পার্বত্য এলাকায় আবারো হাম, প্রাণ গেলো ৮ শিশুর

জেসমিন পাপড়ি
2020.03.30
ঢাকা
200330_measles_1000.jpeg রাঙ্গামাটি জেলার সাজেক ইউনিয়নে হামে আক্রান্ত শিশুদের চিকিৎসা দিচ্ছেন সেনাবাহিনীর স্বাস্থ্যকর্মীরা। মার্চ ২০২০।
[সৌজন্যে: আইএসপিআর]

বাংলাদেশের পার্বত্য এলাকায় আবারো হাম রোগের প্রাদুর্ভাব বেড়েছে। গত কয়েকদিনে মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়া এই রোগে রাঙ্গামাটির দুর্গম এলাকায় ৮ জন শিশু প্রাণ হারিয়েছে।

বিষয়টি নিশ্চিত করে সোমবার আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর) জানিয়েছে, দুর্গম ও যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন এসব এলাকায় চিকিৎসা সহায়তা দিচ্ছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী।

তবে রাঙ্গামাটি সিভিল সার্জন ডাঃ বিপাশ খীসা বেনারকে বলেন, “গত একমাসে হামে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যের সংখ্যা আসলে সাত। এর মধ্যে দুই মাসের একটি শিশু মারা গেছে, কিন্তু তার মৃত্যুর কারণ আলাদা। তাছাড়া দুই মাসের শিশুর হাম হয় না।”

হামে আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়া শিশুদের বয়স দেড় থেকে ১২ বছরের মধ্যে জানিয়ে তিনি বলেন, “মুলতঃ রাঙ্গামাটির সাজেক ইউনিয়নের অরুণ পাড়া, লুইংখিয়ান পাড়া ও হাইচ্যাপাড়া এলাকায় হামের প্রকোপ বেড়েছে। সর্বশেষ ২৩ ও ২৪ মার্চ দুই শিশুর মৃত্যু হয়।”

“গত দুই সপ্তাহে এসব এলাকায় ১৫৫ জন শিশু হামে আক্রান্ত হয়েছে। এদের অনেকেই এখন সুস্থ, বাকিদের চিকিৎসা চলছে,” বলেন সিভিল সার্জন।

খাগড়াছড়িতেও হামে আক্রান্ত হয়ে শনিবার এক শিশুর মৃত্যু হয়েছে, আরও ৩২ জনের হামে আক্রান্ত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। জেলার সিভিল সার্জন ডা. নুপুর কান্তি দাশ বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেন, জেলা স্বাস্থ্য বিভাগ ও স্থানীয় প্রশাসন তাৎক্ষণিকভাবে মেডিক্যাল টিম গঠন করে এসব এলাকায় চিকিৎসা দিচ্ছে।

এদিকে করোনাভাইরাসের আতঙ্কের মধ্যে হামের প্রাদুর্ভাব বাড়ায় এসব পার্বত্য এলাকার পরিবেশ থমথমে হয়ে উঠেছে।

সাজেক ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নেলশন চাকমা বেনারকে বলেন, “এই ইউনিয়নের ৭নং ওয়ার্ডের সীমান্তবর্তী তিনটি গ্রামে গত কয়েক দিনে হাম রোগের প্রাদুর্ভাব বেড়েছে। কয়েকজন শিশু মারা যাওয়ায় আতঙ্কের মধ্যে রয়েছে এলাকাবাসী। তারপর রয়েছে করোনাভাইরাসের আতঙ্ক।”

“এসব এলাকা দুর্গম হওয়ায় নিয়মিত চিকিৎসা সেবাও পোঁছায় না। এ কারণে এসব এলাকার শিশুরা সরকারি টিকাও পায় না। আর এই কারণেই প্রায় প্রতি বছর এসব এলাকার শিশুরা হামে আক্রান্ত হয়,” বলেন তিনি।

টিকা দেয়ার পরেও আক্রান্ত

রাঙ্গামাটি সিভিল সার্জন ডাঃ বিপাশ খীসা জানান, প্রত্যন্ত এলাকাতেও সাস্থ্যকর্মীরা কাজ করেন।

বর্তমানে সাজেকের তিনটি গ্রামে ৬ টি মেডিকেল টিম কাজ করছে জানিয়ে বিপাশ খীসা বলেন, “সাজেকের এসব এলাকায় গত ফেব্রুয়ারিতে এই বছর প্রথম হাম দেখা দেয়। আক্রান্তদের সুস্থ করার পরে গত ৬ এবং ৭ মার্চ ওই এলাকায় ৩১৫ জন শিশুকে হামের টিকা দিয়েছি।”

“কিন্তু হামের টিকা দেয়ার ২৮ দিনের মধ্যে ইমিউনিটি তৈরি হয় না। দুর্ভাগ্যবশতঃ এসব বাচ্চারা ২৮ দিন পার না হতেই টিকা দেয়া সত্ত্বেও হামে আক্রান্ত হয়েছে। এখন আমাদের পরবর্তী পরিকল্পনা হলো বর্তমান আক্রান্তরা সুস্থ হয়ে উঠলে পুরো সাজেকে ১-১৫ বছর বয়সী শিশুদের সবাইকে আবার হামের টিকা দেবো,” বলেন সিভিল সার্জন।

