পাহাড়ে হামের প্রকোপ, প্রশ্নবিদ্ধ বাংলাদেশের টিকাদান কর্মসূচি
2017.07.18
ঢাকা

সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচি (ইপিআই) সফল বলে দাবি করা হলেও বাংলাদেশের পাহাড়ি অঞ্চলে নতুন করে হামের প্রকোপ দেখা দিয়েছে। হামে আক্রান্ত হয়ে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের আদিবাসী অধ্যুষিত ত্রিপুরা পাড়ার ৯ শিশুর মৃত্যু হয়েছে। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছে আরও ৮০টির বেশি শিশু।
সরকারের তদন্তে দেখা গেছে, পাহাড়ি এসব পরিবারগুলো কখনোই টিকার আওতায় আসেনি, যা দেশের সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচিকে প্রশ্নের সম্মুখীন করেছে।
পাহাড়িদের গ্রামে শিশুদের টিকাদানে গাফিলতির অভিযোগে মঙ্গলবার মাঠ পর্যায়ের ছয় স্বাস্থ্যকর্মীকে ‘শাস্তিমূলক’ বদলি করা হয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের নির্দেশে চট্টগ্রামের সিভিল সার্জন ডা. আজিজুর রহমান সিদ্দিকী মঙ্গলবার বদলির এই আদেশ দেন। তাঁদের সন্দ্বীপের বিভিন্ন এলাকায় পাঠানো হয়েছে।
এদিকে হামের কারণে শিশু মৃত্যুর ঘটনাকে সরকারের ব্যর্থতা হিসেবেই দেখছেন বিশেষজ্ঞরা। দেশের প্রান্তিক জনগণকে চিকিৎসা সেবা দিতে আরও সচেষ্ট হওয়ার প্রতি গুরুত্ব দিয়েছেন তাঁরা।
স্বাস্থ্য অধিকার আন্দোলনের আহ্বায়ক ও বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি অধ্যাপক ডা. রশীদ-ই মাহবুব বেনারকে বলেন, “যখন আমরা সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচির (ইপিআই) সফলতার দাবি করি, তখন হামে এই শিশুদের মৃত্যু নিশ্চয়ই সরকারের ব্যর্থতা।”
তবে ইপিআই সফলতা মানেই বাংলাদেশ হামমুক্ত নয় বলে বেনারকে জানান স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নিয়ন্ত্রণ শাখার পরিচালক সানিয়া তহমিনা। তিনি বলেন, “ইপিআই’র মাধ্যমে দেশে হাম নিয়ন্ত্রণে আসলেও প্রতিবছরই কিছু হামের রোগী পাওয়া যায়। তবে এই রোগে একসঙ্গে এত শিশুর মৃত্যু অনেক দিন ঘটেনি।”
শুরুতে কারণ ‘অজ্ঞাত’ বলা হলেও সোমবার সংবাদ সম্মেলন করে পাহাড়ি অঞ্চলের ওই শিশুদের মৃত্যুর কারণ হিসেবে ‘হাম’কে চিহ্নিত করে সরকার। দুর্গম ওই এলাকার শিশুরা কখনোই টিকার আওতায় আসেনি জানিয়ে এ ঘটনায় দুঃখপ্রকাশও করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।
প্রসঙ্গত, গত ১২ জুলাই সীতাকুণ্ডের ত্রিপুরা পাড়ায় ‘অজ্ঞাত’ রোগে চার শিশুর মৃত্যু হয়। এর আগের সপ্তাহেও মারা যায় আরো পাঁচ শিশু। জ্বরের পাশাপাশি এসব শিশুদের শরীরে লালচে গোটা উঠেছিল। তাদের শ্বাসকষ্ট এবং বমিও হচ্ছিল।
নয় শিশুর মৃত্যুর পরে জ্বরে আক্রান্ত অন্য শিশুদের স্থানীয় দুটি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। একই ধরনের উপসর্গ নিয়ে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ৪৯জন ও ফৌজদারহাট বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ট্রপিক্যাল অ্যান্ড ইনফেকসাস ডিজিজেসে (বিআইটিআইডি) এখনো ৩৪ জন শিশু ভর্তি আছে।
জনমিতিক, রোগতাত্ত্বিক, নৃতাত্ত্বিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও স্থানীয় মানুষের সাক্ষাৎকার শেষে সোমবার এক সংবাদ সম্মেলনে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা জানান, হামে আক্রান্ত হয়েই ত্রিপুরা পাড়ায় ৯ শিশুর মৃত্যু হয়েছে। হাসপাতালে ভর্তি হওয়া শিশুরাও একই রোগে আক্রান্ত।
সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, গত ৮ থেকে ১২ জুলাইয়ের মধ্যে ৯টি শিশুর মৃত্যু হয়। তাদের বয়স ছিল ৩ থেকে ১২ বছরের মধ্যে। আক্রান্ত ও মৃত শিশুরা হাম রোগের জীবাণু দ্বারা সংক্রমিত হয়েছিল বলে ল্যাবরেটরি পরীক্ষায় নিশ্চিত হওয়া গেছে। এসব শিশুরা অপুষ্টিতেও ভুগছিল। যার ফলে সংক্রমণ একজনের শরীর থেকে অন্যজনের শরীরে ছড়িয়ে পড়েছিল।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা জানান, ত্রিপুরা পাড়ার ৮৫ পরিবারের ৩৮৮ জন বাসিন্দা রয়েছেন। এদের কেউই কোনো দিন হামের টিকা পাননি।
সংবাদ সম্মেলনে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বলেন, “ওয়ার্ডভিত্তিক ‘মাইক্রোপ্লান’ অনুযায়ী টিকাদান কর্মসূচি পরিচালিত হয়। তবে সীতাকুণ্ড উপজেলার সোনাইছড়ি ইউনিয়নের ‘মাইক্রোপ্লানে’ ত্রিপুরা পাড়ার উল্লেখ নেই। এ কারণেই এই পাড়ায় টিকাদান কার্যক্রম ছিল না।”
গত কয়েক দশকেও ত্রিপুরা পাড়ার পরিবারগুলোর কাছে টিকা পৌঁছে দিতে না পারায় দুঃখ প্রকাশ করে মহাপরিচালক বলেন, “সারা দেশে হামের পরিস্থিতি স্বাভাবিক রয়েছে। ত্রিপুরা একটি ছোট বিচ্ছিন্ন এলাকা এবং এখানকার বাসিন্দারা কখনোই আধুনিক চিকিৎসা নেয়নি।”
হাম সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা নেই বলেও জানান তিনি।
এদিকে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন শিশুরা সবাই এখন আশঙ্কামুক্ত বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকেরা। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সহকারী অধ্যাপক ডা. নাসির উদ্দিন মাহমুদ বেনারকে বলেন, সীতাকুণ্ড থেকে আসা ৫৪ জন শিশু এখন আশঙ্কামুক্ত এবং সুস্থ্ রয়েছে।”
“তাদের যতটুকু সম্ভব আলাদা করে চিকিৎসা সেবা দেওয়া হচ্ছে। তবে ওয়ার্ডের অন্যান্য শিশুদের হামের টিকা দেওয়া থাকায় তাদের সংক্রমণের ঝুঁকি নেই,” জানান তিনি।