মা-বাবা হত্যা মামলায় ঐশীকে মৃত্যুদণ্ডের বদলে যাবজ্জীবন
2017.06.05
ঢাকা

রাজধানী ঢাকার চামেলীবাগে নিজের মা-বাবাকে হত্যার ঘটনায় মেয়ে ঐশী রহমানের অপরাধ মৃত্যুদণ্ডের যোগ্য হলেও তার বয়স ও মানসিক স্বাস্থ্য বিবেচনা করে মৃত্যুদণ্ডের সাজা কমিয়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের রায় দিয়েছে উচ্চ আদালত।
সোমবার বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন সেলিম ও বিচারপতি মো. জাহাঙ্গীর হোসেনের হাই কোর্ট বেঞ্চ আলোচিত এই মামলার রায় দেন।
সাজা কমানোর এ রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন মানবাধিকার কর্মীরা। সর্বোচ্চ আদালতে এ সাজা আরও কমবে বলেও আশা প্রকাশ করেছেন তাঁরা।
মানবাধিকার কর্মী ও বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির নির্বাহী-পরিচালক অ্যাডভোকেট সালমা আলী বেনারকে বলেন, “ঐশীর এই বিষয়টার (অপরাধ) পেছনে সে একা দায়ী না, পুরো সমাজ দায়ী, পরিবেশ দায়ী, পরিবার দায়ী। আর তাই তার মৃত্যুদণ্ড রহিত হওয়ায় আমি ভীষণ খুশি।”
তিনি মনে করেন “কারাগারের ডেভেলপমেন্ট সেন্টারে সংশোধিত হলে ঐশী এই সাজা থেকে আরো মাফ পেতে পারে। এ ক্ষেত্রে সরকারেরও দায়িত্ব আছে।”
তবে আরেক মানবাধিকার কর্মী অ্যাডভোকেট এলিনা খান হত্যার মতো অপরাধের সাজা কমানোর বিপক্ষে। তিনি বেনারকে বলেন, “ঐশী তার বাবা-মাকে হত্যা করেছে। এর চেয়ে নৃশংস ব্যাপার আর হতে পারে না। সেই বিচারে তার (ঐশীর) শাস্তি মৃত্যুদণ্ড হতে পারে কিংবা যাবজ্জীবনও। অপরাধের শাস্তি হয়েছে, আদালত তাকে খালাস দেয়নি, এতে আমি খুশি।”
রায়ে যাবজ্জীবনের পাশাপাশি ঐশীকে পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা, অনাদায়ে আরও ছয় মাসের কারাদণ্ড দিয়েছে উচ্চ আদালত। তবে হত্যায় সহযোগিতার জন্য ঐশীর বন্ধু মিজানুর রহমানকে বিচারিক আদালতের দেওয়া দুই বছরের কারাদণ্ড বহাল রাখা হয়েছে।
আদালতে এ মামলায় রাষ্ট্রপক্ষে শুনানি করেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল জহুরুল হক জহির ও সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল আতিকুল হক সেলিম। অন্যদিকে ঐশীর আইনজীবী ছিলেন সুজিত চ্যাটার্জি বাপ্পী।
রায়ের পর তিনি সাংবাদিকদের বলেন, “এ রায় নিয়ে আমাদের প্রত্যাশা আরও বেশি ছিল। কারণ ঘটনার সময় ঐশী মানসিকভাবে বিপর্যস্ত ছিল। তার আচরণগত সমস্যাও ছিল।”
“যাই হোক উচ্চ আদালত যে রায় দিয়েছে তা আমরা মেনে নিচ্ছি,” বলেন তিনি।
ঐশীর স্বজনেররা এ রায়ের বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ আদালতে আপিলে যাওয়ার ইঙ্গিত দিয়েছেন বলেও জানান সুজিত চ্যাটার্জি।
ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল জহিরুল হক জহির বেনার বলেন, “উচ্চ আদালত নিম্ন আদালতের দণ্ডাদেশই বহাল রেখেছেন, তবে ঐশীর বাস্তব এবং পারিপার্শ্বিক অবস্থা বিবেচনা করে মৃত্যুদণ্ডের পরিবর্তে যাবজ্জীবন দিয়েছেন।”
যা ঘটেছিল
২০১৩ সালের ১৬ আগস্ট রাজধানীর চামেলীবাগে নিজেদের বাসা থেকে এসবি কর্মকর্তা মাহফুজ ও তার স্ত্রী স্বপ্নার লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। পরদিন পল্টন থানায় হত্যা মামলা করেন মাহফুজের ভাই মশিউর রহমান।
তবে হত্যাকাণ্ডের দুদিন পরেই পল্টন থানায় আত্মসমর্পণ করে বাবা মাকে খুন করার কথা স্বীকার করেন নিহত দম্পতির মেয়ে ঐশী।
