নির্বাচন সামনে রেখে বড় দলগুলো জোট গড়ছে ইসলামপন্থীদের সাথে

পুলক ঘটক
2017.05.11
ঢাকা
ঢাকায় বাংলাদেশ ইসলামি ঐক্যজোটের বিক্ষোভ। ঢাকায় বাংলাদেশ ইসলামি ঐক্যজোটের বিক্ষোভ। ডিসেম্বর ২৩, ২০১৭।
স্টার মেইল

জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় এগিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো ইসলামি গো​ষ্ঠীগুলোর সঙ্গে সুসম্পর্ক স্থাপনে বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছে। ইতিমধ্যেই ইসলামপন্থী দলগুলোর বেশ কিছু দাবি মেনে নিয়েছে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ।

অন্যদিকে প্রধান বিরোধী দল বিএনপির নেতৃত্বাধীন রাজনৈতিক জোট মূলতঃ ইসলামপন্থী রাজনৈতিক মোর্চা হিসেবেই পরিচিত। ২০–দলীয় ওই জোটে জামায়াতে ইসলামীসহ প্রায় সবগুলো রাজনৈতিক দলই ইসলামপন্থী।

সর্বশেষ গত রোববার দেশের তৃতীয় বৃহত্তম রাজনৈতিক দল জাতীয় পার্টি নতুন একটি মোর্চা গঠন করেছে। ছোট ছোট ৫৮টি দল নিয়ে গঠিত ওই মোর্চায় যুক্ত প্রায় সবগুলো দলই ইসলামপন্থী বা ইসলামি ভাবাপন্ন।

নীতির টানাপোড়েন

ইসলামি দলগুলোর সঙ্গে সখ্য প্রতিষ্ঠার এই প্রবণতাকে বাস্তবধর্মী হিসেবে ব্যাখ্যা করেছেন জাতীয় পার্টির কো-চেয়ারম্যান জি এম কাদের। তবে এর ফলে বাংলাদেশের রাজনীতি ও সমাজ নতুন করে ইসলামিকরণের দিকে যাবে না বলে মনে করেন তিনি।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশারফ হোসেন বেনারকে বলেন, “বিএনপি নতুন করে ইসলামের দিকে ঝোঁকেনি। আমরা শুরু থেকেই ইসলাম পছন্দ দল। বরং ধর্ম নিরপেক্ষতার দাবিদার আওয়ামী লীগ তাদের নীতি পরিবর্তন করছে। কেন ইসলামি দলগুলোকে কাছে টানার চেষ্টা করছে, এটা তাদের জিজ্ঞাসা করেন।”

তবে ইসলামপন্থীদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বৃদ্ধির অভিযোগ নাকচ করে দিয়েছেন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ড. দীপু মনি এবং ক্ষমাতাসীন জোটের শরিক জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল— জাসদের সভাপতি ও তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু।

এ বিষয়ে বেনারের কাছে তাঁদের প্রতিক্রিয়ায় উভয়ে বলেছেন যে, সরকার মুক্তিযুদ্ধের চেতনা থেকে বিচ্যুত হবে না। সাম্প্রদায়িক শক্তির সঙ্গে আপস করার প্রশ্নই ওঠে না।

ইসলামপন্থায় সরকার

অভিযোগ উঠেছে যে, সরকার হেফাজতে ইসলামের দাবি মেনে স্কুলের পাঠ্যবইয়ে পরিবর্তন এনেছে। ধর্মনিরপেক্ষ লেখকদের লেখা বাদ দিয়ে ইসলামপন্থী লেখকদের লেখা বইয়ে যুক্ত করা হয়েছে।

সাম্প্রতিক সময়ে হেফাজতের নেতা আহমেদ শফির নেতৃত্বাধীন আলেম-ওলামাদের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বৈঠক, কওমি মাদ্রাসার সনদকে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকোত্তর ডিগ্রির সমমর্যাদায় স্বীকৃতি দেওয়া ও সুপ্রিম কোর্ট থেকে ভাস্কর্য সরানোর দাবির প্রতি সরকারের সমর্থন দেওয়ার বিষয়গুলো রাজনীতিতে নতুন মাত্রা যোগ করেছে।

“হেফাজতের কথামতো এগুলো করা হচ্ছে। এসবের ফল শুভ হবে না,” বেনারকে জানান বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম।

২০১৩ সালের ৫ মে মতিঝিলের শাপলা চত্বরে হেফাজতের সমাবেশ এবং সহিংস ঘটনায় দায়ের হওয়া মামলাগুলো তদন্তে আগ্রহ দেখাচ্ছে না সরকার। হত্যা ও নাশকতার ৮৩টি মামলার ১৫টি থেকে শীর্ষ নেতাদের নাম বাদ দিয়ে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছে।

এদিকে সৌদি আরবের অর্থায়নে প্রতিটি উপজেলায় মডেল মসজিদ ও ইসলামী চর্চা কেন্দ্র নির্মাণের জন্য আট হাজার কোটি টাকার মহাপ্রকল্প গ্রহণ করেছে সরকার। দেশের ইতিহাসের বৃহত্তম এই ধর্মীয় প্রকল্পের আওতায় ৫৬০টি মডেল মসজিদ ও ইসলাম চর্চা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করা হবে।

