গুম-খুনের ঘটনাগুলো জাতিসংঘকে তদন্তের অনুরোধ: এইচআরডব্লিউ
2017.07.06
ঢাকা

বাংলাদেশে অব্যাহত গুম ও অপহরণে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী জড়িত অভিযোগ তুলে জাতিসংঘকে এ সংক্রান্ত অভিযোগগুলো পূর্ণাঙ্গ তদন্ত করতে বলেছে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ)। এই সংস্কৃতি বন্ধ এবং এ ধরনের অভিযোগগুলো পক্ষপাতহীন ও স্বাধীনভাবে তদন্ত করতে সরকারে প্রতিও আহ্বান জানিয়েছে সংস্থাটি।
গতকাল বৃহস্পতিবার হিউম্যান রাইটস ওয়াচ প্রকাশিত ‘উই ডোন্ট হ্যাভ হিম’ শিরোনামের প্রতিবেদনে এই আহবান জানানো হয়। তবে এসব অভিযোগ বাংলাদেশ সম্পর্কে হিউম্যান রাইটস ওয়াচের নেতিবাচক প্রচারণার অংশ বলে মনে করছে সরকার।
সংস্থাটি বলছে, সরকারের নিরাপত্তা বাহিনী যাকে খুশি তাকে গ্রেপ্তার করছে, তার অপরাধ নির্ণয় ও শাস্তির সিদ্ধান্তও দিয়ে ফেলছে। সরকার এসব অভিযোগের প্রতি কর্ণপাত করছে না। বরং যারা নিখোঁজ, অপহরণ বা গুম হয়ে আছেন তাঁরা নিজেরাই গা ঢাকা দিয়েছেন বলে সমর্থন জোগাচ্ছে।
এ বিষয়গুলোর তদন্তে জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনারকে বাংলাদেশে এসে পূর্ণাঙ্গ তদন্ত করার অনুমতি দেওয়া উচিত বলে মনে করে এইচআরডব্লিউ।
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী শাহদীন মালিক এখনো প্রতিবেদনটি পড়ে দেখেননি। তবে এ ধরনের অভিযোগের বিষয়ে তিনি ওয়াকিবহাল।
“আমরা নিখোঁজ, গুম, খুন, অপহরণের যেসব সংখ্যা শুনছি তা উদ্বেগজনক। যেখানে এসব অপরাধের জন্য অনেকটা সরাসরি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে অভিযুক্ত করা হচ্ছে, সেখানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রতি আস্থা ফিরিয়ে আনার জন্য প্রতিটি ঘটনা তদন্ত করে দেখা উচিত,” বেনারকে বলেন তিনি।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর প্রত্যাখ্যান
বৃহস্পতিবার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল সচিবালয়ে সাংবাদিকদের বলেছেন, “যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের সময়ও হিউম্যান রাইটস ওয়াচ নেতিবাচক প্রচারণা চালিয়েছিল। নতুন এ প্রতিবেদনটিও তার অংশ।”
কাউকে আটক করলে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে তাকে আদালতের সামনে হাজির করা হয় দাবি করে তিনি প্রতিবেদনটির তীব্র প্রতিবাদ করেছেন।
“কোনো ঘটনায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কেউ জড়িত থাকার প্রমাণ পেলে তাকে বিচারের মুখোমুখি করার নজির অবশ্যই আছে,” বলেন তিনি।
দেড় বছরে ১৩৮ জন গুম
সংস্থাটি বলছে, কেবলমাত্র ২০১৬ সালে ৯০ জন ব্যক্তি গুম হয়েছেন। অজ্ঞাতস্থানে আটক থাকার পর কয়েক সপ্তাহ বা কয়েক মাস পর তাঁদের আদালতে উপস্থাপন করা হয়।
নিখোঁজ অবস্থায় ২১ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়। নয়জন কোথায় আছেন সে ব্যাপারে কিছু জানা যায়নি। এই ৯০ জনের মধ্যে বিরোধী দলীয় তিন নেতার সন্তান রয়েছেন। আগস্টের বিভিন্ন সময় তাঁরা নিখোঁজ হন। ছয় মাস পর অজ্ঞাতস্থান থেকে তাঁরা মুক্তি পেয়ে বের হন, তবে বাকি দুজনের এখনো কোনো হদিস নেই।
২০১৭ সালের প্রথম পাঁচ মাসে ৪৮ জন নিখোঁজ হন। অজ্ঞাতস্থানে থাকার সময় তাঁদের ওপর নির্যাতন ও দুর্ব্যবহারের অভিযোগ আছে।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচের এশিয়া অঞ্চলের পরিচালক ব্র্যাড অ্যাডামস বলেন, “গুম হওয়ার ঘটনাগুলো খুব ভালোভাবে লিপিবদ্ধ আছে এবং রিপোর্ট হয়েছে। কিন্তু সরকার আইনের শাসনের প্রতি অবজ্ঞা দেখানোর ঘৃণ্য সংস্কৃতি অব্যাহত রেখেছে।”
“বাংলাদেশের নিরাপত্তা বাহিনী যাকে যখন খুশি আটক করছে, তারাই সিদ্ধান্ত দিচ্ছে আটক ব্যক্তিদের শাস্তি কী হবে, তারা দোষী না নির্দোষ। এমনকি তুলে আনা ব্যক্তিদের বেঁচে থাকার অধিকার আছে কি নেই, সেটাও তারাই ঠিক করছে,” বলেন তিনি।