২০১৫ সালের ১২ নভেম্বর আলোচিত এ মামলার রায়ে ঐশীকে মৃত্যুদণ্ড দেয় ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-৩। পাশাপাশি হত্যাকাণ্ডে সহায়তার দায়ে তার বন্ধু মিজানুর রহমানকে দুই বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। তবে আরেক বন্ধু আসাদুজ্জামান জনিকে খালাস দেওয়া হয়।
নিম্ন আদালত রায়ের পর্যবেক্ষণে জানায়, সাক্ষ্য-প্রমাণ অনুযায়ী, ঘটনার সময় আসামি ঐশী প্রাপ্তবয়স্ক ছিলেন। আর হত্যাকাণ্ডটিও ছিল পরিকল্পিত ও নৃশংস।
একই মামলায় ঐশীদের অপ্রাপ্তবয়স্ক গৃহকর্মীকেও আসামি করা হয়। কিশোর আদালতে তার বিচার চলছে।
এদিকে রায়ের পরের মাসেই খালাস চেয়ে উচ্চ আদালতে আপিল করেন ঐশী। চলতি বছরের ১২ মার্চ আপিল ও ডেথ রেফারেন্সের ওপর শুনানি শুরু হয়।
এর মাঝে ঐশীর মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে উদ্বেগ জানিয়ে রিট আবেদন করে একটি মানবাধিকার সংস্থা। এরপর গত ১০ এপ্রিল ঐশীর বক্তব্য শোনেন হাই কোর্টের দুই বিচারক।
যে পাঁচ কারণে মৃত্যুদণ্ডের পরিবর্তে যাবজ্জীবন
যেসব বাস্তবতা এবং পারিপার্শ্বিক অবস্থা বিবেচনায় নিয়ে সাজা কমানো হয়েছে, তেমন পাঁচটি কারণ রায়ের পর্যবেক্ষণে উচ্চ আদালত উল্লেখ করেছে।
এগুলো হলো; এক. কোনো সুস্পষ্ট উদ্দেশ্য ছাড়া মানসিক বিচ্যুতির কারণেই ঐশী জোড়া খুনের ঘটনা ঘটিয়েছে।
দুই. আসামি ঐশী অ্যাজমাসহ নানা রোগে আক্রান্ত। বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিবেদন অনুযায়ী তার দাদি ও মামা অনেক আগ থেকেই মানসিকভাবে বিপর্যস্ত ছিল। অর্থাৎ তার পরিবারে মানসিক বিপর্যস্ততার ইতিহাস রয়েছে।
তিন. ঘটনার (হত্যাকাণ্ড) সময় ঐশী সাবালকত্ব পাওয়ার মুহূর্তে ছিল। সেসময় তার বয়স ছিল ১৯ বছর।
চার. ঐশীর বিরুদ্ধে অতীতে ফৌজদারি অপরাধের কোনো নজির নেই। এবং
পাঁচ. ঘটনার দুই দিন পর সে নিজেই থানায় আত্মসমর্পণ করে।
রায়ের পর্যবেক্ষণে আদালত বলেছে, নিজেদের পেশা ও জীবন-জীবিকা নিয়ে ব্যস্ত থাকায় ঐশীর বাবা-মা তাকে পর্যাপ্ত সময় দিতে পারেননি। বিষয়টি তারা পরে উপলব্ধি করলেও তত দিনে মাদকাসক্তিতে ঐশী উচ্ছন্নে চলে গেছে।
প্রসঙ্গত, ঐশীর বাবা মাহফুজুর রহমান পুলিশে ও তার মা স্বপ্না রহমান বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ছিলেন।
মৃত্যুদণ্ডই একমাত্র দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নয়: আদালত
পর্যবেক্ষণে আদালত বলেছে, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, কানাডাসহ বিভিন্ন দেশে মৃত্যুদণ্ডকে নিরুৎসাহিত করা হলেও আমাদের দেশে এ বিষয়ে কোনো গাইডলাইন নেই। পরিবেশও এখনো আসেনি। শিক্ষার হার যেমন বেড়েছে তেমনি জনসংখ্যাও বেড়েছে। এ কারণে অপরাধের প্রবণতাও বাড়ছে। এ অবস্থায় মৃত্যুদণ্ড রহিত করা যুক্তিসঙ্গত নয়।
তবে মৃত্যুদণ্ডই একমাত্র দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নয় জানিয়ে আদালত রায়ে বলেছে, মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করলেই সমাজ থেকে অপরাধ দূর হয় তা বলা যায় না। লঘু দণ্ডও অনেক সময় সমাজ থেকে অপরাধ কমাতে সাহায্য করে।
বাবা-মা ও অভিভাবকদের সন্তানদের জন্য ভালো পরিবেশ নিশ্চিত করা এবং সন্তানদের উপযুক্ত সময় দেওয়া উচিত বলেও উল্লেখ করেছে আদালত।