এর মাধ্যমে বাংলাদেশে ওয়াহাবি মতবাদ বিকশিত হওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। বাংলাদেশ সরকার সম্প্রতি সৌদি আরবের নেতৃত্বাধীন সামরিক জোটে যোগ দিয়েছে।

এই পরিস্থিতিতে বিশ্লেষকরা বলছেন, বাংলাদেশের রাজনীতি ক্রমাগত ইসলামীকরণের দিকে ঝুকছে। সরকারের কর্মকাণ্ড এবং বিভিন্ন জোট ও রাজনৈতিক দলের কাজকর্মে এর প্রতিফলন রয়েছে।

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও মানবাধিকার কর্মী এডভোকেট সুলতানা কামাল বেনারকে বলেছেন, “সরকার ধর্মনিরপেক্ষ নীতি বিসর্জন দিয়ে ডান ও ইসলামপন্থী রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আপস করছে এবং অনেক ক্ষেত্রে তাদের নীতি বাস্তবায়ন করছে।”

“এর ফলে বাংলাদেশের অসাম্প্রদায়িক ও ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। সামাজিক সাম্য ও সহনশীলতার পরিবেশ থাকবে না। জঙ্গিবাদ ও ওহাবী মতবাদের প্রসার ঘটবে। নারীমুক্তি এবং নারীর সমঅধিকার প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা মুখ থুবড়ে পরবে,” মনে করেন সুলতানা কামাল।

কেন ধর্মীয় রাজনীতি?

ধর্মের বাইরে মানুষের কল্যাণকামী কর্মকাণ্ডের ওপর ভর করে জনপ্রিয়তা ধরে রাখা যায় কিনা—এই প্রশ্নের জবাবে বিএনপি নেতা খন্দকার মোশারফ হোসেন বেনারকে বলেন, “আমরা দেশের ৯০ ভাগ মানুষের ধর্মীয় বিশ্বাসকে গুরুত্ব দেই। বিএনপির প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে আমরা ইসলাম পছন্দ দল হিসেবে পরিচিত।”

তিনি বলেন, “আমরা সংবিধানে ‘বিসমিল্লাহ’ সংযোজন করেছি। মহান আল্লাহর ওপর আস্থার কথা বলেছি। এখন আওয়ামী লীগ কেন ইসলামের দিকে ঝুঁকছে, সেটি বিশ্লেষণ করে দেখা যায়।”

নতুন ‘ইসলামী মূল্যবোধ’ জোটের অন্যতম শীর্ষ নেতা ও জাতীয় পার্টির কো চেয়ারম্যান গোলাম মোহাম্মদ কাদের বেনারকে বলেন, “আওয়ামী লীগ, বিএনপি এবং জাতীয় পার্টি মূলত একই চরিত্রের। আওয়ামী লীগ বামপন্থীদের সঙ্গে থাকে, এজন্য অনেকে মনে করে তারা ধর্মনিরপেক্ষ। আসলে এই তিনটি দল একই ধরনের।”

তিনি বলেন, “বাংলাদেশের ৮০ শতাংশ মানুষ একদিকে ইসলামপন্থী, অন্যদিকে অসাম্প্রদায়িক। ১০ শতাংশ গোঁড়া ইসলামপন্থী এবং ১০ শতাংশ ধর্মনিরপেক্ষ। ৮০ শতাংশ মানুষের ভোট পাওয়ার জন্য বড় তিনটি দলের নেতৃত্বাধীন জোট একাধারে অসাম্প্রদায়িকতা ও ধর্মের কথা বলে।”

আওয়ামী লীগের অস্বীকার

আওয়ামী লীগ ইসলামের দিকে এগোচ্ছে—এমন বক্তব্য মানতে নারাজ দলটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক দিপু মনি। কওমি সনদের স্বীকৃতি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “সবাইকে এক শিক্ষার আওতায় আনতে এবং মাদ্রাসার ৪০ লক্ষ শিক্ষার্থীকে মূলধারায় অন্তর্ভুক্ত করার জন্য এটা করা হচ্ছে।”

“আমরা অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নের কথা বলছি। কাউকে পেছনে ফেলে এগিয়ে যাওয়া যাবে না,” জানান দিপু মনি।

পাঠ্যপুস্তকে ইসলামি লেখা অন্তর্ভুক্ত করার বিষয়ে তিনি বলেন, “এ বিষয়ে তদন্ত কমিটি হয়েছে। পাঠ্যপুস্তক অসাম্প্রদায়িক ধারায় সংশোধন করা হবে।”

তিনি বলেন, “নির্বাচন সামনে রেখে জোট গঠন বা বিস্তার হতেই পারে। তবে সেটা হবে ধর্মনিরপেক্ষ দলগুলোর সঙ্গে। সাম্প্রদায়িক শক্তির সঙ্গে আওয়ামী লীগের জোট গড়ার প্রশ্নই ওঠে না।

তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু বেনারকে বলেন, “মহাজোটের সরকার ইসলামপন্থী হয়নি। প্রধানমন্ত্রী, আওয়ামী লীগ বা ১৪ দলের সঙ্গে হেফাজতে ইসলামের কোনো কমিটির বৈঠক হয়নি। হেফাজতের রাজনীতির সঙ্গেও ঐক্য হয়নি।”

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।