হলি আর্টিজানে জঙ্গি হামলা: বছর ঘুরলেও নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন বিদেশিরা

জেসমিন পাপড়ি
2017.06.29
ঢাকা
রাজধানীর কূটনৈতিক পাড়ায় প্রবেশকারী যানবাহনে পুলিশের নজরদারি। রাজধানীর কূটনৈতিক পাড়ায় প্রবেশকারী যানবাহনে পুলিশের নজরদারি। ২৮ জুন ২০১৭।
নিউজরুম ফটো

গুলশানের হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁয় জঙ্গি হামলার এক বছর পরও বাংলাদেশকে নিরাপদ মনে করছেন না ঢাকায় অবস্থানরত কূটনীতিক ও বিদেশিরা। নৃশংস ওই হামলার পর নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা সত্ত্বেও আতঙ্ক কাটেনি তাঁদের।

গত বছরের ১ জুলাই রাতে গুলশানের কূটনৈতিক পাড়ার ৭৯ নম্বর সড়কে অবস্থিত হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁয় হামলা চালায় সশস্ত্র জঙ্গিরা। বাংলাদেশসহ পাঁচটি দেশের ২০ জন নাগরিককে গুলি করে এবং চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে নৃশংসভাবে হত্যা করে তারা। জিম্মি করে রাখে আরও অনেককে। এর মধ্যে সাতজনই ছিলেন দ্বিপা‌ক্ষিক উন্নয়নে বাংলাদেশের একক বৃহত্তম সহযোগী রাষ্ট্র জাপানের নাগরিক। হামলার বিভৎ​সতায় স্তম্ভিত হয়ে যায় সবাই।

গত সপ্তাহে ঢাকায় অবস্থিত জাপানের দূতাবাসের পক্ষ থেকে বেনারকে বলা হয়েছে, “আমরা কোনো হামলা বা জাপানিদের টার্গেট করে হত্যা করা হবে—এটা আশা করিনি। যদিও এখনো এটি ঘটছে।”

“নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যথাসাধ্য চেষ্টা করে যাচ্ছে। কিন্তু নিরাপত্তা ঝুঁকি নিয়ে আমাদের দুশ্চিন্তা এখনো কাটেনি।”

“আমরা দেখছি প্রতি সপ্তাহে অস্ত্র উদ্ধার করা হচ্ছে এবং প্রতি মাসেই দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে মানুষকে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। এসব অগ্রগতি সত্ত্বেও নিরাপত্তা ঝুঁকি রয়ে গেছে বলে আমরা মনে করছি।”

ওই হামলার ঘটনায় নিহত ২৪ জনের মধ্যে সাতজন জাপানি নাগরিক ছাড়াও নয়জন ইতালিয়ান, ছয়জন বাংলাদেশি, একজন যুক্তরাষ্ট্রের এবং একজন ভারতীয় নাগরিক ছিলেন। আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠন আইএস ওই হামলার দায় শিকার করে। পাঁচ বাংলাদেশি যুবক ওই হামলা চালায়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর যৌথ অভিযানে ওই পাঁচজন নিহত হলে জিম্মি অবস্থার অবসান ঘটে।

২০১৫ সালের জানুয়ারি আইএস ঘোষিত বেশ কয়েকটি জঙ্গি হামলার শিকার হয়েছে ইউরোপের দেশ ফ্রান্স। বাংলাদেশে নিযুক্ত দেশটির রাষ্ট্রদূত সোফি আবার্টের মতে, উভয় রাষ্ট্রকেই সন্ত্রাসী হামলার বিষয়ে সদা সতর্ক থাকতে হবে।

বেনারকে তিনি বলেন, “মুক্ত, উদার, ধর্মনিরপেক্ষ সমাজকে ঘৃণা করে জঙ্গিরা। যত দিন আমরা এমন সমাজের প্রতিনিধিত্ব করব, তাদের চেয়ে আলাদা থাকব তত দিন হুমকি এবং নিরাপত্তাহীনতা আমাদের জীবনের অংশ হয়ে থাকবে। ফ্রান্স, বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে হামলার ঘটনায় এ বিষয়ে আমি নিশ্চিত হয়েছি।”

ডেনমার্কের রাষ্ট্রদূত মিকায়েল হেমনিতির মতে, হলি আর্টিজানের মতো আক্রমণ আবারও ঘটতে পারে বলে বিদেশিরা এখনো আশঙ্কা করছেন।

গত মে মাসে কূটনৈতিক রিপোর্টারদের সংগঠন ডিক্যাব আয়োজিত একটি অনুষ্ঠানে বাংলাদেশে নিযুক্ত ডেনমার্কের রাষ্ট্রদূত বলেন, “অনেক বিধিনিষেধ মেনে এখনো আমাদের চলাফেরা করতে হয়। আমরা নিয়মিত ঝুঁকির মাত্রা নিরূপণ করি। হামলার দশ মাস পরও আমরা ঝুঁকিতে রয়েছি বলে মনে করি।”

