শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় হলি আর্টিজানে নিহতদের স্মরণ
2017.07.01
ঢাকা

ঢাকার গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে ভয়াবহ জঙ্গি হামলার ঘটনার এক বছর পূর্তিতে শনিবার বিনম্র শ্রদ্ধা ও গভীর ভালোবাসায় নিহতদের স্মরণ করল বাংলাদেশ। বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠেনর নেতা-কর্মী ছাড়াও বিদেশি এবং বিভিন্ন শ্রেণি–পেশার মানুষ ঘটনাস্থলে গিয়ে অস্থায়ী বেদিতে ফুল দেন।
জঙ্গিবাদ দমনের নতুন শপথ নিয়ে দেশের মানুষ যখন গুলশান হামলায় নিহতদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাচ্ছিল, ঠিক তখনই ঢাকা থেকে প্রায় ৬ শ কিলোমিটার দূরে কুষ্টিয়া জেলায় একটি জঙ্গি আস্তানায় অভিযান চালিয়ে তিন সন্দেহভাজন নারী জঙ্গিকে আটক করে পুলিশ।
গত বছরের ১ জুলাই রাতে গুলশান ২-এর ৭৯ নম্বর সড়কে অবস্থিত হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁয় আকস্মিক হামলা চালায় কয়েকজন জঙ্গি। ওই হামলায় ১৮ বিদেশিসহ মোট ২৪ জন নিহত হন। এর দায় স্বীকার করে ইসলামিক স্টেট (আইএস) বিবৃতি দেয়। পরদিন সকালে আর্মির কমান্ডো বাহিনীর অভিযানে পাঁচ হামলাকারীর মৃত্যুর মধ্য দিয়ে জিম্মিদশার অবসান ঘটে।
শনিবার সকাল থেকেই হলি আর্টিজানের মূল ভবনটির সামনে ভিড় জমাতে থাকেন বিভিন্ন দূতাবাসের কূটনীতিক, বিভিন্ন সংগঠন ও সর্বস্তরের মানুষ। স্বজন হারানোদের আর্তনাদের পাশাপাশি সেখান থেকে জঙ্গিবাদ নির্মূলের প্রত্যয়ও উচ্চারিত হয়।
বিশ্বজুড়ে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টিকারী ওই হত্যাকাণ্ডে নিহতদের স্মরণ অনুষ্ঠানের জন্য শনিবার সকাল থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত এটি খোলা রাখা হয়। ভবনটির সামনে তৈরি একটি বেদিতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানায় বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, কূটনৈতিক মিশন, নাগরিক সমাজের সদস্য ও পুলিশ কর্মকর্তাদের প্রতিনিধি ও সাধারণ মানুষ।
মূলত: সকাল ১০ থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত হলি আর্টিজান ভবন খুলে রাখার কথা জানানো হয়। তবে শনিবার সকাল সাড়ে ৭টার দিকে সেখানে গিয়ে নিহতের প্রতি ফুলেল শ্রদ্ধা জানান বাংলাদেশে জাপানের রাষ্ট্রদূত মাসাতো ওয়াতানাবে ও দেশটির আন্তর্জাতিক সহায়তা সংস্থা জাইকার বাংলাদেশ কান্ট্রি ডিরেক্টর মিকিও হাতায়েদা।
সকাল ১১টার দিকে আসেন ঢাকাস্থ ইতালির রাষ্ট্রদূত মারিও পালমাসহ দূতাবাসের অন্যান্য কর্মকর্তারা। এ সময় তাদের সঙ্গে একজন নিহত ইতালি নাগরিকের স্বজনও ছিলেন। ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানানোর পরে শোকবাণী পাঠ করেন ইতালি দূতাবাসের একজন কর্মকর্তা। এসময় কান্নায় ভেঙে পড়েন কয়েকজন।
তবে কূটনীতিকরা এড়িয়ে চলেন সাংবাদিকদের। কঠোর নিরাপত্তার মধ্য দিয়ে এসে তারা ফুল দিয়ে চলে যান।
জঙ্গি হামলায় নিহতদের মধ্যে ১৮ জন ছিলেন বিদেশি; তার মধ্যে নয়জন ছিলেন ইতালির, সাতজন ছিলেন জাপানি। নিহত জাপানিরা বাংলাদেশের বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পে কাজ করছিলেন। সেদিনের হামলা ঠেকাতে গিয়ে নিহত হয়েছিলেন পুলিশের সহকারী কমিশনার রবিউল ইসলাম ও পরিদর্শক সালাউদ্দিন।
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের ওয়ার্কার্স পার্টি, প্রধান বিরোধী দল বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী আহমেদ। পুলিশের পক্ষ থেকে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মোখলেসুর রহমান হলি আর্টিজানে নিহতদের প্রতি শ্রদ্ধা জানান। এ ছাড়া জাসদসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল এবং বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠনের পক্ষ থেকেও শ্রদ্ধা জানানো হয়।
