হেফাজতে ইসলামের তাণ্ডব: চার বছরে ৮৩ মামলার ১৫টিতে অভিযোগপত্র দায়ের
2017.05.04
ঢাকা

ব্লাসফেমি আইন প্রবর্তনসহ ১৩ দফা দাবি আদায়ে ২০১৩ সালের ৫ মে মতিঝিলের শাপলা চত্বরে সহিংস ঘটনায় দায়ের হওয়া ৮৩টি মামলার মধ্যে মাত্র ১৫টিতে অভিযোগপত্র দিয়েছে পুলিশ। খুব দ্রুত এসব মামলার অভিযোগপত্র দেওয়া হবে এমন কোনো ইঙ্গিতও পাওয়া যায়নি পুলিশের তরফ থেকে।
বিশ্লেষকেরা মামলাগুলোর গতি স্তিমিত হয়ে যাবার পেছনে হেফাজতের সাথে সরকারের আপসকামিতাকে দায়ী করলেও পুলিশের মতে, সাক্ষী পাওয়া যাচ্ছে না বলেই অভিযোগপত্র দিতে দেরি হচ্ছে।
পুলিশের মহাপরিদর্শক একেএম শহিদুল হক পুলিশ সদর দপ্তরে সাংবাদিকদের বলেন, সাক্ষী পাওয়া যাচ্ছে না বলে অভিযোগপত্র দিতে দেরি হচ্ছে। ৫ মের পরপর হেফাজতে ইসলামের মহাসচিব জুনায়েদ বাবুনগরীসহ বেশ কয়েকজন শীর্ষ নেতাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। পরে তাঁরা জামিনে মুক্তি পান।
তবে পুলিশ সদর দপ্তরের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক শীর্ষস্থানীয় একজন কর্মকর্তা বলেন, এ মুহূর্তে সরকার কোনো ইস্যুতে হেফাজতে ইসলামকে মাঠে নামাতে চাইছে না। তা ছাড়া শীর্ষস্থানীয় নেতাদের বিরুদ্ধে মামলা থাকায়, তাঁরাও আন্দোলনে নামার আগে দশবার ভাববেন।
ভোটের রাজনীতিতে হেফাজতে ইসলাম গুরুত্বপূর্ণ বলেই সরকারের এমন আপসকামিতা বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগের অধ্যাপক নাজমুল আহসান কলিমুল্লাহ।
“মূলধারার সব কটি রাজনৈতিক দলের কাছেই হেফাজতে ইসলাম আদরণীয়। সরকার মনে করছে হেফাজতে ইসলামকে কাছে রেখে নিয়ন্ত্রণ করা সহজ। তারা দূরে বা আত্মগোপনে গেলে নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হবে,” বেনারকে বলেন নাজমুল আহসান কলিমুল্লাহ।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মামলার এজাহারে হেফাজতে ইসলামের শীর্ষ নেতাদের নাম উল্লেখ ছিল। কিন্তু যে ১৫টি অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছে তার কোনোটিতেই শীর্ষস্থানীয় কোনো নেতার নাম নেই। বাকি মামলার অভিযোগপত্র জমা দিতে দেরি হওয়ার কারণ কী সে সম্পর্কে আনুষ্ঠানিক কোনো বক্তব্য পুলিশের পক্ষ থেকে পাওয়া যায়নি।
“আমরা তো বারবারই বলছি, মামলাগুলো তুলে নিতে। আমরা আশাবাদী মামলাগুলো প্রত্যাহার হবে,” লতিফ নেজামী বলেন।
২০১৩ সালের ৫ মে শাপলা চত্বর ও সংলগ্ন এলাকায় ভাঙচুরের দায় নিতে রাজি নন এই নেতা। তিনি বলেন, এসবের জন্য কারা দায়ী তা হেফাজতে ইসলাম জানে না।
উল্লেখ্য, ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে এই সংগঠনের কর্মীদের ব্যাপক সংঘর্ষে ৫ ও ৬ মে হেফাজতে ইসলামের কর্মী, পুলিশ, বিজিবি সদস্যসহ মোট ২৭ জন নিহত হন। সাংবাদিকসহ আহত হন শতাধিক।
মামলার শ্লথগতি আপসকামিতার আরেকটি উদাহরণ
সম্প্রতি হেফাজতের দাবি মেনে পাঠ্যপুস্তকে পরিবর্তন আনা, হেফাজতের প্রধান নেতা আহমেদ শফির নেতৃত্বাধীন আলেম-ওলামাদের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বৈঠক, কওমি মাদ্রাসার সনদকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রির সমমর্যাদায় স্বীকৃতিদান ও সুপ্রিম কোর্টের সামনে স্থাপিত লেডি জাস্টিসের ভাস্কর্য সরানোর দাবির প্রতি সমর্থন দেওয়ার বিষয়গুলো রাজনীতিতে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনার জন্ম দিয়েছে।
রাজনীতিক ও সংস্কৃতি কর্মীদের অনেকেই মনে করছেন, হেফাজতে ইসলামের বিরুদ্ধে হওয়া মামলাগুলোর শ্লথগতির পেছনে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের সঙ্গে একধরনের আপসকামিতা তাঁরা দেখতে পাচ্ছেন।
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেন, ক্ষমতাসীন সরকার হেফাজতে ইসলামের সঙ্গে সমঝোতা করছে।
