গ্যাস সিলিন্ডার ছিদ্র হয়ে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় দগ্ধ ৩৬ জনের মধ্যে একজন চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন। শুক্রবার বেলা ১১টার দিকে সোলাইমান মোল্লা (৪৫) নামের ওই ব্যক্তির মৃত্যু হয় বলে জানান শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের জরুরি বিভাগের ভারপ্রাপ্ত আবাসিক চিকিৎসক মৃদুল সরকার।
তিনি বেনারকে জানান, “ওই রোগীর শরীরের ৯৫ শতাংশ ফ্লেইম বার্ন হয়েছিল, সঙ্গে শ্বাসতন্ত্র পুড়ে যাওয়ার মতো সমস্যা ছিল।”
শারীরিক অবস্থার অবনতি হওয়ায় বৃহস্পতিবার রাতেই সোলাইমান মোল্লাকে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে স্থানান্তর করা হয়। তিনি স্থানীয় একটি কারখানার শ্রমিক ছিলেন।
বুধবার বিকেল ওই অগ্নিকাণ্ডে দগ্ধদের অধিকাংশই তৈরি পোশাক খাতের শ্রমিক বা শ্রমিক পরিবারের সদস্য বলে জানিয়েছে স্থানীয় পুলিশ। সোলাইমানের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে কালিয়াকৈরে সিলিন্ডার অগ্নিকাণ্ডে আহতদের মধ্যে প্রথম কেউ মারা গেলেন। চিকিৎসকরা আগেই জানিয়েছেন, হাসপাতালে ভর্তি রোগীদের অধিকাংশের অবস্থাই আশঙ্কাজনক।
বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ও আইসিইউ কনসালটেন্ট একরামুল হক সজল বৃহস্পতিবার রাতে সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, আইসিইউতে নেওয়া রোগীদের কারও অবস্থাই ভালো নয়।
দগ্ধ রোগীদের দেখতে গিয়ে বৃহস্পতিবার স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণমন্ত্রী সামন্ত লাল সেন সাংবাদিকদের বলেন, রোগীদের প্রায় সবার অবস্থা সংকটাপন্ন।
গাজীপুরের এই অগ্নিদুর্ঘটনায় আহত ৩৬ জনের মধ্যে ৩২ জন ঢাকার হাসপাতালটিতে ভর্তি রয়েছেন।
ডা. সামন্ত লাল সেন বলেন, “ভর্তি রোগীদের মধ্যে ৫০ শতাংশের বেশি বার্ন আছে ১৬ জনের, ৯০ শতাংশ বা তার চেয়ে বেশি দগ্ধ হওয়া রোগী ১০ জন।”
তিনি আরও বলেন, হাসপাতালে ভর্তি থাকা অগ্নিদগ্ধ ৭ শিশুর কেউই শঙ্কামুক্ত নয়, কারণ তাদের সবারই শ্বাসনালি পুড়েছে।
বুধবার সন্ধ্যায় ইফতারের আগে গ্যাস সিলিন্ডার থেকে ওই অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে কালিয়াকৈর উপজেলার মৌচাক তেলিরচালা এলাকায়। টপস্টার কারখানার পাশে শফিকুল ইসলাম নামের এক ব্যবসায়ী জমি ভাড়া নিয়ে কলোনি তৈরি করে এই এলাকাটিতে গার্মেন্ট শ্রমিকদের ভাড়া দিয়েছিলেন।
স্থানীয়দের বরাতে পুলিশ জানিয়েছে, ওই বাড়িতে থাকা সিলিন্ডারের গ্যাস শেষ হয়ে গেলে পাশের একটি দোকান থেকে শফিকুল নিজেই একটি গ্যাস সিলিন্ডার কিনে আনেন। সেই সিলিন্ডার লাগানোর সময় চাবি ভেঙ্গে যায়, কিন্তু গ্যাস বের হতে থাকে। এই গ্যাস পাশের চুলা থেকে আগুনের সংস্পর্শে আসে। তখন ওই ব্যক্তি গ্যাস সিলিন্ডারটি ছুড়ে মারেন। এ সময় আশপাশের উৎসুক নারী, পুরুষ ও শিশুদের শরীরে আগুন লেগে যায়।
এ ঘটনায় গাজীপুর ফায়ার সার্ভিসের উপ-সহকারী পরিচালক আব্দুল্লাহ্ আল আরেফিন জানান, সংবাদ পাওয়ার পরপরই ঘটনাস্থলে ফায়ার সার্ভিসের টিম যায়। সেখানে গিয়ে দগ্ধ কাউকে পাওয়া যায়নি। ফায়ার সার্ভিস যাওয়ার আগেই দগ্ধদের চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে।
গ্যাসের আগুনে ৩৬ জন দগ্ধ হওয়ার ঘটনায় তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছে জেলা প্রশাসন। বৃহস্পতিবার সকালে জেলা প্রশাসক আবুল ফাতে মো. সফিকুল ইসলাম ঘটনাস্থল পরিদর্শন শেষে এ তথ্য জানান।
গাজীপুরে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা এমন সময় ঘটলো যখন ঢাকার বেইলি রোডে একটি ভবনে আগুনে ৪৬ ব্যক্তির মৃত্যুর ঘটনার পর ঢাকায় বিভিন্ন ভবনে অভিযান চালিয়ে শতাধিক ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করেছে কর্তৃপক্ষ।
এদিকে বৃহস্পতিবার এক বিবৃতিতে ক্ষোভ প্রকাশ করে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) বলেছে, নিয়মিত বিরতিতে অগ্নিকাণ্ড ও মর্মান্তিক প্রাণহানির ঘটনায় সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষের দায় এড়িয়ে যাওয়ার সংস্কৃতি তৈরি হয়েছে।
রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব, দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানের নিষ্ক্রিয়তা, সমন্বয়হীনতা, দুর্নীতি, জবাবদিহির অনুপস্থিতি ও বিচারহীনতা মর্মান্তিক অগ্নিকাণ্ডের পুনরাবৃত্তির কারণ হিসেবে উল্লেখ করে দায়িত্বে অবহেলা ও অনিয়ম-দুর্নীতির সাথে সম্পৃক্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিতের আহ্বান জানিয়েছে সংস্থাটি।
গত ২৯ ফেব্রুয়ারি রাতে বেইলি রোডে অবস্থিত গ্রিন কোজি কটেজ ভবনে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় ৪৬ জনের মর্মান্তিক মৃত্যু হয়। এ ঘটনার প্রেক্ষিতে গণমাধ্যমে প্রেরিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে অগ্নিকাণ্ডের পুনরাবৃত্তি রোধে উদ্যোগী না হয়ে দায় এড়ানোর প্রচেষ্টার সমালোচনা করেছে টিআইবি।
এর আগে পুরানো ঢাকায় একাধিকবার সংঘটিত ভয়াবহ অগ্নিদুর্ঘটনার প্রেক্ষিতে টিআইবি ২০২০ সালে “নিমতলী, চুড়িহাট্টা এবং অতঃপর: পুরানো ঢাকার অগ্নি নিরাপত্তা নিশ্চিতে সুশাসনের চ্যালেঞ্জ” শীর্ষক গবেষণা পরিচালনা করেছিল।
নিরাপত্তা সংক্রান্ত আইন প্রয়োগ জরুরি: আইএলও
গাজীপুরের ও বেইলি রোডের অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা উল্লেখ করে বৃহস্পতিবার এক বিবৃতিতে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) বলেছে, বেইলি রোডসহ বাংলাদেশে সাম্প্রতিক সময়ের অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাগুলো প্রমাণ করে—কর্মস্থল ও জনসমাগমস্থল নিরাপদ রাখতে আগুন প্রতিরোধ, নিরাপত্তা এবং এ-সংক্রান্ত আইন প্রয়োগের সংস্কৃতি গড়ে তোলা জরুরি।
বিবৃতিতে সংস্থাটি জরুরি ভিত্তিতে নিরাপত্তা বাড়ানো, নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর সংস্কার এবং এ ধরনের দুর্ঘটনাগুলো এড়াতে শক্ত আইন প্রয়োগের দাবি জানিয়েছে।
এতে বলা হয়, অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাগুলো এটাই প্রমাণ করে যে শ্রমিকদের নিরাপদ রাখতে বাংলাদেশের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এবং ভবন মালিকদের নিরাপত্তাসংক্রান্ত বিধিবিধানগুলো কঠোরভাবে নিশ্চিত করা এবং ইমারত বিধিমালা (বিল্ডিং কোড) কঠোরভাবে মেনে চলা কতটা জরুরি।
আইএলও কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্যবিধির রূপরেখা এবং এ-সংক্রান্ত জাতীয় কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়নে সরকারকে সহযোগিতা করবে বলেও বিবৃতিতে জানায়।
দুর্ঘটনা বাড়ায় দুর্বল প্রস্তুতি ও নিম্নমানের মালামাল: বিশেষজ্ঞ
বাংলাদেশে ক্রমবর্ধমান অগ্নিকাণ্ডের পেছনে নিম্নমানের মালামাল ও দুর্বল প্রস্তুতি বা প্রশিক্ষণ অনেক ক্ষেত্রে দায়ী বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞ ও সংশ্লিষ্টরা।
ফায়ার সার্ভিসের উপপরিচালক দিনমনি শর্মা বেনারকে বলেন, অগ্নি দুর্ঘটনার বিষয়ে তাদের পরিদর্শন এবং বিশ্লেষণ বলছে দুর্ঘটনার একটি বড় অংশ বৈদ্যুতিক ত্রুটির সাথে সম্পর্কিত এবং বেশিরভাগই ক্ষেত্রেই নিম্নমানের বৈদ্যুতিক তার ও অন্যান্য উপকরণ স্থাপনাকে ঝুঁকিপূর্ণ করে তোলে।
“অনেক উঁচু ভবনে দুর্বল ও এলোমেলো ওয়্যারিং আছে এবং ধারণক্ষমতার চেয়ে অনেক কম মানের তার ভবনে বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে,” বলেন তিনি।
ফায়ার সার্ভিসের এক সাম্প্রতিক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সারা দেশে অগ্নিকাণ্ডের প্রায় দুই-পঞ্চমাংশ বৈদ্যুতিক শর্ট সার্কিট এবং অন্যান্য বৈদ্যুতিক ত্রুটির কারণে হয়ে থাকে।
বাংলাদেশ ফায়ার সার্ভিস সিভিল ডিফেন্সের তালিকাভুক্ত অগ্নিনিরাপত্তা পরামর্শক এবং অ্যাশরে বাংলাদেশ চ্যাপ্টারের সভাপতি প্রকৌশলী মো. হাসমতুজ্জামান বেনারকে বলেন, “নিম্ন মানের মালামালের পাশাপাশি দুর্বল প্রশিক্ষণও খুব বড় কারণ। খেয়াল করলে দেখা যাবে, অনেক অগ্নিকাণ্ড ছোট থেকে মুহূর্তেই বড় হয়ে যাচ্ছে। নাগরিকদের মধ্যে এ বিষয়ে পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ নেই বলেই এমনটি হচ্ছে।”