নিহত ফারাজ আইয়াজ হোসেন এবং ইশরাত খন্দকারের স্বজন ও জাকির হোসেন শাওনের মা মাসুদা বেগম নারায়ণগঞ্জ থেকে ছেলের জন্য শোক জানাতে ছুটে আসেন। শাওন হলি আর্টিজানের কর্মচারী ছিলেন। তিনি হামলার রাতে আহত অবস্থায় সেখান থেকে পালিয়ে গেলেও পরে পুলিশের হেফাজতে থাকা অবস্থায় হাসপাতালে মারা যান। অন্যান্যদের মধ্যে শ্রদ্ধা জানান সুজন সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার, ভাস্কর ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী, শহীদজায়া শ্যামলী নাসরিন চৌধুরী, সেলিম রেজা নূর, আসিফ মুনীর, শমী কায়সার।
আহাজারি করতে করতে শাওনের মা তার ছেলের মৃত্যুর জন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে দায়ী করেন। তিনি বেনারকে বলেন, “বিনা চিকিৎসায় আর পুলিশের অত্যাচারে আমার ছেলে মারা গেছে। সংসারের উপার্জনক্ষম সন্তানকে হারিয়ে অনেক কষ্টে দিন যাচ্ছে।”
শ্রদ্ধা নিবেদনের পর একাত্তরের ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির বেনারকে বলেন, “জঙ্গিবাদের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিরা সাধারণ মতাদর্শ নয়, মওদুদীবাদ-ওহাবীবাদের সমর্থক। সরকার আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে ব্যবহার করে সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে ঠিকই। কিন্তু জঙ্গিদের এসব মতাদর্শকে নিশ্চিহ্ন করতে যথাযথ পদক্ষেপ নিচ্ছে না।”
বদিউল আলম মজুমদার বেনারকে বলেন, “জঙ্গিবাদ নির্মূলে সরকারের সুচিন্তিত কৌশলের পাশাপাশি সাধারণ মানুষ ও রাজনীতির মধ্যে এক সম্মিলিত ঐক্য জরুরি।”
এদিকে জঙ্গিবাদ নিয়ে কোনো রহস্য তৈরি না করে তা নির্মূলে সমন্বিত উদ্যোগ নিতে সরকারের প্রতি আহ্বান বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী।
হলি আর্টিজানে শ্রদ্ধা জানাতে এসে সাংবাদিকদের তিনি বলেন, “বাইরের বিভিন্ন সংগঠন বলছে, এটা আইএস করছে; আইএস’র পক্ষ থেকে দায়ও স্বীকার করা হয়। অথচ সরকার বলছে, না। আমরা চাই, কোনো ধরনের রহস্য যেন তৈরি না হয়।”
শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে ওবায়দুল কাদের সাংবাদিকদের বলেন, “জঙ্গিবাদ পুরোপুরিভাবে নির্মূল হয়নি, তবে দুর্বল হয়েছে। এ কাজে শুধু আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর নির্ভর করলে চলবে না। দেশপ্রেমিক জনগণের ঐক্যবদ্ধ শক্তি দিয়ে একটি প্ল্যাটফর্ম গড়ে তুলতে হবে।”
তিন নারী জঙ্গি আটক
শনিবার ভোরে কুষ্টিয়ার ভেড়ামারা জেলার বামনপাড়া এলাকার একটি সন্দেহজনক জঙ্গি আস্তানা থেকে সুইসাইডাল ভেস্ট, অস্ত্র ও গোলাবারুদসহ তিন নারী জঙ্গিকে আটকের কথা জানিয়েছে পুলিশ।
পুলিশ জানিয়েছে, এই তিনজনের মধ্যে একজন গুলশানে হামলা চালানো নব্য জেএমবির বর্তমান আমির আইয়ুব বাচ্চু ওরফে সজীবের স্ত্রী তিথি। অন্য দুজন সংগঠনের সেকেন্ড ইন কমান্ড আরমান আলীর স্ত্রী সুমাইয়া এবং ভেড়ামারার নগর দৌলতপুর গ্রামের রাজিকুল ওরফে রাশেদ ওরফে তালহার স্ত্রী টলী বেগম। সুমাইয়ার শিশুসন্তানও তার সঙ্গে রয়েছে।
কুষ্টিয়ার পুলিশ সুপার এস এম মেহেদী হাসান বেনারকে বলেন, “অভিযান চালানোর সময় সুইসাইডাল ভেস্ট পরা একজন নারী পুলিশের উপর হামলা চালানোর চেষ্টা করেন। তবে সেটা বিস্ফোরণের আগেই পুলিশ তাকে ধরে ফেলে। পরে অন্য দুই নারীকে আটক করা সম্ভব হয়।”
জঙ্গিদের ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন
হলি আর্টিজান বেকারিতে চিহ্নিত হামলাকারীরা গুলি ও বোমায় নিহত হয়েছিলেন বলে ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।
শনিবার ফরেনসিক বিভাগের প্রধান সোহেল মাহমুদ সাংবাদিকদের বলেন, “নিহত ছয়জনের প্রত্যেকের শরীরে গড়ে দুই থেকে তিনটি গুলির জখম পাওয়া গেছে। এ ছাড়া দুজনের শরীরে এবং একজনের বাম হাত ও গালে বোমার আঘাত রয়েছে।”
গত বছরের ১ জুলাই হলি আর্টিজানে চিহ্নিত হামলাকারীরা হলেন; নিবরাস ইসলাম, খায়রুল ইসলাম পিয়াল, মীর সামেহ মোবাশ্বের, রোহান ইবনে ইমতিয়াজ ও শফিকুল ইসলাম উজ্জ্বল। ওই পাঁচজনের সঙ্গে সন্দেহভাজন হিসেবে রেস্তোরাঁটির বাবুর্চি সাইফুল ইসলাম চৌকিদারের লাশও ঢাকা মেডিকেলে পাঠানো হয়।