নিখোঁজ বিরোধী দলীয় নেতাদের ওপর লুকিয়ে থাকার অভিযোগ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর
2017.07.12
ঢাকা

প্রধান বিরোধী দল বিএনপি গত সাড়ে তিন বছরে নিখোঁজ হওয়া ২৫ জন নেতা-কর্মীর তালিকা প্রকাশ করার পরদিন গুম-খুনের অভিযোগ প্রত্যাখান করে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেছেন, তথাকথিত নিখোঁজ হওয়া ওই ব্যক্তিরা অপরাধ করে বিভিন্ন দেশে লুকিয়ে আছে।
আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী তাদের ধরে নিয়ে যায়নি, বরং সরকারকে বিব্রত করতে বিরোধী দল গুম-খুনের অভিযোগ করছে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
বুধবার তিনি বেনারকে বলেন, “আমি বিষয়টি জেনেছি। আসলে তথাকথিত গুম হওয়া ব্যক্তিরা ক্রাইম করে বিভিন্ন দেশে লুকিয়ে আছে; আর সরকারকে বিব্রত করতে তারা গুম হয়েছে বলে অভিযোগ করছে।”
“তবে, এটুকু বলতে পারি যে আমরা তাদের দেওয়া তালিকা আবার তদন্ত করে দেখব,” যোগ করেন তিনি।
গত মঙ্গলবার বিকেলে দলীয় কার্যালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী আহমেদ ২০১৩ সাল থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত নিখোঁজ নেতা-কর্মীদের তালিকা প্রকাশ করে তাদের ফিরিয়ে দিতে সরকারের প্রতি দাবি জানান।
নিউইয়র্ক ভিত্তিক মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ গত বৃহস্পতিবার ‘বাংলাদেশ: এন্ড ডিসঅ্যাপিয়ারেন্সেস অ্যান্ড ডিটেনশনস’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। সরকার সেই প্রতিবেদনটিও প্রত্যাখ্যান করে।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচের প্রতিবেদন প্রকাশের পর বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে তার দলের নেতা-কর্মীদের নিখোঁজ হওয়ার ঘটনা বলতে গিয়ে জনসভায় কেঁদে ফেলেন।
জবাবে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বিএনপিকে নিখোঁজ হওয়া নেতা-কর্মীদের তালিকা দিতে বলেন। এর দুদিন পর বিএনপি ২৫ জন গুম হওয়া ব্যক্তিদের তালিকা প্রকাশ করে।
২০১৩ সালের এপ্রিল থেকে নিখোঁজ থাকা বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক ইলিয়াস আলীর স্ত্রী তাহসিনা রুশদীর লুনা শনিবার বেনারকে বলেন, “চার বছরের বেশি হয়ে গেলো উনি নিখোঁজ। আর সরকার বলছে উনি গুম হননি।”
“তাহলে জীবন্ত মানুষটি কোথায়? লুকিয়ে থাকলে সরকার বের করুক,” তিনি বলেন।
বিএনপির নিখোঁজ তালিকা
বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী আহমেদের তালিকার নিখোঁজ নেতা কর্মীদের মধ্যে রয়েছেন, কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক ইলিয়াস আলী, নির্বাহী কমিটির সদস্য চৌধুরী আলম, সাবেক এমপি সাইফুল ইসলাম, হুমায়ূন কবির, তেজগাঁও কলেজ ছাত্রদল সভাপতি আমিনুল ইসলাম, তেজগাঁও বিএনপি নেতা সাজেদুল হক ও তার খালাতো ভাই জাহিদুল করিম, নাখালপাড়ার আব্দুল কাদের ভূঁইয়া ও মাজহারুল ইসলাম, মুগদাপাড়ার আসাদুজ্জামান ও উত্তর বাড্ডার আল-আমিন।
