গ্যাস-বিদ্যুতের বাড়তি দামে সাধারণ মানুষের নাভিশ্বাস
2024.03.13
ঢাকা

গ্যাসের চাপ না থাকলে সিলিন্ডার ব্যবহার করতে পারেন—বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রীর এমন মন্তব্যে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন দেশের সাধারণ মানুষ ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা।
তাঁদের মতে, চলতি মাসের শুরুতে বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির পর, তিতাসের সরবরাহ করা গ্যাসের চেয়ে বেশি দামে সিলিন্ডারের গ্যাস ব্যবহার করতে হলে নির্দিষ্ট ও নিম্ম আয়ের মানুষের ওপর বাড়তি চাপ পড়বে, অনেকের জীবনমান প্রভাবিত হবে।
গত বছরের নভেম্বর থেকে ঢাকা ও চট্টগ্রামে গৃহস্থালি ও শিল্প কারখানায় গ্যাস সংকট শুরু হয়। কারিগরি ত্রুটির কারণে মহেশখালী এলএনজি টার্মিনাল থেকে গ্যাস সরবরাহ কমে যাওয়ায় ব্যাহত হয় বিদ্যুৎ উৎপাদনও।
গত ২১ জানুয়ারি প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ আশ্বাস দিয়েছিলেন, গ্যাসের সমস্যা অচিরেই মিটে যাবে।
সমস্যার মেটার পরিবর্তে আরও জটিল হয়েছে। রাজধানী ঢাকার অধিকাংশ এলাকায় রমজান মাসে পাইপের গ্যাস থাকছে না। আবার ভোক্তা পর্যায়ে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাসের (এলপিজি) দাম চলতি মার্চ মাসেও বেড়েছে।
সরকারি হিসেবে, এ নিয়ে টানা আট মাস জ্বালানি পণ্যটির দাম বাড়াল নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)। গত আগস্টে ১২ কেজি সিলিন্ডারের দাম ছিল ১ হাজার ১৪০ টাকা, গত ৪ মার্চ তা ১ হাজার ৪৮২ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে।
বিকল্প হিসেবে এলপিজি ব্যবহারের পরামর্শ প্রতিমন্ত্রীর
বুধবার বিদ্যুৎ ভবনে নসরুল হামিদ সাংবাদিকদের জানান, মহেশখালীতে একটি এফএসআরইউটি (ভাসমান গ্যাস টার্মিনাল) রক্ষণাবেক্ষণ চলছে। আগামী ৩০ মার্চের আগে ঠিক হওয়ার সম্ভাবনা নেই।
গ্যাস সরবরাহ কবে স্বাভাবিক হবে জানতে চাইলে প্রতিমন্ত্রী বলেন, “বাসা-বাড়িতে যেসব এলাকায় গ্যাসের স্বল্পতা দেখা যাচ্ছে, তারা বিকল্প হিসেবে এলপিজি ব্যবহার করতে পারেন। কোনো শিল্প কারখানায় গ্যাস সরবরাহ বন্ধ করার কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি।”
তিনি বলেন, “আমাদের নিজস্ব গ্যাসের উৎপাদনও কিছুটা কমেছে।”
রমজান মাসে কিছু সময় বিদ্যুৎ বিভ্রাট হতে পারে বলে জানান নসরুল হামিদ।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন ‘কৃত্রিম সংকট’
তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির প্রধান অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বুধবার নসরুল হামিদের বক্তব্যের জবাবে বলেন, “ঢাকা-চট্টগ্রামে যে গ্যাস সংকট চলছে সেটি প্রকৃতপক্ষে কৃত্রিম সমস্যা। দেশের কিছু কোম্পানি; যারা দেশের গ্যাসের বাজার নিয়ন্ত্রণ করে, এটি তাদের পরিকল্পনা ছাড়া আর কিছু না।”
তিনি বলেন, “আপনাদের মনে থাকার কথা, বছর কয়েক আগে নসরুল হামিদ বলেছিলেন ‘আমাদের এলপিজিতে যেতে হবে’। সেই কথাই তিনি আবার বলেছেন। এই সংকটের ফলে যা হবে, মানুষ বাধ্য হয়ে সিলিন্ডার কিনবে এবং গ্রাহকের সংখ্যা যত বাড়বে, দামও ততো বাড়বে। এটি নিয়ন্ত্রণ করার কোনো উপায় থাকবে না।
“মানুষের স্বার্থ করার রক্ষা কথা বললেও সরকার তা করছে না। ব্যবসায়ীরা তাদের মুনাফাখোরী চালিয়ে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে, মানুষের প্রতি সরকারের কোনো দায়িত্ব নেই,” বলেন তিনি।
আনু মুহাম্মদ আরও বলেন, “মনে রাখতে হবে, তেল, গ্যাস, বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি করা হলে সেটির একটি মাল্টিপ্লাইয়ার ইফেক্ট আছে—সব কিছুরই দাম বাড়বে। জীবন বাঁচানোর জন্য মানুষ খাওয়া কমিয়ে দেবে, চিকিৎসা খরচ বাদ দেবে।”
