যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিবেদনে বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি: সরকারের প্রত্যাখ্যান
2017.03.06
ঢাকা

বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিবেদনকে সরাসরি নাকচ করে দিয়েছে সরকার। এই প্রতিবেদনকে ‘গতানুগতিক’, ‘নীতিবহির্ভূত’ ও ‘সত্যের অপলাপ’ বলে দাবি করেছেন তাঁরা।
গত শুক্রবার প্রকাশিত যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের বার্ষিক প্রতিবেদনে বিচারবহির্ভূত হত্যা, গুম ও বেআইনি আটককে বাংলাদেশে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে বড় অন্তরায় বলে উল্লেখ করা হয়।
তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনুর ভাষায় “বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি দেখার বিষয়ে তাঁদের চশমাটা ভুল, দেখার চোখটাও ঝাপসা।”
তবে এই প্রতিবেদনে বাংলাদেশের বাস্তব পরিস্থিতিরই প্রতিফলন ঘটেছে বলে মত দিয়েছেন বিশ্লেষকদের কেউ কেউ।
কী আছে ওই প্রতিবেদনে?
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গুলশান হামলাসহ বিভিন্ন হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের সঙ্গে আইএস-আল কায়েদার মতো আন্তর্জাতিক জঙ্গি গোষ্ঠীগুলোর যোগাযোগ রয়েছে। বাংলাদেশে জঙ্গি সংগঠনগুলোর তৎপরতা বেড়েছে; যারা নিজেদের আইএস ও আল-কায়েদার ভারতীয় উপমহাদেশ শাখার সহযোগী বলে দাবি করে।
তবে বরাবরই আইএসের অস্তিত্ব অস্বীকার করে বাংলাদেশের দাবি, দেশি জঙ্গিরাই এসব সন্ত্রাসী হামলা ও হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে আন্তর্জাতিক গোষ্ঠীগুলোর নাম ভাঙাচ্ছে।
সরকারের এই অবস্থানের সমালোচনায় মার্কিন প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, “বিভিন্ন হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার করে কখনো আইএস, কখনো আল-কায়েদার নামে বার্তা এসেছিল। অথচ বাংলাদেশ সরকার ওই সব বার্তা আমলে নিচ্ছে না।”
গুলশানে হলি আর্টিজান বেকারিতে হামলার লক্ষ্যবস্তু ছিলেন বিদেশিরা। এর আগে হত্যাকাণ্ডের শিকার হন ব্লগার, লেখক, অধ্যাপক, ভিন্ন মতাবলম্বী মুসলিম, হিন্দু পুরোহিত, খ্রিষ্টান ধর্মযাজক, সমকামী অধিকারকর্মীরা।
২০১৪ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে বিতর্কিত আখ্যা দিয়ে এটি আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন ছিল না বলেও দাবি করা করা হয়েছে প্রতিবেদনে। তবে বলা হয়েছে, নিরাপত্তা বাহিনী ও বেসামরিক প্রশাসনের ওপর সরকারের কার্যকর নিয়ন্ত্রণ রয়েছে।
গুম, বেআইনিভাবে আটক, সংখ্যালঘুদের হত্যা, বাল্যবিয়ে বিশেষ করে নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতা এবং দুর্বল শ্রম অধিকার আইনের কড়া সমালোচনা করা হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্র বলেছে, নিরাপত্তা বাহিনীর হত্যা ও নির্যাতনের ঘটনাগুলোর তদন্ত ও দায়ীদের বিচারের আওতায় আনার ক্ষেত্রে সরকারের পদক্ষেপ সীমিত।
পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ওপর আস্থাহীনতার কারণে ভুক্তভোগীরা অনেক সময় তাদের শরণাপন্ন হয় না। তা ছাড়া অভিযোগের জবাবে উল্টো ভুক্তভোগীদের দায়ী করা হয়। সরকারের এমন বক্তব্যের ফলে দায়মুক্তি পায় বাহিনীগুলো।
