বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি উদ্বেগজনক: যুক্তরাজ্য
2021.07.09
ঢাকা

বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি ও সংকুচিত গণতান্ত্রিক পরিবেশ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে যুক্তরাজ্য সরকার। তারা মানবাধিকার নিয়ে উদ্বেগে থাকা অগ্রাধিকারভুক্ত ৩২টি দেশের তালিকায় বাংলাদেশকে যুক্ত করেছে।
বৃহস্পতিবার প্রকাশিত মানবাধিকার ও গণতন্ত্র বিষয়ক বার্ষিক প্রতিবেদনে (২০২০) বাংলাদেশে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, গুম, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা খর্ব এবং জিডিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলাসহ বিভিন্ন নির্বাচনে অনিয়মের অভিযোগের কথা তুলে ধরেছে যুক্তরাজ্য।
আগের বছরের সঙ্গে তুলনা করে প্রতিবেদনটি বলছে, ২০২০ সালে সার্বিক অবস্থার উন্নতি হয়নি। তবে চলতি ২০২১ সালে কূটনৈতিক সম্পৃক্ততা ও উন্নয়ন কর্মসূচির মাধ্যমে বাংলাদেশের মানববাধিকার পরিস্থিতির পরিবর্তন তথা সুশাসন ও গণতন্ত্র ইস্যুতে আরও ঘনিষ্ঠভাবে কাজ চালিয়ে যাওয়ার অঙ্গিকার করেছে দেশটি।
প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, ২০১৬ সাল থেকে যুক্তরাজ্য মানবাধিকার নিয়ে উদ্বেগে থাকা অগ্রাধিকারভুক্ত দেশগুলোর তালিকায় বাংলাদেশকে যুক্ত করে আসছে।
যুক্তরাজ্যের ওই প্রতিবেদন সম্পর্কে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে এখন পর্যন্ত আনুষ্ঠানিক কোনও প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করা হয়নি। সরকারের একধিক মন্ত্রী এবং আইন কমিশনের চেয়ারম্যানের সঙ্গে বেনারের পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হলেও কারও মন্তব্য পাওয়া যায়নি।
যদিও মানবাধিকার ও মত প্রকাশের ইস্যুতে যে কোনও প্রতিবেদন সরকার প্রত্যাখান করে থাকে। রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারের সাম্প্রতিক প্রতিবেদন প্রকাশের পর তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ গত ৭ জুলাই বলেছিলেন, “বিশ্বে কিছু সংস্থা আছে যারা বিবৃতি বিক্রি করে। আমরা সাম্প্রতিক সময়ে দেখতে পাচ্ছি, কিছু সংস্থা বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট নিয়ে বিবৃতি দিচ্ছেন। এগুলো আসলে বিবৃতি বা প্রতিবেদন নয়, বিশেষ মহলের প্ররোচনায় বিশেষ প্রেক্ষিতে, বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে তারাএগুলো দিচ্ছেন, মাঝে মাঝে বিবৃতি বিক্রিও করছেন।”
মানবাধিকার সংস্থার নামে বিবৃতি বিক্রি বা রিপোর্ট প্রকাশ করা মানবাধিকার উন্নয়নে সহায়ক হয় না বরং মানবাধিকার সংরক্ষণের বিরুদ্ধে যায়, বলেন ড. হাছান মাহমুদ।
এদিকে যুক্তরাজ্যের বিদেশ ও কমনওয়েলথ কার্যালয় থেকে প্রকাশিত ওই প্রতিবেদনে বিএনপির চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়ার সাজার বিষয়টি উল্লেখ আছে। সাবেক এই প্রধানমন্ত্রীর সাজা সাময়িক স্থগিত করে তাঁকে কারামুক্ত করার পর তাঁর বর্তমান অবস্থানকে গৃহবন্দী হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে।
প্রতিবেদন বলেছে, “সরকারি সিদ্ধান্তে সাজা স্থগিত হওয়ায় বিপক্ষ রাজনৈতিক দলের নেত্রী খালেদা জিয়া গত মার্চে ছয় মাসের জন্য ছাড়া পান। বাসায় চিকিৎসা নেবেন এবং বিদেশে যেতে পারবেন না এই শর্তে তাকে মুক্তি দেয়া হয়। সেপ্টেম্বরে তার সাজার স্থগিতাদেশ বাড়লে ২০২০ সালজুড়ে গৃহবন্দী থাকেন।”
এতে বলা হয়, বাংলাদেশে রাজনৈতিক স্বাধীনতা সীমিত। গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে ঢাকা সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে বিরোধী প্রার্থীর ভোটারদের ভয়ভীতি প্রদর্শন ও হামলার অভিযোগ পাওয়া গিয়েছিল এবং নির্বাচন পর্যবেক্ষণের জন্য বাংলাদেশ সরকার কূটনৈতিক মিশনের সমালোচনা করেছিল।
কোভিড-১৯ মোকাবিলায় বাংলাদেশ সরকারের উদ্যোগগুলো নিয়ে সমালোচনা ঠেকাতে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন প্রয়োগ করাসহ মত প্রকাশের স্বাধীনতার ওপর আরও বিধি-নিষেধ এবং নারী ও কন্যাশিশুদের ওপর অব্যাহত সহিংসতার ব্যাপারে যুক্তরাজ্যের বড় ধরনের উদ্বেগ রয়েছে।