রাজধানীর মিরপুর সাড়ে এগারো এলাকার গ্যাস সিলিন্ডার বিক্রেতা মো. সেলিম (ছদ্মনাম) বেনারকে বলেন, গত বছর ১২ কেজি সিলিন্ডারের দাম ছিল ৯৫০ টাকা। আজকে সেই সিলিন্ডারের দাম এক হাজার ৬০০ টাকা।
“আমরা খুচরা বিক্রেতা, আমরা দাম কমাতে বা বাড়াতে পারি না। বেক্সিমকো, বসুন্ধরাসহ বিভিন্ন কোম্পানির কাছ থেকে আমরা গ্যাস কিনে বিক্রি করি, বিক্রির বিপরীতে কমিশন পাই। কোম্পানি দাম না কমালে বিক্রেতাদের কিছু করার নেই।”
পাইপলাইনে গ্যাস না থাকায় সিলিন্ডার গ্যাস বিক্রি বেড়েছে বলেও জানান তিনি।
‘রাত দুইটায় গ্যাসের চাপ আসে’
ঢাকা মহানগরীর পল্লবী এলাকার সি-ব্লকের একটি বাসায় ভাড়া থাকেন মোহাম্মদ সুমন। তিনি বুধবার বেনারকে বলেন, “সারা দিন গ্যাস থাকে না, ইফতারের সময়ও থাকে না। রাত ১০টার পর থেকে মোমবাতির মতো চুলা জ্বলতে থাকে। তার ২টার দিকে গ্যাসের চাপ আসে, আবার সেহরির সময় চলে যায়। গতকাল দোকান থেকে খিচুড়ি কিনে আমি ও আমার স্ত্রী ইফতার করেছি।”
সুমন বলেন, “আমার স্ত্রী ঘুম বাদ দিয়ে গ্যাসের জন্য অপেক্ষা করে থাকে। এভাবে চলতে থাকলে তো মানুষ অসুস্থ হয়ে যাবে। মাসে বেতন পাই ১৫ হাজার টাকা। ১২ কেজির সিলিন্ডারের দাম এক হাজার ৬০০ টাকা। গ্যাসের বিলও দেবো, আবার সিলিন্ডার কিনবো; এটা কেমন কথা!”
পেট্রোবাংলার হিসাবে, বাংলাদেশে দৈনিক সাড়ে চার হাজার মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস প্রয়োজন। এর মধ্যে মহেশখালীতে অবস্থিত ভাসমান দুটি টার্মিনালের মাধ্যমে এক হাজার মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস আসে। ভাসমান এই টার্মিনালে বিদেশ থেকে আমদানি করা তরল গ্যাস পুনরায় গ্যাসে রূপান্তরিত করা হয়। মোট চাহিদার বিপরীতে বর্তমানে দৈনিক প্রায় দু্ই হাজার ৭০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করা হচ্ছে।
নভেম্বরে মার্কিন কোম্পানি এক্সিলারেট তার টার্মিনাল রক্ষণাবেক্ষণ শুরু করলে দৈনিক ৫০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের ঘাটতি হয়। জানুয়ারিতে সেটি পুনরায় উৎপাদন শুরু করলে সামিট পাওয়ারের ভাসমান টার্মিনালটি রক্ষণাবেক্ষণে পাঠানো হয়, যা এখনো চালু হয়নি।
বিদ্যুতের দাম বাড়ার ধকল কাটেনি
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল থেকে সাড়ে চার বিলিয়ন ডলার ঋণ পেতে বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকি তুলে নেওয়ার শর্ত মেনে গত মাসের শেষে বিদ্যুতের দাম বাড়িয়েছে সরকার।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম মনে করেন, বিদ্যুৎ খাতে স্বচ্ছতা না এনে ভর্তুকি তুলে নেওয়ার সিদ্ধান্ত সঠিক হয়নি।
বুধবার এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, নিম্ন ও মধ্যবিত্ত পরিবারের আবাসিক খাতে গড়ে খরচ বাড়বে নয় দশমিক চার শতাংশ। এতে তাদের বিদ্যুৎ বিল বাড়বে গড়ে ১০৬ থেকে ১১৮ টাকা। কৃষি সেচে খরচ বাড়বে ১১ শতাংশের বেশি। এতে বেড়ে যেতে পারে কৃষি পণ্যের দাম।
মোয়াজ্জেম বলেন, বিদ্যুৎচালিত কারখানায় উৎপাদিত পণ্যের দাম বেড়ে যাবে। সেখানেও ভোক্তার খরচ বাড়বে।
বিদ্যুতের ক্যাপাসিটি চার্জ বন্ধ করে প্রতিযোগিতামূলক দামে বিদ্যুৎ কেনার পরামর্শ দেন তিনি।
সংকটের জন্য সরকার দায়ী: বিএনপি
গ্যাস সংকটের জন্য আওয়ামী লীগ সরকারকে দায়ী করেছে বিএনপি।
দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আবদুল মঈন খান বুধবার ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, দেশের অর্থনীতির অবস্থা ভালো নয়। রোজা রেখে ঠিকমতো ইফতার পর্যন্ত করতে পারে না সাধারণ মানুষ। দরিদ্র মানুষের জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে। দেশের মানুষের অবস্থা ত্রাহি ত্রাহি।