সতর্কতা ও উদ্বেগ

নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদারে বছরজুড়ে বাংলাদেশ সরকারের প্রচেষ্টার প্রশংসা করেছেন ফরাসি রাষ্ট্রদূত ও অন্যান্য বিদেশি কর্মকর্তারা। আবার্ট বলেন, “আমরা দেখেছি, বাংলাদেশের পুলিশ কীভাবে জঙ্গিদের কঠোরভাবে দমন করছে। এ কারণে হুমকির মাত্রা কমে এসেছে। তবুও, অন্যান্য সম্প্রদায়ের মতো বিদেশিরাও মনে করছেন তাঁরা লক্ষ্যবস্তু হতে পারেন। তারা সতর্ক রয়েছেন।”

তিনি আরো বলেন, “আপনাকে হামলা করা জঙ্গিদের জন্য যত কঠিন করে তুলতে পারবেন, আপনি তত সুরিক্ষিত থাকবেন। স্বাভাবিক জীবন যাপনের জন্য এখানে সবাই এখন তাই করছে।”

ঢাকাস্থ পাকিস্তানের হাইকমিশনার রফিউজ্জামান সিদ্দিকী বিদেশিদের সুরক্ষার জন্য বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ এবং তা বাস্তবায়নের জন্য বাংলাদেশের প্রশংসা করেন।

“নিরাপত্তা পরিস্থিতি সব সময় কূটনীতিক, বিশেষ করে পশ্চিমাদের জন্য একটি বিশাল উদ্বেগের বিষয়। তবে বাংলাদেশ সরকার পরিস্থিতির উন্নয়নে প্রয়োজনীয় বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণের পর থেকে আমরা ঢাকায় নিরাপদ বোধ করছি,” বেনারকে বলেন রফিউজ্জামান।

তবে সব বিদেশি এমন ধারণা পোষণ করেন না।

গুলশান এলাকায় বসবাসকারী এলিজাবেথ অক্টোফানি নামে এক ইন্দোনেশিয়ান বেনারকে বলেন, “গুলশান ও বারিধারায় যেখানে বেশির ভাগ বিদেশি বাস করে সেখানে পুলিশের উপস্থিতি বেড়েছে। তাই বলে এলাকাটি অনেক নিরাপদ তা মনে করার যথেষ্ট কারণ নেই।”

“হলি আর্টিজানে হামলার পর থেকে পুলিশ ও অন্যান্য লক্ষ্যবস্তুতে একাধিক আত্মঘাতী হামলা হয়েছে। এ ছাড়া প্রায় প্রতি সপ্তাহে বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় সন্ত্রাস ও জঙ্গিবিরোধী উল্লেখযোগ্য অভিযান পরিচালিত হচ্ছে। এই পরিস্থিতি এটাই প্রমাণ করে যে, শত শত না হলেও কয়েক ডজন জঙ্গি এখনো রয়ে গেছে। এই পরিস্থিতিতে দেশ নিরাপদ মনে হয় না।”

তবে গুলশান এলাকায় বসবাসকারী ইউক্রেনের বাসিন্দা ইননা ভেচটোমোভা ভিন্ন মত পোষণ করেন। তিনি বলেন, “আমি নিরাপদ বোধ করি। কিন্তু আমি এখানে আমার দূতাবাসের সঙ্গে যোগাযোগ রাখি এবং অবাঞ্ছিত পরিস্থিতি এড়ানোর জন্য তাদের পরামর্শগুলি কঠোরভাবে পালন করি।”

হলি আর্টিজানের নতুন ঠিকানা থেকে গুলশানের রাস্তার চিত্র।
হলি আর্টিজানের নতুন ঠিকানা থেকে গুলশানের রাস্তার চিত্র।
সৌজন্যে এলিজাবেথ অক্টোফানি

‘পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে’

একজন উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তার মতে, বিদেশি যারা এই দেশে অবস্থান করছেন বা বসবাস করছেন তাদেরকে দেশের নিরাপত্তা ব্যবস্থার সঙ্গে খাপ খাইয়ে চলতে হবে।

পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো. শাহরিয়ার আলম বেনারকে বলেন, “হলি আর্টিজানে হামলার পর থেকে আমরা বলে আসছি, এটি নতুন একটি স্বাভাবিক পরিস্থিতি। সবাইকে খাপ খাইয়ে নিতে হবে।”

তিনি বলেন, “নিরাপত্তার বিষয়ে আমরা যত ধরনের উদ্যোগ নিয়েছি, তার সব বিষয়ে কূটনীতিকেরা ততটা সচেতন নন বলে আমার মনে হয়। কূটনৈতিক পাড়ার বাইরেও পুলিশের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখার অনুমতি তাদের দেওয়া হয়েছে। আমার মনে হয় পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে এবং এটা অব্যাহত থাকবে।”

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।