হেফাজতের সঙ্গে সরকারের সখ্য নিয়ে রাজনৈতিক শঙ্কা

পুলক ঘটক
2017.04.20
ঢাকা
গণভবনে কওমি মাদ্রাসার আলেমদের সঙ্গে এক বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গণভবনে কওমি মাদ্রাসার আলেমদের সঙ্গে এক বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এপ্রিল ১১, ২০১৭।
স্টার মেইল

কট্টর ইসলামি গ্রুপ হেফাজতে ইসলামের সঙ্গে সরকারের সাম্প্রতিক ঘনিষ্ঠতা রাষ্ট্রের অসাম্প্রদায়িক পরিবেশের জন্য আশঙ্কাজনক বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা। তাঁরা বলছেন, ভোটের রাজনীতিতে লাভবান হতেই এই সমঝোতা করছে আওয়ামী লীগ।

তবে আওয়ামী লীগ ও হেফাজত উভয়ই রাজনৈতিক ঐক্য বা সমঝোতার বিষয়টি পুরোপুরি অস্বীকার করছে।

সম্প্রতি হেফাজতের দাবি মেনে পাঠ্যপুস্তক পরিবর্তন, হেফাজতের প্রধান নেতা আল্লামা আহমেদ শফির নেতৃত্বাধীন আলেম-ওলামাদের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর বৈঠক, কওমি মাদ্রাসার সনদকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রির সমমর্যাদায় স্বীকৃতিদান ও সুপ্রিম কোর্টের সামনে স্থাপিত ভাস্কর্য সরানোয় প্রধানমন্ত্রীর সম্মতির বিষয়গুলো রাজনীতিতে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনার জন্ম দিয়েছে।

এ প্রসঙ্গে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ও মানবাধিকারকর্মী সুলতানা কামাল বেনারকে বলেন, “ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য বা থাকার জন্য মৌলবাদী, রক্ষণশীল, নারী বিদ্বেষী এবং মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী গ্রুপ কিংবা তাদের চেতনার সঙ্গে যারা যুক্ত; তাদের সঙ্গে এ ধরনের আপোষকামীতা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক।”

এসব কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার দাবিদার দলটি এখন মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিরুদ্ধে এবং অসাম্প্রদায়িক গণমানুষের আকাঙ্ক্ষার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে- দাবি সুলতানা কামালের।

“এর ফলে আওয়ামী লীগ গোটা দেশকে বিপদে ফেলবে,” বলেন সুলতানা কামাল।

অভিযোগ বিএনপিরও

ধর্মীয় মৌলবাদীদের প্রতি সহানুভূতিশীল দল হিসাবে পরিচিত বিএনপিও এবার আওয়ামী লীগকে ধর্ম নিয়ে রাজনীতি করার অভিযোগে অভিযুক্ত করেছে।

এ প্রসঙ্গে গত ১৪ এপ্রিল বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া এক সংবাদ সম্মেলনে “হাসিনা ধর্ম নিয়ে রাজনীতি করছেন” বলে মন্তব্য করেন।

তবে ওই দিন রাতেই গণভবনে আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী সংসদের বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এর জবাবে বলেন, “আমি ধর্ম পালন করি, ধর্ম মেনে চলি। কিন্তু ধর্ম নিয়ে রাজনীতি করি না।”

“কওমি মাদ্রাসার স্বীকৃতি দেওয়ায় লাখ লাখ শিক্ষার্থীর চাকরি পাবে। এর মধ্যে কোনো রাজনীতি নেই,” জানান প্রধানমন্ত্রী।

উল্লেখ্য, দেশে প্রায় ৭০ হাজার কওমি মাদ্রাসা আছে যার অধিকাংশই হেফাজতের নিয়ন্ত্রণে। এসব প্রতিষ্ঠানে প্রায় ১৪ লাখ ছাত্রছাত্রী আরবি ভাষায় ইসলাম বিষয়ে লেখা পড়া করে। এসব ছাত্রছাত্রীর অধিকাংশই গরিব পরিবারের। আধুনিক ও কর্মমুখী শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হওয়ায় এরা চাকরি ক্ষেত্রে সুবিধা পায় না।

গত ১১ এপ্রিল হঠাৎ করেই গণভবনে হেফাজতের আমির আল্লামা শাহ আহমদ শফীর নেতৃত্বে কয়েকশ আলেম প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে বৈঠক করেন। এ সময় প্রধানমন্ত্রী কওমি মাদ্রাসার সনদের স্বীকৃতির সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন।

