জেলা মানবাধিকার সুরক্ষা কমিটি হচ্ছে ডিসি-এসপির নেতৃত্বে
2021.09.21
ঢাকা

দেশের প্রতিটি জেলায় সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসককে (ডিসি) সভাপতি ও পুলিশ সুপারকে (এসপি) সহ-সভাপতি করে ‘জেলা মানবাধিকার লঙ্ঘন প্রতিরোধ ও সুরক্ষা কমিট‘ গঠনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন।
মানবাধিকার লঙ্ঘনের অধিকাংশ ঘটনা আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বা প্রশাসনের লোকদের দ্বারা সংঘটিত হয় দাবি করে মানবাধিকারকর্মী ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের শিকার ব্যক্তিরা বলছেন, এই উদ্যোগের ফলে মানবাধিকার পরিস্থিতির উন্নতি দূরে থাক, উল্টো আরো অবনতি হতে পারে।
অবশ্য ইতিবাচক চিন্তা-ভাবনা থেকেই এমন সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে দাবি করে মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান নাছিমা বেগম বেনারকে বলেন, “যেহেতু জেলা পর্যায়ে আমাদের কোন অবস্থান নেই সেই কারনেই এমন সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। সমালোচকদের বলবো , সমালোচনার জন্য সমালোচনা না করে আগে দেখুন এটি ইতিবাচকভাবে ভূমিকা রাখে কিনা।”
গত ৭ সেপ্টেম্বর দেশের সকল জেলা প্রশাসক বরাবর পাঠানো মানবাধিকার কমিশনের চিঠির সূত্রে জানা গেছে, কমিশনের ৯৪তম সভায় দেশের সব জেলায় ডিসিদের সভাপতিত্বে জেলা মানবাধিকার লঙ্ঘন প্রতিরোধ ও সুরক্ষা কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।
কমিশনের সচিব নারায়ণ চন্দ্র সরকারের স্বাক্ষরে প্রেরিত ওই চিঠিতে আরো বলা হয়েছে, “মানবাধিকার সুরক্ষা ও উন্নয়নে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়/বিভাগ ও মাঠ প্রশাসনের সঙ্গে একত্রে কাজ করে যাচ্ছে। সম্মিলিত এ প্রচেষ্টার ফলে দেশের সর্বত্র মানবাধিকারের সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব বলে কমিশন বিশ্বাস করে।”
“এই ধারাবাহিকতায় জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সঙ্গে মাঠ প্রশাসনের দাপ্তরিক যোগাযোগের সুবিধার্থে সকল বিভাগীয় কমিশনার ও জেলা প্রশাসকদের দপ্তরে অভিযোগ ও তদন্ত বিষয়ে দায়িত্ব পালন করেন এমন একজন উপযুক্ত কর্মকর্তাকে মানবাধিকার বিষয়ক ফোকাল ডেক্স হিসাবে মনোনয়ন দেওয়া প্রয়োজন,” বলা হয় চিঠিতে।
যেমন হবে এই কমিটি
জেলা প্রশাসকদের কাছে পাঠানো চিঠির সঙ্গে যেভাবে কমিটি গঠন করতে হবে তার নির্দেশনাও দিয়েছে মানবাধিকার কমিশন। তাতে দেখা যাচ্ছে, এই কমিটির সভাপতি থাকবেন ডিসি, সহ-সভাপতি হিসেবে থাকবেন এসপি ও সিভিল সার্জন, সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন যথাক্রমে জাতীয় মহিলা সংস্থার জেলা চেয়ারম্যান, জেলা পরিষদের একজন মহিলা সদস্য, জেলা সমাজসেবা কার্যালয়ের উপপরিচালক, জেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তার কার্যালয়ের উপপরিচালক, জেলা শিক্ষা অফিসার, জেলা সদরের সরকারি কলেজের প্রিন্সিপাল/প্রতিনিধি, জেলা বারের সভাপতি, জেলা প্রেস ক্লাবের সভাপতি, ব্র্যাকের জেলা সমন্বয়ক ও জেলা প্রশাসক কর্তৃক মনোনীত স্থানীয় এনজিও প্রতিনিধি (মানবাধিকার বিষয়ে অভিজ্ঞ)। জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের মানবাধিকার বিষয়ক ফোকাল ডেস্ক কর্মকর্তা ১৪ সদস্যের এই কমিটির সদস্য সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন।
চিঠিতে বলা আছে, কমিটির সভাপতি প্রয়োজনে সর্বোচ্চ তিন জন সদস্য কো-অপ্ট করতে পারবেন।
“এনজিও প্রতিনিধি নির্বাচনে যেসব জেলায় আইন ও শালিস কেন্দ্র (আসক), বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাষ্ট (ব্লাষ্ট) এবং বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবি সমিতির (বিএনডব্লিউএলএ) প্রতিনিধি আছেন সেসব জেলার ক্ষেত্রে উক্ত সংস্থাসমূহের প্রতিনিধিদের অন্তর্ভূক্তকরণে অগ্রাধিকার থাকবে,” বলা আছে চিঠিতে।
এ ছাড়া তিন পার্বত্য জেলার তিনজন হেডম্যানকে কমটিতে রাখার বিষয়ে সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা দেয়া আছে চিঠিতে।
যে কারনে সমালোচনা
