শেখ হাসিনার দিল্লি সফরের আলোচনায় ঘুরেফিরে আসছে তিস্তা প্রকল্প
2024.06.20
ঢাকা

বহুল আলোচিত তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি আলোর মুখ না দেখলেও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরে তিস্তা নদীর উন্নয়ন বা সংরক্ষণের লক্ষ্যে প্রায় এক বিলিয়ন ডলারের প্রকল্পে নয়াদিল্লি বিকল্প প্রস্তাব দিতে পারে বলে মনে করছে বাংলাদেশ।
গত মে মাসে ভারতের পররাষ্ট্রসচিব বিনয় কোয়াত্রা ঢাকা সফরকালে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ সাংবাদিকদের বলেন, ভারত তিস্তা প্রকল্পে অর্থায়নে আগ্রহ দেখিয়েছে। তিনি আরো বলেন, তিস্তার বাংলাদেশ অংশে বহুমুখী ব্যারেজ নির্মাণে চীনের পর ভারতও আগ্রহ দেখিয়েছে। যদিও এ বিষয়ে ভারতের প্রকাশ্য কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
তিস্তা অর্থায়নে ভারতের আগ্রহের বিষয়ে সাবেক পররাষ্ট্রসচিব তৌহিদ হোসেন বেনারকে বলেন, “আমার মনে হয়, চীনের সাথে বাংলাদেশের তিস্তা প্রকল্প হওয়ার যে সম্ভাবনা রয়েছে, ভারত সেখানে বাগড়া দিতে পারে।”
তিস্তা চুক্তির বিষয়ে পররাষ্ট্রসচিব মাসুদ বিন মোমেনকে উদ্ধৃত করে বৃহস্পতিবার দৈনিক প্রথম আলোর এক খবরে বলা হয়, “তিস্তা চুক্তিটি যে পর্যায়ে আছে, খুব শিগগির এতে ইতিবাচক কিছু ঘটবে, এমন কোনো পরিস্থিতি দেখা যাচ্ছে না। তবে আশার দিকটি হচ্ছে, তিস্তা ঘিরে উন্নয়ন প্রকল্প বা সংরক্ষণের বিষয়ে সম্প্রতি ভারত আগ্রহ দেখাচ্ছে।”
প্রস্তাবিত তিস্তা মহাপরিকল্পনায় রয়েছে, ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তের ভাটি থেকে তিস্তা-যমুনার মিলনস্থল পর্যন্ত নদীর প্রস্থ কমিয়ে ৭০০ থেকে এক হাজার মিটারে সীমাবদ্ধ করা ও নদীর গভীরতা ১০ মিটার বাড়ানো।
এছাড়া ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে পানি বহনক্ষমতা বাড়ানো, নদীর দুই পাড়ে বাঁধ মেরামত করা, নতুন ১০২ কিলোমিটার বাঁধ নির্মাণ করা ইত্যাদি।
উল্লেখ্য, বছর কয়েক আগে তিস্তায় একটি বৃহদায়তন উন্নয়ন প্রকল্প নিয়ে চীন বাংলাদেশকে প্রস্তাব দেয়। এ নিয়ে আগ্রহী থাকলেও ভারতের উদ্বেগের বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে বাংলাদেশ ওই প্রকল্পের ব্যাপারে কিছুটা ধীরে চলো নীতি অবলম্বন করে আসছে।
এদিকে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর প্রেস উইং জানিয়েছে, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির আমন্ত্রণে দুই দিনের রাষ্ট্রীয় সফরে শুক্রবার দিল্লি যাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। দুই সপ্তাহের মধ্যে এটা তাঁর দ্বিতীয় ভারত সফর। শনিবার সন্ধ্যায় তিনি দেশে ফিরবেন।
বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, দুই প্রধানমন্ত্রীর মধ্যকার বৈঠকে অভিন্ন নদী তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি, সীমান্ত হত্যা পুরোপুরি বন্ধের মতো বিষয়গুলোকে প্রাধান্য দেবে বাংলাদেশ। এছাড়া গুরুত্ব পাবে সহযোগিতার নতুন ক্ষেত্র নিয়ে আলোচনার পাশাপাশি অর্থনৈতিক সহযোগিতা, যোগাযোগ বা সংযুক্তি ও জ্বালানির মতো বিষয়গুলো।
প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানায়, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এই সফরে দুই দেশের মধ্যে ১০টির বেশি চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) সই ও নবায়ন হতে পারে।
এবারের দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে সেপা (সমন্বিত অর্থনৈতিক অংশীদারত্ব চুক্তি) আলোচনা শুরুর ঘোষণা দেওয়ার কথা, যেটি সই হলে দুই দেশের বাণিজ্যে ভারসাম্য আসার পথ সুগম হতে পারে।
শীর্ষ বৈঠকে এবার বাংলাদেশ-ভারত মৈত্রী সেতুর বিষয়ে ঘোষণা আসতে পারে। বাংলাদেশের খাগড়াছড়ির রামগড়ের সঙ্গে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের সাবরুমের মধ্যে এই সেতু যোগাযোগ স্থাপন করবে।