এছাড়া এই তালিকায় আরও যারা রয়েছেন তাঁরা হলেন, বিমানবন্দর থানা ছাত্রদল সভাপতি এম এ আদনান চৌধুরী ও কাওসার আহমেদ, সবুজবাগ থানা ছাত্রদল সভাপতি মাহাবুব হাসান, ছাত্রদল নেতা খালিদ হাসান, সম্রাট মোল্লা, জহিরুল ইসলাম, পারভেজ হোসেন, মো. সোহেল, চঞ্চল, নিজাম উদ্দীন, তরিকুল ইসলাম, কাজী ফরহাদ, সেলিম রেজা ও গিয়াস উদ্দীন।
বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠনের প্রতিবেদন উল্লেখ করে রিজভী বলেন, ২০১৩ থেকে ২০১৭ সালের মার্চ মাস পর্যন্ত ৪৩৫ জন গুম হয়েছেন। তাঁদের মধ্যে ২৫২ জনের কোনো হদিস নাই; ৩৯ জনের লাশ পাওয়া গেছে, ৪৩ জনকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে এবং ২৭ জন বিভিন্ন সময় মুক্তি পেয়েছেন।
আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহ উদ্দীন আহমেদকে ৭০ দিন গুম করে রেখে ভারতে ফেলে আসে বলেও জানান তিনি।
জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল হক বেনারকে বলেন, “বিএনপি দলীয়ভাবে গুম হওয়া ব্যক্তিদের কোনো তালিকা আমাদের দেয়নি। তবে আমরা সংবাদমাধ্যমে এ ব্যাপারে জেনেছি। আমরা তদন্ত করে এগুলোর ওপর প্রতিবেদন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়ে দেবো যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য।”
তিনি বলেন, “জাতীয় মানবাধিকার কমিশন সারা দেশ থেকে বিভিন্ন সময়ে অভিযোগ পেয়েছে যে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে অনেক মানুষকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।”
“আমরা বিষয়গুলো তদন্ত করে দেখছি। আর সরকারের উচিত নিখোঁজ থাকা ব্যক্তিদের খুঁজে বের করা,” চেয়ারম্যান হক বলেন।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচ এর প্রতিবেদনে গুম-খুন
হিউম্যান রাইটস ওয়াচ তার প্রতিবেদন মতে, ২০১৬ সালে ৯০ জন ব্যক্তি গুম হয়েছেন। অজ্ঞাতস্থানে আটক থাকার পর কয়েক সপ্তাহ বা কয়েক মাস পর তাঁদের আদালতে উপস্থিত করা হয়।
নিখোঁজ অবস্থায় ২১ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়। নয়জন কোথায় আছেন সে ব্যাপারে কিছু জানা যায়নি। এই ৯০ জনের মধ্যে বিরোধী দলীয় তিন নেতার সন্তান রয়েছেন। আগস্টের বিভিন্ন সময় তাঁরা নিখোঁজ হন। ছয় মাস পর অজ্ঞাতস্থান থেকে তাঁরা মুক্তি পেয়ে বের হন, তবে বাকি দুজনের এখনো কোনো হদিস নেই।
এতে আরও বলা হয়, ২০১৭ সালের প্রথম পাঁচ মাসে ৪৮ জন নিখোঁজ হন। অজ্ঞাতস্থানে থাকার সময় তাঁদের ওপর নির্যাতন ও দুর্ব্যবহারের অভিযোগ আছে।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচের এশিয়া অঞ্চলের পরিচালক ব্র্যাড অ্যাডামস বলেন, “গুম হওয়ার ঘটনাগুলো খুব ভালোভাবে লিপিবদ্ধ আছে এবং রিপোর্ট হয়েছে। কিন্তু সরকার আইনের শাসনের প্রতি অবজ্ঞা দেখানোর ঘৃণ্য সংস্কৃতি অব্যাহত রেখেছে।”
তবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান গত শুক্রবার আনুষ্ঠানিকভাবে হিউম্যান রাইটস ওয়াচের এই প্রতিবেদন প্রত্যাখ্যান করেছেন।