বিশেষ সুযোগ রেখেই সংসদে বাল্য বিবাহ বন্ধের আইন পাস
2017.02.27

বিশেষ প্রেক্ষাপটে কম বয়সী ছেলে-মেয়েদের বিয়ের বিধান রেখে ‘বাল্য বিবাহ নিরোধ বিল-২০১৭’ পাস করেছে বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ। নারী, শিশু, মানবাধিকার ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংগঠনের আপত্তির মুখে বিলটি পাস হলো।
গতকাল সোমবার মহিলা ও শিশু বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী মেহের আফরোজ চুমকি বিলটি পাসের প্রস্তাব করলে জাতীয় সংসদে কণ্ঠভোটে তা পাস হয়। নতুন আইনটি ১৯২৯ সালের ব্রিটিশ বাল্য বিবাহ আইনের পরিবর্তে পাস হলো।
এর আগে বিলের ওপর দেওয়া বিরোধী দল জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্যদের জনমত যাচাই, বাছাই কমিটিতে পাঠানো ও সংশোধনী প্রস্তাবগুলো নিয়ে আলোচনা হলেও পরে কণ্ঠভোটে তা নাকচ হয়।
নতুন এই আইন অনুযায়ী মেয়ে ও ছেলেদের বিয়ের ন্যূনতম বয়স হবে যথাক্রমে ১৮ ও ২১ বছর। তবে আইনটিতে ‘বিশেষ প্রেক্ষাপটে’ অপ্রাপ্তবয়স্কদের বিয়ের সুযোগ সুযোগ দেওয়া হয়েছে।
তবে এই বিশেষ প্রেক্ষাপট কী এবং এর আওতায় কত কম বয়সে বিয়ে করা যাবে, তা আইনে সুস্পষ্ট করা হয়নি। এ বিষয়ে নীতিমালা করা হবে।
আইনে বলা হয়, এ বিলের অন্যান্য বিধানে যা কিছুই থাকুক না কেন, কোনো বিশেষ প্রেক্ষাপটে অপ্রাপ্তবয়স্ক কোনো নারীর সর্বোত্তম স্বার্থে, আদালতের নির্দেশ এবং পিতা-মাতার সম্মতিক্রমে, বিধি দ্বারা নির্ধারিত প্রক্রিয়া অনুসরণক্রমে বিবাহ সম্পাদিত হলে তা এ আইনের অধীন অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে না।
গতকাল মহিলা ও শিশু বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী বিলটি পাসের প্রস্তাব করেন। এ সময় উপস্থিত সংসদ সদস্যরা একইসঙ্গে ‘হ্যাঁ’ বলে চিৎকার করে নিজেদের সমর্থন জানান।
এরপর স্পিকার শিরিন শারমিন চৌধুরী বলেন, “আমি মনে করি ‘হ্যাঁ’ জয়যুক্ত হয়েছে। তাই ‘বাল্য বিবাহ নিরোধ বিল-২০১৭’ সংসদে পাস হলো।”
১৮ বছরের কম বয়সী মেয়েদের এবং ২১ বছরের নিচে ছেলেদের বিয়ের বিধান রাখার বিশেষ সুযোগ নিয়ে আপত্তি জানিয়ে আসছিলেন নারী নেত্রী ও মানবাধিকার কর্মীরা। তাঁদের মতে, বিশেষ বিধানযুক্ত এই আইন বাংলাদেশ বাল্যবিয়ের হার কমাতে ব্যর্থ হবে।
বিশ্বে বাল্যবিবাহের শীর্ষদেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। সরকারি হিসেবে, এ দেশে ১৮ বছরের আগে ৫১ শতাংশ মেয়ের বিয়ে হয়।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির নির্বাহী পরিচালক সালমা আলী বেনারকে বলেন, “আমরা পাস হওয়া এ আইনকে আদালতে চ্যালেঞ্জ করব। কারণ, এটা বিদ্যমান শিশু আইন এবং মুসলিম বিবাহ আইনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।”
এর ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, “এই দুটি আইনে বলা আছে, মেয়েদের বিয়ের ন্যূনতম বয়স ১৮ বছর। অথচ সদ্য পাস হওয়া আইনে বিশেষ পরিপ্রেক্ষিতে ১৮ বছরের নিচেও মেয়েদের বিয়ে দেওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়েছে।”