২০১৪ সালে নির্বাচনের আগে আটটি পৃথক ঘটনায় বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) ১৯ জন নেতা–কর্মী নিখোঁজ হওয়ার বিষয়টির উল্লেখ রয়েছে প্রতিবেদনে।
অভিযোগ নিরাপত্তা বাহিনীর দিকে
হিউম্যান রাইটস ওয়াচ গুম হয়ে যাওয়া ব্যক্তিদের স্বজন, পরিবারের সদস্য, এবং প্রত্যক্ষদর্শী এমন শতাধিক ব্যক্তির সাক্ষাৎকার গ্রহণ করে। প্রতিবেদনটিতে পুলিশের কাজে স্বজনদের দায়ের করা অভিযোগ এবং অন্যান্য আইনি নথিপত্র সংযুক্ত রয়েছে। এসব বিষয়ে জানতে বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষকে চিঠি দেওয়া হলেও তাঁরা কোনো জবাব দিতে ব্যর্থ হয়েছেন।
ঘটনার সাক্ষী, নিখোঁজ ব্যক্তির স্বজনেরা এইচআরডব্লিউ-কে বলেছেন, বেশির ভাগ ঘটনাই ঘটিয়েছে র্যাব কিংবা পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ-ডিবি। এ দুটি বাহিনীর বিরুদ্ধেই নির্যাতনের অভিযোগ পুরোনো। বিরোধী দলীয় ১৯জনকে আটকের ক্ষেত্রে আটজনকে র্যাব, ছয়জনকে ডিবি ও বাকি পাঁচজনকে অন্য কোনো নিরাপত্তা সংস্থা তুলে নিয়ে গেছে বলে উল্লেখ করা হয়।
জানতে চাইলে র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক মুফতি মাহমুদ খান বলেন, “নিখোঁজ বা অপহরণের শিকার ব্যক্তিদের উদ্ধারে র্যাব কতটা তৎপর তার প্রমাণ ফরহাদ মজাহার। তাঁকে উদ্ধারে র্যাব কি করেছে তা দেশবাসী দেখেছে।”
“আমাদের নাম ভাঙিয়ে অনেক সময় অনেকে অপহরণ করে। কেউ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পরিচয় দিলে সঙ্গে সঙ্গে তা চ্যালেঞ্জ করা ও আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা উচিত,” বেনারকে বলেন তিনি।
রুহুল আমিন চৌধুরীর ছেলে আদনান চৌধুরীকে ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে র্যাব পরিচয়ে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। এইচআরডব্লিউকে রুহুল আমিন চৌধুরী বলেন, “র্যাব বলেছিল একদিন পর ফিরিয়ে দিয়ে যাবে। কিন্তু ছেলে আর কোনো দিন ফিরে আসেনি।”
ঢাকা মহানগর পুলিশের জনসংযোগ ও গণমাধ্যম শাখার মুখপাত্র মাসুদুর রহমান বেনারকে বলেন, “আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী হিসেবে পুলিশ কখনই আইনের ব্যত্যয় ঘটে এমন কিছু করে না।”
বিএনপি নেতা সাজেদুল ইসলাম সুমন নিখোঁজ হন ৪ ডিসেম্বর, ২০১৩। সাজেদুলের একজন স্বজন হিউম্যান রাইটস ওয়াচকে বলেন, “র্যাবের একজন শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তা তাঁদের ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় জানান, সাজেদুলসহ চার-পাঁচজন তাঁর হেফাজতে ছিল। পরে র্যাবেরই অন্য একটি দল তাঁদের নিয়ে যায়। কারণ তিনি ওই ব্যক্তিদের হত্যা করতে রাজি হননি।”
হেফাজতে মৃত্যুর অভিযোগ
হিউম্যান রাইটস ওয়াচের প্রতিবেদনে বলা হয়, অপহরণ, গুমের মতো আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর হেফাজতে মৃত্যুর ঘটনাও ঘটছে। ২০১৬-র ১৩ জুন জামাত ইসলামির ছাত্র সংগঠন ছাত্র শিবিরের কর্মী শহীদ আল মাহমুদকে টেনে হিঁচড়ে বাড়ি থেকে বের করে মাইক্রোবাসে তোলা হয় বলে অভিযোগ তাঁর বাবা রজব আলীর।
তিনি বলেন, “গ্রেপ্তারের সময় পুলিশ কর্মকর্তারা ছিলেন, যদিও পরে তাঁরা তা অস্বীকার করেন। দু সপ্তাহ পর পুলিশের তরফ থেকে বলা হয় বন্দুকযুদ্ধে শহীদ মারা গেছে।”
জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক মিজানুর রহমান বেনারকে বলেন, “প্রতিটি অভিযোগ খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। কারণ ব্যক্তির নিরাপত্তা বিধান রাষ্ট্রের প্রধান কর্তব্য।”
“অভিযোগ জানানোর নির্দিষ্ট সময় পরেও নিখোঁজ ব্যক্তির অবস্থান সম্পর্কে জানাতে না পারলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রতি আস্থাহীনতা বাড়ে,” বলেন তিনি।