বাংলাদেশের মানবাধিকার সংস্থার বরাত দিয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়, গত বছর আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো ‘ক্রসফায়ার’ ও নির্যাতনের ঘটনাসহ ২২৫টি বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে। আগস্টে পুলিশ অবসরপ্রাপ্ত এক সেনা কর্মকর্তাকে হত্যা করেছিল।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ওই বছর অন্তত ৩১ জনের গুম হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। গণমাধ্যমের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপের কারণে রিপোর্টার্স উইথ বর্ডারসের প্রেস ফ্রিডম ইনডেক্সে বাংলাদেশের অবস্থান ১৮০টি দেশের মধ্যে ১৫১তম। এটি বাংলাদেশের সর্বকালের সর্বনিম্ন অবস্থান।
বেসরকারি সংস্থা আর্টক্যাল নাইনটিনের তথ্য অনুযায়ী, ৪৮১ জন ব্যক্তির বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে ১৯৮টি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে ৪১টি মামলায় ৭৫ জন সাংবাদিককে আসামী করা হয়েছে। অন্তত ৩২ জন সাংবাদিককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
করোনাভাইরাস মোকাবিলায় বাংলাদেশ সরকারের কার্যক্রম নিয়ে সমালোচনা করায় স্বাস্থ্যসেবা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিসহ ৪০০ জনের বেশি লোকের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে আর্টিকেল ১৯ এর বাংলাদেশ ও দক্ষিণ এশিয়া পরিচালক ফারুক ফয়সাল বেনারকে বলেছেন, “করোনা ভাইরাসের মহামারীতে তথ্যের অবাধ প্রবাহ এবং স্বাস্থের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হচ্ছে। তাই করোনা ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে সরকারকে শিখতে হবে, বর্তমান পরিস্থিতিতে যা বেশি জরুরী।”
প্রতিবেদনে একজন ফটো সাংবাদিকের ৫৩ দিন নিখোঁজ থাকার পর তাকে ভারতীয় সীমান্তের কাছে পাওয়া এবং তাকে গ্রেপ্তার করার বিষয়টি প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।
অব্যাহত সংখ্যালঘু নির্যাতনের কথা উল্লেখ করে প্রতিবেদনে বলা হয়, “গত বছর মন্দির, মঠ ও প্রতিমা ভাঙচুরসহ সংখ্যালঘুদের উপাসনালয়ে ৬৭ টির মতো হামলার ঘটনা ঘটেছে। হিন্দুরা তাদের জমি দখলের অভিযোগ করেছেন। নভেম্বর মাসে ফ্রান্সের বিরুদ্ধে বিক্ষোভের পরে হিন্দুরা আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু হয়েছেন।”
নভেম্বর মাসে পার্বত্য চট্টগ্রামে একটি পাঁচ তারকা হোটেল নির্মাণ করার পরিকল্পনায় ম্রো সম্প্রদায় বাস্তুচ্যুত হওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করে এবং তাদের বিক্ষোভে বিষয়টিও উঠে এসেছে যুক্তরাজ্য সরকারের ওই প্রতিবেদনে।
আহমদিয়া মুসলিম ও হিন্দুসহ ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা জানিয়েছে যে তারা চরমপন্থীদের আক্রমনের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছেন। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের অভিযোগ এনে সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ব্যবহার করা হচ্ছে।
নারীদের ওপর সহিংসতা প্রসঙ্গে প্রতিবেদনে বলা হয়, “নারীদের উপর সহিংসতা এখনও একটি বড় রকমের প্রতিবন্ধকতা। স্থানীয় মানবাধিকার সংস্থাগুলোর তথ্যমতে, গত এক বছরে ১৬২৭ টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। এর পেছনে আইনের যথাযথ প্রয়োগ ব্যবস্থার ঘাটতিকে দায়ী করেছেন মানবাধিকার কর্মীরা।”
প্রায় ৮ লাখ ৬০ হাজার রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দেওয়ার জন্য বাংলাদেশের আবারও প্রশংসা করা হয়েছে প্রতিবেদনে।
রোহিঙ্গাদের ভাসান চরে স্থানান্তর প্রসঙ্গে যুক্তরাজ্যের প্রতিবেদনে বলা হয়, ”ভাসান চরে নিরাপত্তা এবং স্থিতিশীলতা যাচাইয়ে জাতিসংঘের টেকনিক্যাল কমিটির মূল্যায়ন নিতে যুক্তরাজ্য এবং অন্যান্য অংশীদার দেশগুলো তাদের আহবান অব্যাহত রাখবে। কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ইন্টারনেট নিয়ন্ত্রিত করায় কোভিড চিকিৎসাসহ বিভিন্ন ধরনের মানবিক কাজ পরিচালনায় ব্যাঘাত ঘটেছে।”
যুক্তরাজ্য সরকারের এই প্রতিবেদনকে বাস্তবতার প্রতিচ্ছবি বলে মনে করেন মানবাধিকার কর্মী ফারুক ফয়সাল। বেনারকে তিনি বলেছেন, “বাংলাদেশে মত প্রকাশের স্বাধীনতা নেই এবং আইনের শাসন নেই। একারণে দেশের ভিতরে প্রতিবাদ করা কঠিন হয়ে যায়। ফলে দেশের বাইরে থেকে যখন কোনও প্রতিবেদন আসে সেটাকেই সমর্থন করে বাংলাদেশের মানুষ নিজের মনোভাবের প্রকাশ ঘটায়।”
“আসলে বাংলাদেশে এখন যা চলছে তাকে না বলা যাবে মত প্রকাশের স্বাধীনতা, না বলা যাবে আইনি স্বাধীনতা। এটা ঠিক না করা হলে গণতান্ত্রিক পরিবেশ ঠিক করা সম্ভব নয়,” বলেন তিনি।