দমন-পীড়ন সুষ্ঠু নির্বাচনের অঙ্গীকারকে ক্ষুণ্ন করেছে: এইচআরডব্লিউ
2024.01.12
ঢাকা

নির্বাচনের আগে ও পরে বিরোধী রাজনৈতিক কর্মীদের উপর ব্যাপক দমন পীড়ন এবং সহিংসতা বাংলাদেশে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু ভোটের অঙ্গীকার ক্ষুণ্ন করেছে। সম্প্রতি প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এমনটাই দাবি করেছে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ) ।
থাইল্যান্ডের ব্যাংককে বৃহস্পতিবার এইচআরডব্লিউ প্রকাশিত বৈশ্বিক প্রতিবেদনে এই পর্যবেক্ষণ তুলে ধরা হয়।
এতে বলা হয়, “সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের পোস্টে সরকারের সমালোচনা করায় গ্রেপ্তার করে ভিন্নমত দমন করেছে কর্তৃপক্ষ। নির্বাচনের আগে বিরোধী দলীয় সদস্যদের দমন-পীড়নের মাধ্যমে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু ভোটের অঙ্গীকারকে ক্ষুণ্ন করেছে।”
মানবাধিকার সংস্থাটির এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, “৭ জানুয়ারির নির্বাচনের পর শেখ হাসিনার সরকার টানা চতুর্থ মেয়াদে ক্ষমতায় ফিরে আসে, যে নির্বাচনে অবাধ ও সুষ্ঠু ভোট প্রক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন তুলে প্রধান বিরোধী দলগুলো নির্বাচন বর্জন করেছিল।”
বাংলাদেশের দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন প্রসঙ্গে এইচআরডব্লিউ-এর এশিয়া বিভাগের ডেপুটি ডিরেক্টর ফিল রবার্টসন বেনারনিউজের মালয়েশিয়া প্রতিনিধিকে বলেন, “নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশে সহিংসতা কতদিন চলবে তা আমরা জানি না, এটা বলা অসম্ভব। কিন্তু স্পষ্টতই নির্বাচনটি সঠিক হয়নি।”
বিএনপি কর্মীদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষের অত্যধিক বল প্রয়োগ ও নির্বাচনের আগ পর্যন্ত উল্লেখযোগ্য সংখ্যক সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, “বিএনপি নির্বাচন বয়কটের সিদ্ধান্ত নেওয়ার পেছনে এটি একটি কারণ ছিল বলে আমি মনে করি। স্পষ্টতই, এটি তাদের পছন্দ কিন্তু তাদের অনেক কর্মী হামলা, মারধরের শিকার হয়েছেন। তাদের গ্রেপ্তার ও দীর্ঘ সময় আটকে রাখা হয়েছে। এসব সমস্যা চলমান রাজনৈতিক সংকটের সঙ্গে সম্পৃক্ত।
“আমরা বলতে পারি, যে সহিংসতা সংঘটিত হয়েছিল তা অমানবিক ও অগ্রহণযোগ্য ছিল। এটি অবশ্যই বাংলাদেশের নির্বাচন নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু না হওয়ার ক্ষেত্রে সরাসরি ভূমিকা রেখেছে,” যোগ করেন তিনি।
এইচআরডব্লিউ-এর মূল্যায়ন সম্পর্কে জানতে চাইলে নবগঠিত মন্ত্রিপরিষদের জ্যেষ্ঠ সদস্য বীর মুক্তিযোদ্ধা আ.ক.ম. মোজাম্মেল হক বেনারকে বলেন, “সরকার সব নিয়ম মেনে গণতান্ত্রিক উপায়ে নির্বাচন অনুষ্ঠান করেছে। এখন বিশ্বের বিভিন্ন বড় বড় দেশ ও সংস্থা আমাদের সরকারকে অভিবাদন জানাচ্ছে।
“একটা কথা বলি, ষড়যন্ত্র শেখ হাসিনার সরকারের বিরুদ্ধে ছিল, ভবিষ্যতেও থাকবে। ষড়যন্ত্রকারীরা নানা সমালোচনার দিক খুঁজে বের করবে। আমরা এসব নিয়ে চিন্তিত না, আমরা বাংলাদেশকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে দেশের মানুষের কাছে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ,” বলেন তিনি।
এদিন নবগঠিত মন্ত্রিসভার সদস্যরা শুক্রবার ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতিতে পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন।
এর পরে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ বলেন, “প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে টানা চতুর্থবারের মতো গঠিত নবনির্বাচিত সরকারকে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইইউসহ সব রাষ্ট্রদূত সম্ভাষণ জানিয়েছেন।”
নির্বাচন নিয়ে বিদেশি রাষ্ট্রগুলোর প্রতিক্রিয়া নিয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নে হাছান মাহমুদ বলেন, “গতকাল (বৃহস্পতিবার) বঙ্গভবনে নবনির্বাচিত সরকারের মন্ত্রিপরিষদের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে মার্কিন রাষ্ট্রদূত, যুক্তরাজ্যের হাইকমিশনার, ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত রাষ্ট্রগুলোসহ প্রায় সব দেশের রাষ্ট্রদূতরা ছিলেন। অর্থাৎ বর্তমান সরকারকে সম্ভাষণ জানাতে তাঁরা সবাই গিয়েছিলেন।”