হেফাজতের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে সুপ্রিম কোর্টের সামনে স্থাপিত ভাস্কর্য অপসারণের বিষয়েও ওইদিন একমত পোষণ করেন প্রধানমন্ত্রী।

সখ্যের অভিযোগ নাকচ

ভোটের কারণে হেফাজতের সঙ্গে আওয়ামী লীগ আপস করেছে এ রকম অভিযোগ দলটির নেতারা মানতে নারাজ হলেও এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪-দলীয় জোটের শরিক দলগুলো প্রকাশ্যেই ক্ষোভ প্রকাশ করেছে।

এ প্রসঙ্গে ১৪ দলের অন্যতম শরিক সংগঠন ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন বেনারকে বলেন, “এতে প্রগতিশীল শক্তির হাত সংকুচিত হবে। মানুষের অসাম্প্রদায়িক ও গণতান্ত্রিক চেতনাবোধ ক্ষতিগ্রস্ত হবে।”

অন্যদিকে হেফাজতে ইসলামির দর্শনকে জঙ্গিবাদী রাজনৈতিক দর্শন হিসেবে উল্লেখ করে সাবেক শিল্পমন্ত্রী ও সাম্যবাদী দলের সাধারণ সম্পাদক দিলীপ বড়ুয়া বেনারকে বলেন, “হেফাজতের সঙ্গে আপস করে জঙ্গিবাদের মূলোৎপাটন করা সম্ভব হবে না।”

তবে হেফাজতের সঙ্গে সখ্যের অভিযোগ নাকচ করে দিয়েছেন ১৪ দলের মুখপাত্র ও আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য মোহাম্মদ নাসিম।

বেনারকে তিনি বলেন, “হেফাজতের কিছু রাজনৈতিক দর্শন আছে, যা আমরা গ্রহণ করতে পারি না। আঁতাত বা সখ্যর প্রশ্নই আসে না।”

এদিকে হেফাজতে ইসলামও আওয়ামী লীগের সাথে কোনো ধরনের রাজনৈতিক ঐক্যের বিষয়টি সম্পূর্ণ অস্বীকার করেছে।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাওয়া হলে সংগঠনটির আমির এর প্রেস সচিব মাওলানা মুনির আহমদ বেনারকে বলেন, “আমাদের সাথে কোনো রাজনৈতিক ঐক্য বা সমঝোতা হয়নি। আমরা রাজনৈতিক দল নই, রাজনৈতিক অভিলাষও নেই। আমরা ঈমান আকিদা এবং জাতীয় স্বার্থ নিয়ে কথা বলি। এনিয়ে আমরা যে কারও সাথে কথা বলতে পারি।”

এর আগে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের সাংবাদিকদের বলেছিলেন, “হেফাজতের সঙ্গে আওয়ামী লীগের জোট হয়ে যায়নি। বাস্তবতা বিবেচনা করে রাজনীতি করা হচ্ছে।”

“কওমি মাদ্রাসার সনদের স্বীকৃতি একটি ভালো কাজ। এর ফলে যদি আওয়ামী লীগের ভোট বাড়ে সেটা তো দোষের কিছু নয়।”

বেনারের কাছে বিষয়টিকে এভাবেই ব্যাখ্যা করেন আওয়ামী লীগের সভাপতি মণ্ডলীর সদস্য কর্নেল (অব:) ফারুক খান।

তবে আগামী নির্বাচনে হেফাজত আওয়ামী লীগকে সহায়তা করবে কিনা এ প্রশ্নের সরাসরি জবাব এড়িয়ে মাওলানা মুনির বলেন, “যে সমস্ত দল বা সরকার ইমান আকিদার স্বার্থে কাজ করবে তারাই লাভবান হবে।”

সব ‘মূর্তি’ অপসারণ চায় হেফাজত

এদিকে কয়েকটি দাবি মানার পরে এবার ‘সকল প্রকার অনৈসলামিক কর্মকাণ্ড বন্ধ’ এবং ‘ভাস্কর্যের নামে স্থাপিত দেশের সকল মূর্তি’ অপসারণ করার দাবি জানিয়েছে হেফাজতে ইসলাম।

মসজিদের নগর ঢাকাকে মূর্তির নগরে রূপান্তর এবং দেশব্যাপী রাস্তার মোড়ে ও কলেজ-ভার্সিটিতে ভাস্কর্যের নামে মূর্তি স্থাপন বন্ধ করার দাবি ২০১৩ সালে পেশ করা হেফাজতের ১৩ দফা দাবিতেও ছিল।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।