“৫ মের সহিংসতার পরও আমরা দেখতে পাচ্ছি সরকার জামায়াতে ইসলামীকে প্রতিহত করতে হেফাজতকে মাঠে নামিয়েছে। এটা আগুন দিয়ে আগুন নেভানোর খেলা। তাদের কথা মতো পাঠ্যপুস্তকে পরিবর্তন আনা হয়েছে। ভাস্কর্য অপসারণের দাবির সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী একমত হয়েছেন। কওমি সনদের স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। এসবের ফল শুভ হবে না,” বেনারকে জানান মুজাহিদুল ইসলাম।
একই মন্তব্য করেন নাট্যজন নাসিরুদ্দীন ইউসুফ। তিনি বলছিলেন, হেফাজত রাজনৈতিক শক্তির সমর্থন পাচ্ছে।
‘আমরা যা দেখতে পাচ্ছি তা আধুনিক ও নিরপেক্ষ রাষ্ট্র গঠনের পরিপন্থী। সাম্প্রদায়িক শক্তি মাথা চাড়া দিয়েছে। এতে সমর্থন দিচ্ছে রাজনৈতিক শক্তি,” নাসিরুদ্দীন ইউসুফ বাচ্চু বেনারকে বলেন।
ক্ষয়ক্ষতি ও মামলা
৫ মে মহাসমাবেশের নামে সারা দেশ থেকে কওমি মাদ্রাসার শিক্ষক, এতিম শিশুসহ বিভিন্ন বয়সী শিক্ষার্থীদের ঢাকায় জড়ো করা হয়। সমাবেশ থেকে একপর্যায়ে ১৩ দফা দাবি মানা না হলে সরকার উৎখাতের ডাক দেওয়া হয়। রাজধানীর পল্টন এলাকায় ব্যাপক ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে।
ব্যবসায়ীরা অভিযোগ করেন হামলায় জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররম মার্কেট ও তার আশপাশে প্রায় ৩০০টি দোকান ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়। এতে ১৮ কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়। এ ছাড়া বিভিন্ন ব্যাংক ও স্থাপনা ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
সংবাদ সম্মেলনে তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু সে সময় জানান, ওই দিন শিল্প ব্যাংকের পাশে সরকারের পরিবহন পুলে রাখা ৪০টি বাসসহ বিভিন্ন স্থানে দুই শতাধিক যানবাহনে অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে।
হত্যা, পুলিশের ওপর হামলা, সড়ক অবরোধ, হামলা- ভাঙচুরের ঘটনায় ঢাকায় ৫৩টি মামলা দায়ের করা হয়। একই কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে সারা দেশে আরও ৩০টি মামলা দায়ের করা হয়। এ পর্যন্ত ঢাকায় তিনটি মামলা ও চট্টগ্রামে একটিসহ মোট ১৫টি মামলার অভিযোগপত্র দিয়েছে পুলিশ।
শাপলা চত্বর থেকে হেফাজতে ইসলামকে সরাতে ৫ মে রাতে ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার বেনজির আহমেদের নেতৃত্বে ‘অপারেশন শাপলা’ পরিচালনা করা হয়। হেফাজতে ইসলামের ১০জন শীর্ষস্থানীয় নেতা ও ৭৭ কর্মীকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে। মামলায় দুইশ নেতার নাম উল্লেখ করে ও অজ্ঞাতনামা আরও ৪০ হাজার কর্মীকে আসামি করা হয়।
গ্রেপ্তারকৃতদের কেউ কেউ ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। সমাবেশে অংশ নেওয়া কমপক্ষে সাতটি ধর্মভিত্তিক দলের নাম বেরিয়ে আসে তদন্তে। তদন্তকারী সংস্থা অর্থের জোগানদাতাদের কয়েকজনকে চিহ্নিত করে। এর পরপরই মামলাগুলোর গতি স্তিমিত হয়ে যায়।
বিচার চান ব্যবসায়ীরা
৫ মের প্রাক্কালে গতকাল বৃহস্পতিবার কথা হচ্ছিল বায়তুল মোকাররমের সামনের ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের সঙ্গে। মো. আবদুল কালাম ১৯৯৬ সাল থেকে ইমিটেশনের অলংকার বিক্রি করেন। বেনারকে বলছিলেন, ৫ মের সহিংসতায় পথে বসেছিলেন। এখনো দায় দেনা সব শোধ হয়নি। শুধু ওই দিনেই তাঁর দুই লাখ টাকার সম্পদ নষ্ট হয় বলে জানান কালাম।
একই হাল হাজী মো. আবুল কাশেমের। তিনি ষাটের দশক থেকে ব্যবসা করছেন।
“সব পুইড়া গেছিল। পরিবার আছে, সন্তান আছে। পরে প্রধানমন্ত্রী ৫০ হাজার টাকা দিল। তাই দিয়া কোনো রকম শুরু করছিলাম,” বেনারকে বলেন আবুল কাশেম।
ওই দুই ব্যবসায়ীই বলেন, আপস হোক বা না-ই হোক, তাঁরা চান যাঁরা তাঁদের ক্ষতি করেছেন তাঁদের বিচার হোক।