তিনি আরো জানান, “আক্রান্ত শিশুদের বেশিরভাগের বয়স ৯-১৩ বছর। তাদের আরো ৭-১০ বছর আগে টিকা পাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু যেকোনো কারণে হোক তারা সেটা পায়নি।”

কুসংস্কার দায়ী

সিভিল সার্জন বলছিলেন, “কুসংস্কারের কারণেও ত্রিপুরা জনগোষ্ঠী বাচ্চাদের টিকা দিতে অনাগ্রহী থাকে। এই কারণে তারা বেশি অসুস্থ হচ্ছে।”

তাদের মাঝে জনসচেতনতা বাড়াতে ত্রিপুরা কমিউনিটির লোকজনকেই উদ্যোগ নিতে হবে বলে মনে করেন বিপাশ খীসা।

এ বিষয়ে বাংলাদেশের সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচি (ইপিআই) প্রোগ্রাম ম্যানেজার ডা. মাওলা বক্স বেনারকে বলেন, কিছু পার্বত্য এলাকা ছাড়া সারা দেশে আর কোথাও হামে শিশু মৃত্যুর ঘটনা ঘটে না। যেসব এলাকায় হামের সংক্রমণ হয়েছে ওই জায়গাগুলো অনেক অনগ্রসর।”

“ভাবনার চেয়ে বেশি অনগ্রসর হওয়া সত্ত্বেও আমাদের কর্মীরা সেখানে কাজ করেন। যদিও সেখানে তাঁদের নিরাপত্তা এমনকি অবকাঠামো সংকটও আছে,” বলেন তিনি।

ডাঃ মাওলা বলেন, “সেখানকার মানুষরা নানা ধরনের কুসংস্কারে আচ্ছন্ন। অন্ধবিশ্বাসের কারণে আধুনিক চিকিৎসা নিতে তাঁরা আগ্রহী নন। তাঁদের পুষ্টিকর খাবার এবং বিশুদ্ধ পানির অভাব আছে।”

“শিক্ষা থেকেও তাঁরা বঞ্চিত। আধুনিক শিক্ষা থেকে তাঁরা নিজেদের দূরে রাখতে চান। এজন্য তাঁদের বিষয়ে সমন্বিত উদ্যোগ দরকার,” মনে করেন তিনি।

ইপিআই প্রোগ্রাম ম্যানেজার বলেন, “আমরা চেষ্টা করছি এই সমস্যা কীভাবে ওভারকাম করা যায়। এ বিষয়ে একটা পরিকল্পনা ইতিমধ্যে নিয়েছি আমরা। এভাবে যেন আর কোনো শিশুকে হামে আক্রান্ত হয়ে প্রাণ দিতে না হয়।”

আগে ২০২০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে হামমুক্ত করার লক্ষ্য থাকলেও নতুন করে ২০২৩ সালকে লক্ষ্য ধরা হয়েছে বলে জানান ডা. মাওলা বক্স।

এ লক্ষ্যে গত ১৮ মার্চ থেকে সারাদেশে ৩ সপ্তাহব্যাপী টিকাদান কর্মসূচি শুরুর কথা ছিল। কিন্তু করোনাভাইরাস সংক্রমণের ঝুঁকির কারণে ১৬ মার্চ এ ক্যাম্পেইন স্থগিত করার কথা জানায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। এ ক্যাম্পেইনে ৯ মাস থেকে ১০ বছরের নিচে প্রায় ৩ কো‌টি ৪০ লাখ শিশু‌কে এক ডোজ এমআর টিকা দেয়ার কথা রয়েছে।

ডা. মাওলা বক্স জানান, করোনাভাইরাস পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে নতুন তারিখ নির্ধারণ হবে।

পাশে সেনাবাহিনী

সোমবার আইএসপিআরের দেয়া বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, সাজেকের দুর্গম ও যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন এলাকায় চিকিৎসা সহায়তা দেয়ার জন্য বেসামরিক কর্তৃপক্ষের অনুরোধের প্রেক্ষিতে গত ২৪-২৮ মার্চ পর্যন্ত বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর চিকিৎসক দল নিরলসভাবে চিকিৎসা সেবা দিয়ে ১৭১ জন শিশুসহ সর্বমোট ২০২ জন রোগীকে চিকিৎসার পাশাপাশি মানবিক সহায়তা প্রদান করে।

এছাড়াও ওই এলাকায় একই পরিবারের অপুষ্টিজনিত রোগসহ নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত ৫ জন শিশুর জীবন বাঁচাতে গত ২৫ মার্চ সেনাবাহিনীর বিশেষ ব্যবস্থাপনায় বিমানবাহিনীর হেলিকপ্টারযোগে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়। বর্তমানে আক্রান্ত শিশুরা সম্পূর্ণ আশঙ্কামুক্ত রয়েছে।

ডা. মাওলা বক্স জানান, সেখানে সেনাবাহিনীর পাশাপাশি বিজিবি এবিং স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মীরাও কাজ করছেন।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।