এ সময় নবনিযুক্ত তথ্য ও সম্প্রচার প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ এ আরাফাত সাংবাদিকদের বলেন, “আগামীতে দুই ধরনের চ্যালেঞ্জ। বৈদেশিক যে ষড়যন্ত্রগুলো বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ কিছু লোকজনের সাথে যুক্ত হয়ে করা হয় এবং দেশের বিরুদ্ধে যে ডিসইনফরমেশন ক্যাম্পিং হচ্ছে সেগুলো আমাদের মোকাবিলা করতে হবে।”
স্বাধীন তদন্ত দাবি
বাংলাদেশের নির্বাচনে ও সামগ্রিক চর্চায় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের ক্ষমতার অপপ্রয়োগ করা হয়েছে এবং এ ক্ষেত্রে সরকার তাদের ব্যবহার করেছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
“বাংলাদেশের প্রধান বাণিজ্য অংশীদারদের উচিত তাদের ব্যবসা-বাণিজ্য অব্যাহত রাখার শর্ত হিসেবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অপব্যবহারের বিষয়ে স্বাধীন তদন্তের ওপর জোর দেওয়া,” বলেন এইচআরডব্লিউ-এর ডেপুটি এশিয়া ডিরেক্টর মীনাক্ষী গাঙ্গুলী।
তিনি বলেন, “গুরুতর অধিকার লঙ্ঘনের জন্য জবাবদিহির অভাব একটি দুর্নীতিগ্রস্ত সংস্কৃতিকে উসকে দিচ্ছে, যেখানে বাংলাদেশিরা তাদের রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির জন্য, এমনকি তারা ঘুষ দিতে ব্যর্থ হওয়ার কারণেও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দ্বারা নিহত বা নিখোঁজ হওয়ার ভয় পেয়ে থাকেন।”
মোট ৭৪৪ পৃষ্ঠার বৈশ্বিক প্রতিবেদনের ৩৪তম সংস্করণে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ প্রায় ১০০টি দেশে মানবাধিকার চর্চার পর্যালোচনা করে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, নির্বাচনী প্রক্রিয়া থেকে দূরে রাখতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার নির্বাচনের আগে বিরোধী দল বিএনপির আট হাজারের বেশি (যদিও এই সংখ্যা ২০ হাজারের বেশি বলে বিএনপির দাবি) নেতা ও সমর্থককে গ্রেপ্তার করেছে।
বিরোধী নেতাদের নির্বাচনে অংশগ্রহণে অযোগ্য ঘোষণা করা যায় এমন প্রক্রিয়াও দেখা গেছে উল্লেখ করে বলা হয়, “অনেককেই নিখোঁজ বলে দাবি করা হয়েছিল। পুলিশ তাদের গ্রেপ্তার করে আদালতে হাজির করার আগে তাদের কয়েক দিন বা কয়েক সপ্তাহ ধরে বেআইনিভাবে আটকে রাখার ঘটনা ঘটেছে।”
বাংলাদেশে মানবাধিকার ডিফেন্ডারদের হয়রানি, নজরদারি ও আটকের সম্মুখীন হতে হচ্ছে দাবি করে প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসে অধিকারের সম্পাদক আদিলুর রহমান খান ও পরিচালক এএসএম নাসিরুদ্দিন এলানকে ২০১৩ সালের একটি প্রতিবেদনের জন্য দুই বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছিল।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, সাংবাদিকরা তাদের মতপ্রকাশের স্বাধীনতার অধিকার প্রয়োগের জন্য ক্রমবর্ধমান আক্রমণের সম্মুখীন হয়ে আসছেন এবং প্রাক-নির্বাচন বিক্ষোভে কয়েক ডজন সাংবাদিক আহত হয়েছেন। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের বদলে সাইবার নিরাপত্তা আইন প্রণয়ন করা হলেও উদ্বেগ কাটেনি।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অধীনে শতাধিক ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে উল্লেখ করে এতে বলা হয়, এটি মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে ক্ষুন্ন করতে এবং সরকারের সমালোচকদের শাস্তি দিতে ব্যবহৃত করা হয়েছে।
রোহিঙ্গা প্রসঙ্গ
এইচআরডব্লিউ-এর বৈশ্বিক মানবাধিকার প্রতিবেদনে বলা হয়, কক্সবাজারের রোহিঙ্গা শরণার্থী ক্যাম্পে নির্বিচারে গ্রেপ্তার, নির্যাতন ও ভয়-ভীতি দেখানো স্বাভাবিক নিয়মে পরিণত করেছে বাহিনীগুলো।
এতে আরও বলা হয়, বাংলাদেশ সরকার রোহিঙ্গা শরণার্থীদের আশ্রয় দেওয়া অব্যাহত রেখেছে। যদিও একটি পাইলট প্রকল্পে মিয়ানমারে প্রত্যাবাসনের জন্য তাদের চাপ দেওয়া হচ্ছে এবং তাদের অসম্মতিতে মিয়ানমারে পাঠানোর চেষ্টা করা হচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
“রোহিঙ্গা শরণার্থীদের আশ্রয় দিয়ে বাংলাদেশ সরকারের আন্তর্জাতিক প্রশংসা ধরে রাখার সুযোগ নেই, কারণ ক্যাম্পগুলো বসবাসের অযোগ্য করে রাখা হয়েছে,” বলেন গাঙ্গুলী।
প্রতিবেদনে বলা হয়, “আন্তর্জাতিক অংশীদারদের জরুরিভাবে তহবিল বাড়াতে হবে এবং বাংলাদেশ সরকারের উচিত তার সীমানার অভ্যন্তরে সব শরণার্থীদের জন্য কাজ ও শিক্ষার সুযোগ তৈরি করা।”
প্রতিবেদনটি তৈরিতে থাইল্যান্ড থেকে সহায়তা করেছেন কুন্নাউত বুনরিক।