তাঁর মতে, বাল্যবিবাহ রোধ আইন-২০১৭ বাংলাদেশে বাল্যবিবাহের হার কমানোর পরিবর্তে আরও বাড়াবে।
সালমা আলী বলেন, “মানুষ এ আইনের অপব্যবহার করবে। বৈবাহিক ধর্ষণের হার বাড়াবে। ফলে মেয়েরা ভয়াবহ মানবাধিকার লঙ্ঘনের শিকার হবে।”
আইনটি পাস হওয়ার আগে জাতীয় সংসদে আলোচনায় অংশ নিয়ে এই ‘বিশেষ পরিপ্রেক্ষিত’ সুস্পষ্ট করার সংশোধনী প্রস্তাব দিয়েছিলেন বিরোধী দলীয় সংসদ সদস্য ফখরুল ইমাম।
তিনি বলেন, “মানবিক কারণে এই বিশেষ বিধান রাখা হয়েছে, বলা হচ্ছে। তবে এটা কোন ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে, তার সুস্পষ্ট (নীতিমালা) থাকা দরকার।”
উদাহরণ টেনে তিনি বলেন, “ওই বিশেষ বিধানের সুযোগে একজন বয়স্ক ব্যক্তি অপ্রাপ্তবয়স্ক কোনো মেয়েকে ফুসলিয়ে অবৈধ মেলামেশার মাধ্যমে তাকে গর্ভবতী করে, পরে তাকে বিয়ে করতে পারবে।”
জবাবে প্রতিমন্ত্রী মেহের আফরোজ চুমকি সংসদকে বলেন, “কেউই দুরভিসন্ধিমূলকভাবে আইনের এ বিশেষ ধারাটির সুবিধা নিতে পারবে না।”
তিনি বলেন, “যেকোনো অনভিপ্রেত ঘটনার ক্ষেত্রে পিতামাতা বা বৈধ অভিভাবক এবং আদালতের সম্মতি লাগবে। আদালতের অনুমতি ছাড়া কাউকে (১৮ বছরের কম বয়সী মেয়ে এবং ২১ বছরের নিচে ছেলে) বিয়ে দিতে পারবে না।”
বিলটির উদ্দেশ্য ও কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে প্রতিমন্ত্রী বলেন, “বাল্যবিবাহ বন্ধে একটি যুগোপযোগী আইন থাকা অত্যন্ত জরুরি। আমাদের দেশের মানুষ বাল্যবিবাহের কুফল সম্পর্কে জানেন, কিন্তু মানেন না।”
বাল্যবিবাহ বন্ধে যুগোপযোগী আইনটি ভূমিকা রাখবে বলে সংসদকে জানান তিনি।
সদ্য পাস হওয়া এই আইনে বলা আছে, কোনো অপ্রাপ্তবয়স্ক নারী বা পুরুষ বাল্য বিয়ে করলে তাকে সর্বোচ্চ এক মাসের কারাদণ্ড এবং ৫০ হাজার টাকা অর্থদণ্ডের দণ্ডিত করা হবে।
সংসদে উত্থাপিত বিলে প্রথমে ১৫ দিনের আটকাদেশ বা পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডের সম্মুখীন করার বিধান রাখার প্রস্তাব করা হয়েছিল। সংসদীয় কমিটির সংসদীয় কমিটি ওই দণ্ড পরিবর্তনের সুপারিশ করে।
গত ৮ ডিসেম্বর বিলটি সংসদে তোলার পরে পরীক্ষা করে প্রতিবেদন দিতে মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে পাঠানো হয়। পরে প্রস্তাবিত আইনের ‘বিশেষ প্রেক্ষাপটে’ শুধু নারীদের ক্ষেত্রে বিয়ের বয়সে ছাড় না রেখে পুরুষের ক্ষেত্রেও ছাড় দেওয়ার সুপারিশ করে সংসদীয় কমিটি।
ওই বিশেষ প্রেক্ষাপটের ধারা আইনটিকে অকার্যকর করে ফেলবে বলে আশঙ্কা করছেন বিশ্লেষকেরা।
এ প্রসঙ্গে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক মিজানুর রহমান বেনার নিউজকে বলেন, “আইন মানার পরিবর্তে আইন ভঙ্গ করাই আমাদের সাধারণ প্রবণতা। তাই এই ‘বিশেষ পরিপ্রেক্ষিত’ নতুন বাল্য বিবাহ নিরোধ আইনটিকে ব্যর্থ করে দেবে।”
তিনি বলেন, সরকারকে অবশ্যই ১৮ বছরের কম বয়সী মেয়েদের সুরক্ষা করতে হবে।
তাঁর মতে, “কিশোরীদের সহায়তা করার বদলে রাষ্ট্র এমন আইন তৈরি করতে পারে না; যার মাধ্যমে অভিভাবকেরা সন্তানদের অল্প বয়সে বিয়ে দিতে পারবে।”