তবে এই সফরে দৃশ্যত বড় কোনো প্রাপ্তি আসবে বলে মনে করছেন না বিশ্লেষকদের কেউ কেউ।
এ বিষয়ে সাবেক পররাষ্ট্র সচিব তৌহিদ হোসেন বলেন, “এটা হবে সৌজন্য সফর। দুই দেশেরই প্রধানমন্ত্রী তাদের নতুন মেয়াদে প্রবেশ করেছেন। তাঁরা পরস্পর ঘনিষ্ঠ মনে করেন। এর বাইরে বড় কিছু হবে বলে আমি বিশ্বাস করি না। অন্তত বাংলাদেশের পক্ষে তেমন কিছু পাওয়ার সম্ভাবনা নেই।”
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক শান্তনু মজুমদার বেনারকে বলেন, “কূটনীতি কখনো একস্তর বিশিষ্ট হয় না। বিভিন্ন লেয়ার থাকে। একেক সফরে একেকটি বিষয় প্রাধান্য পায়। আমার কাছে মনে হয় না এই সফরে কোনো ব্র্রেক থ্রু হবে। তবে এটা দেখতে ভাল লাগে যে, প্রতিবেশিরা পরস্পরের সাথে সম্পর্ক উন্নয়নের চেষ্টা করছে।”
সফর ঘিরে রাজনৈতিক বিতর্ক
এমন একটি সময়ে প্রধানমন্ত্রী ভারত সফরে যাচ্ছেন যখন দেশের প্রধান বিরোধী দল বিএনপি ভারতীয় পণ্য বর্জনের ডাক দিয়ে যাচ্ছে। দলটি মনে করে বর্তমান সরকার ভারতকে সব উজাড় করে দিচ্ছে।
তবে রাজনীতি ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক ড. শান্তনু মজুমদার বেনারকে বলেন, বিএনপির ভারত বিরোধীতা বছর দশেক চাপা পড়ে ছিল। এবারের নির্বাচনের পরে বিএনপি তাদের অবস্থান পরিবর্তন করে তাদের সাবেকি অবস্থান ভারত বিরোধিতায় ফিরে গেছে।
“সম্প্রতি সোশ্যাল মিডিয়াতে ভারতীয় পণ্য বর্জনের ডাকের এই আহবান দেখার পরে বিএনপি এটাতে উৎসাহিত হয়। হয়তো দলটি ভাবছে ভারত বিরোধীতার মধ্য দিয়ে তারা পলিটিক্যাল মাইলেজ নিতে পারবে,” বলেন তিনি।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে এটা নতুন কোনো বিষয় নয়-উল্লেখ করে ড. শান্তনু বলেন, “বর্তমান ক্ষমতাসীনদের ভারতের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক। অন্য দলগুলো ক্ষমতায় আসলে তাদের সঙ্গে ভারতের এক ধরনের শীতল সম্পর্ক লক্ষ্য করা যায়।”
গত মঙ্গলবার নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে দলের জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেছেন, বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে ভারতের সামরিক ও বেসামরিক পরিবহনের জন্য বাংলাদেশের বুকের ওপর দিয়ে রেললাইন নেটওয়ার্ক তৈরি করার উদ্যোগ গ্রহণ করেছে ভারতীয় রেলওয়ে বোর্ড। এতে একটি স্বাধীন ও সার্বভৌমত্ব দেশের ‘ইন্টেলিজেন্স’ ব্যবস্থা ভেঙে পড়বে। ভারতকে সব উজাড় করে দেওয়ার পরিণতি হবে ভয়াবহ।
রুহুল কবির রিজভী বলেন, দেশের জনগণের ইচ্ছার বিরুদ্ধে গিয়ে বাংলাদেশের নতজানু সরকার যদি এই রেললাইন নেটওয়ার্ক বাস্তবায়ন করে, তাতে স্বাধীন বাংলাদেশের অস্তিত্ব ক্রমাগতভাবে মিলিয়ে দেওয়া হবে।
অন্যদিকে বৃহস্পতিবার ঢাকায় এক অুনষ্ঠানে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ‘‘ভারতের সঙ্গে বৈরী সম্পর্ক করে বিএনপি বাংলাদেশের ক্ষতি করেছে। ভারতের সঙ্গে বৈরিতা আমরা করতে চাই না। বন্ধুত্বপূর্ণ, ভারসাম্যমূলক ও সম্মানজনক পারস্পরিক কূটনীতি চাই।”
এক প্রশ্নের জবাবে ওবায়দুল কাদের বলেন, “সম্পর্ক বন্ধুত্বপূর্ণ হলে আলোচনার টেবিলে সমস্যার সম্মানজনক সমাধান সম্ভব। ভারতের সঙ্গে কম্প্রিহেনসিভ পার্টনারশিপ বাংলাদেশের জাতীয় স্বার্থেই। জাতীয় স্বার্থ বিকিয়ে দিয়ে কারও সঙ্গে সম্পর্ক করা হবে না।”
ভারতের পরেই হাসিনার চীন সফর
ভারত সফরের পরপরই চীন সফরে যাবেন শেখ হাসিনা। ৯ জুলাই থেকে ১২ জুলাই দ্বিপাক্ষিক এই সফরটি হবে চার দিনের।
প্রধানমন্ত্রীর চীন সফরে কী কী বিষয় নিয়ে আলোচনা হবে, তা নিয়ে এখনো কাজ চলছে বলে জানিয়েছেন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা।
প্রধানমন্ত্রীর এই সফর প্রসঙ্গে তৌহিদ হোসেন বলেন, “দুই দেশের সাথেই সাবসটেন্টিভ স্বার্থ আছে আমাদের। সে কারণেই প্রধানমন্ত্রী দুই (ভারত ও চীন) দেশেই যাবেন। এছাড়া চীনের কাছে ৫ মিলিয়ন ডলারের একটা ঋণ আশা করছে বাংলাদেশ।”