মানবাধিকার কর্মী নূর খান লিটন বেনারকে বলেন, “একটি স্বাধীন কমিশন হিসেবে জেলা পর্যায়ে আমলাদের দিয়ে এই কমিটি গঠন করা হলে তা হবে কমিশনেরর স্বাধীন চেতনার সঙ্গে সাংঘর্ষিক। ডিসি ও এসপিরা যেভাবে জেলা পরিচালনা করেন তাতে তাদের নেতৃত্ব কাজ করে অন্য কারো পক্ষে স্বাধীন মত দেয়ার পরিস্থিতি দেশে নেই।”
আইন ও শালিস কেন্দ্রের নির্বাহী কমিটির মহাসচিব নূর খান আরও বলেন, “জেলা পর্যায়ে কাজ করা মানবাধিকার কর্মীরা সবচেয়ে বেশি হয়রানির শিকার হন জেলা প্রশাসক ও পুলিশ কর্মকর্তাদের দ্বারা। দেশে মানবাধিকার লঙ্ঘনের যতগুলো ঘটনা ঘটে তার অধিকাংশই ঘটে নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য বা প্রশাসনের লোকদের হাতে। তাই এই কমিটি কোনক্রমেই মানবাধিকার রক্ষায় নিরপেক্ষ ভূমিকা নিশ্চিত করে কাজ করতে পারবে বলে মনে হয় না।”
তিনি বলেন, কমিশনের উচিত নিজস্ব লোকবল বাড়িয়ে পর্যায়ক্রমে জেলা পর্যায়ে অফিস স্থাপন করা, যাতে করে স্থানীয়ভাবে প্রভাব তৈরি করা যায়। আর কমিটি করতে হলে এমন লোকদের নেতৃত্বে করতে হবে যারা কোনও প্রকার সরকারি দায়িত্বে নিয়োজিত নন।
দেশে নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে নির্যাতনের শিকার হওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে অন্যতম ঝালকাঠি জেলার লিমন হোসেন। দশ বছর আগে ১৬ বছর বয়সে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র্যাব) গুলিতে পা হারান তিনি। ওই ঘটনা সারা দেশে আলোড়ন তৈরি করে। নির্যাতনের শিকার লিমন বর্তমানে গণ বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগে শিক্ষকতা করছেন।
মানবাধিকার কমিশনের এই উদ্যোগ সম্পর্কে জানতে চাইলে লিমন বেনারকে বলেন, “ এটি হবে শিয়ালের কাছে মুরগি বর্গা দেওয়ার মতো ঘটনা। মানবাধিকার লঙ্ঘন কোন সাধারণ মানুষের কাজ নয়, এমন লোক দ্বারাই মানবাধিকার লঙ্ঘিত হয় যিনি নানা কারণে ক্ষমতাবান। বাংলাদেশের বাস্তবতায় মানবাধিকার লঙ্ঘনের সবচেয়ে বেশি অভিযোগ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের বিরুদ্ধে। তাদের সমন্বয়ে করা সুরক্ষা কমিটি কোনওভাবেই মানবাধিকার রক্সায় ভূমিকা রাখতে পারবে না।“
তিনি আশংকা প্রকাশ করে বলেন, “কোনও কোনও ক্ষেত্রে এই মানবাধিকার সুরক্ষা কমিটিই মানবাধিকার লঙ্ঘন ও লঙ্ঘনের ঘটনাকে ধামাচাপা দেয়ার জন্য চরম হাতিয়ার হয়ে উঠতে পারে।”
গত বছর মধ্যরাতে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে কুড়িগ্রামে সাংবাদিক আরিফুল ইসলাম রিগানকে চরম নির্যাতন করেছিলেন কুড়িগ্রামের সাবেক ডিসি সুলতানা পারভীনসহ তার কার্যালয়ের তিনজন সহকারী কমিশনার।
বেনারের সঙ্গে আলাপকালে রিগান বলেন, “আমার অভিজ্ঞতা থেকে যদি বলি, তাহলে বলতে হবে এই ধরনের কমিটি মানবাধিকার পরিস্থিতির কোন উন্নতি করতে পারবে না। এমন লোকদের দিয়ে কমিটি করতে হবে, যারা প্রশাসনের লোকদের জবাবদিহির মধ্যে নিয়ে আসতে পারবেন।”
আইন ও শালিস কেন্দ্রের তথ্য মতে, ২০২০ সালে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে অপহরণ, গুম ও নিখোঁজের শিকার হন ৬ জন। এর মধ্যে পরবর্তী সময়ে ৪ জনকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়, এখনও নিখোঁজ রয়েছেন ২ জন। এছাড়াও রয়েছে হেফাজতে মৃত্যু ও অন্যান্য মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা।
মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যানের বক্তব্য
কর্মরত সরকারি কর্মকর্তাদের নেতৃত্বে কমিটি করার যুক্তি সম্পকে জানতে চাইলে নাছিমা বেগম বলেন, “আমাদেরকে যেহেতু নানা কাজে প্রশাসনের লোকদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেই হয় সেহেতু কমিশন মনে করে জেলার প্রধান হিসেবে ডিসিদের নেতৃত্বেই এই কমিটি হওয়া উচিত। কাজটি আমরা শুরু করতে চাই। যদি দেখি সুফল পাওয়া যায় এটি থাকবে, যদি দেখি সুফল আসছে না, তাহলে থাকবে না।“
“আমাদের সক্ষমতার ব্যাপক ঘাটতি আছে। আইনেও অনেক সীমাব্ধতা আছে। পুলিশ বাহিনীর সদস্যের বিরুদ্ধে আমরা সরাসরি কোন ব্যবস্থা নিতে পারি না, সে কারণে কখনো কখনো প্রত্যাশিতভাবে মানুষের আশার প্রতিফলন ঘটে না।”