এ ছাড়া বিচার বিভাগের দুর্বলতা এবং বিচার ছাড়াই দীর্ঘদিন ধরে আটকের ঘটনা, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত সহিংসতা, অনলাইনে মত প্রকাশে বাধা এবং এনজিওগুলোর কাজে নিয়ন্ত্রণ আরোপের বিষয়গুলো উদ্বেগজনক বলে ওই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।
বাংলাদেশ সরকার যা বলছে
যুক্তরাষ্ট্র সরকারের এই অভিযোগগুলো সরাসরি অস্বীকার করেছেন বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন দল ও সরকারের মন্ত্রীরা।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বেনারকে বলেছেন, “জঙ্গিবিরোধী অভিযানের নামে আমরা কাউকেই বিচারবহির্ভূতভাবে হত্যা করিনি।”
গুমের অভিযোগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “অনেক মানুষ, যাদের নিরুদ্দেশ বলে খবর বেরোচ্ছে, তারা স্বেচ্ছায় গা ঢাকা দিয়েছে। আমাদের কাছে রেকর্ড আছে।”
তিনি বলেন, “এদের অনেকেই ঋণ পরিশোধের দায় থেকে বাঁচতে এবং কেউ আবার প্রেমিকার কাছে প্রত্যাখ্যাত হয়ে অভিমান করে বাড়ি ছেড়েছেন। সরকারের দুর্নাম করার জন্যও কিছু মানুষ লুকিয়ে আছে।”
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর মতে, মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদনে নতুন কিছু নেই। এটি গতবারের মতোই গতানুগতিক।
বাংলাদেশে আইএস বা আল-কায়েদার কোনো অস্তিত্ব নেই জানিয়ে তিনি বলেন, “গত বছরের জুলাই থেকে জঙ্গিরা একটাও আক্রমণ সংঘটিত করার সামর্থ্য পায়নি। আমরা তাদের পরিকল্পনাগুলো ব্যর্থ এবং আস্তানগুলো ধ্বংস করে দিয়েছি।”
এ বিষয়ে তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু সোমবার সংবাদ ব্রিফিংয়ে বলেন, “যুক্তরাষ্ট্র পৃথিবীর সব দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে প্রতিবছর প্রতিবেদন প্রকাশ করে। অন্য দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয় নিয়ে তাদের ঢালাও মন্তব্য প্রদান আমরা নীতিগতভাবে সমর্থন করি না।”
ইউরোপ-আমেরিকার চেয়ে জঙ্গি দমনে বাংলাদেশ বেশি সফল বলে মত দেন তথ্যমন্ত্রী।
বাংলাদেশের বাস্তব অবস্থার প্রতিফলন
এই প্রতিবেদনের সঙ্গে অনেকটা একমত পোষণ করেছেন বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক মিজানুর রহমান।
তিনি বেনারকে বলেন, “সরকার এসব স্বীকার করুক আর নাই করুক, মার্কিন ওই প্রতিবেদনে বাংলাদেশের বাস্তব পরিস্থিতিরই প্রতিফলন ঘটেছে।”
“বিচারবহির্ভূত হত্যা বাংলাদেশে হচ্ছে এবং নিখোঁজ হওয়ার অনেক ঘটনা আছে। তবে সরকার কেবলই অস্বীকার করে যাচ্ছে। সুশাসনের প্রয়োজনেই আমাদের এই অস্বীকার করার সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে,” বলেন মিজানুর রহমান।
তবে তাঁর মতে, “অনেক নিখোঁজের ঘটনা থাকা সত্ত্বেও কেবল যুদ্ধাপরাধীর সন্তানের বিষয়টা যুক্তরাষ্ট্র যখন উদাহরণ হিসেবে টানে, তখন তাঁদের প্রতিবেদনটির বৈশিষ্ট্য বিতর্কিত হয়ে পড়ে।”
এ ছাড়া এ ধরনের প্রতিবেদন প্রকাশ করার নৈতিক অবস্থান যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান সরকারের নেই বলে মত দেন তিনি।
প্রতিবেদনে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন কামরান রেজা চৌধুরী।